সিকদার গিয়াসউদ্দিন, লাস ভেগাস, নেভাদা, যুক্তরাষ্ট্র:
আজ ১৪’ই জুন। আমেরিকার মহান পতাকা দিবস।আমেরিকায় প্রতি বছর অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে দিনটি উদযাপিত হয়। বিশ্বের সকল দেশেরই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি সহকারে পতাকা দিবস আছে এবং তা যথানিয়মে প্রতিপালিত হয়ে থাকে। ফ্ল্যাগ ডে-উইকিপিডিয়া বা গুগল সার্চ করে পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের পতাকা দিবস সম্পর্কে জানা এখন খূবই সহজ ব্যাপার বটে। প্রতি বছর মে’মাসের নয় তারিখ ইউরোপীয় ইউনিয়ন দিবস এবং অক্টোবর মাসের ২৪’তারিখ জাতিসংঘ দিবস পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে স্মরণ করা হয়।সেমিনার কিংবা নানা আয়োজনের বিষয়টি বাদই দিলাম।কানাডা,অষ্ট্রেলিয়া সহ ইউরোপ ও এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের সকল দেশের পতাকা দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও পালনের বিষয়টি জানার পরেও দীর্ঘ ছেচল্লিশ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের পতাকার কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আছে কি?

এ ব্যাপারে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ইতিহাসের ছাত্রদের সঠিক ইতিহাসকে ধারন করার ব্যাপারে কোন ধরণের ব্যবস্থা আদৌ আছে কি? আম জনতার জানার বিষয়টি সেতো আরো অনেক দূরের ব্যাপার। অথচ বাংলাদেশের পতাকা নির্ধারণ, পতাকা বানানো ও পতাকা উত্তোলনের বিষয়টি গোপন ও প্রকাশ্য মিলিয়ে কন্ঠকাকীর্ণ পথ বেয়ে এতোই বিপদসঙ্কুল, ঝুঁকিপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর যে-পৃথিবীর ইতিহাসে তা অত্যন্ত বিরল।

ঐতিহাসিক ও গবেষকদের দেয়া তথ্য ও গবেষণা থেকে যতটুকু জানা যায়-বিশ্বের সকল স্বাধীনতা আন্দোলন কিংবা জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন শেষে আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত গোষ্টী, দল বা আন্দোলনের নায়কদের মধ্যে আদর্শগত ও নানা কারণে মতভেদ দেখা দিয়েছে কিংবা বিভক্তি এসেছে। আবর্তন বিবর্তনে আবহমানকাল থেকে তাই চলে আসছে। তবে বিশ্বের সকল দেশেই যত বিভক্তি বা মতভেদ থাকুক না কেনো- বিশেষ করে স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত গোপন বা প্রকাশ্য ঘটনা ও সাধারণ ব্যক্তির কর্মকান্ডকেও অনেক গুরুত্ব সহকারে ইতিহাসে ধারণ করা হয়। ইতিহাসের নায়কদের মাঝে যত মতভেদ, জেলাসী থাকুক না কেনো- ক্ষমতা ও রাজনৈতিক কারণে ইতিহাসের নায়কদের অবমূল্যায়ন করা রীতিমতো নৈতিক অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়।

জীবিতদের রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদানতো আছেই-মৃত্যুর পরে তাঁদেরকে নিয়ে ইতিহাসে গর্ব প্রকাশের বিষয়টি ইতিহাস ও রাজনীতির ছাত্রদের জানার কথা। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারির পর থেকে যখন যারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলো এবং আছে তারা তাদের মতো করে ইতিহাস তৈরী ও সাজানোর বিষয়টি বিভিন্ন লেখা, প্রতিবেদন ও পত্রপত্রিকায় দেখা যায়।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ইতিহাসকে যেভাবে বিকৃত করা হয়েছে তাতে করে বর্তমান প্রজন্ম ও ১৯৭১ সাল পরবর্তি প্রজন্মের মধ্যে কনফিউজড ইতিহাস ধারণের মধ্য দিয়ে দেশপ্রেম গড়ে না উঠার কারণে আদর্শিক অধ:পতন, নৈতিকতা বিবর্জিত ক্ষমতা কিংবা অর্থের পেছনে দৌড়ানো, রাতারাতি বিত্তবান হওয়ার প্রতিযোগিতায় হাইব্রীডদের দৌরাত্ব্যে দুর্নীতি ও অমানবিক কর্মকান্ডের প্রতি আকর্ষণের হেতু নিয়ে গবেষক ও ঐতিহাসিকরা লিপ সার্ভিস ছাড়া এখনো তেমন একটা নজর দিয়েছে বলে মনে হয়না।

ইতিহাসের সত্যঘটনাগুলো নিয়ে যদি বারবার টানাহেঁচড়া চলে- তাতে করে দেশপ্রেমিক প্রজন্ম গড়ে উঠার সম্ভাবনা আদৌ আছে কি? দেশপ্রেমতো ছোটবেলা থেকেই প্রশিক্ষণের একটা বিষয়। ইতিহাসের সত্যকথন বিবর্জিত প্রজন্ম থেকে আমরা দেশপ্রেম আদৌ কি আশা করতে পারি? আমাদের দায়বদ্ধতা কতটুকু? ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘বাংলাদেশ’ আমাদের জাতীয় সম্পদ। দল ও পরিবারিক গণ্ডি থেকে আমরা আদৌ কি বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধার করতে পেরেছি? কাগজে কলমে কত কিছুইতো থাকে! এভারেস্ত শৃঙ্গকে সমুন্নত রাখতে হলে হিমালয়ের চতুর্পাশ্বের পর্বতরাজিকে আমরা আদৌ সুশোভিত করতে পেরেছি কি? শহর,বন্দর ও গ্রামাঞ্চচল রাস্তা ও পাহাড়গুলো সাজানোর বিষয়টি সেতো আরও অনেক দুরহ ও দূরের ব্যাপার নয় কি?

১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে। পাকিস্তান সামরিক সরকারের তালবাহানা চলতে থাকে। এক পর্যায়ে সামরিক শাসক প্রধান জল্লাদ ইয়াহিয়া জাতীয় সংসদের অধিবেশন বাতিল করলে সারাদেশ আগ্নেয়গিরির দাবানলের মতো জ্বলে উঠে।বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসূ’র নেতৃত্বে চার খলিফা খ্যাত ছাত্রনেতাদের নিয়ে ১ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় জনসমাবেশ আহ্ববান করতে বাধ্য হয়। ২মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের স্মরণকালের বৃহত্তম ছাত্রজনসভায় তিল ধরণের ঠাঁই ছিলোনা। এতো বেশী জনসমাগম হয়েছিলো এবং বাঁধভাঙা জনস্রোতের শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছিলো।

শ্লোগানে শ্লোগানে মূখরিত ও উত্তেজিত ছাত্রজনতার উদ্দ্যেশ্যে মাইক হাতে নিয়ে ১০:৪৫ মিনিটে ডাকসু সহ-সভাপতি সভায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এই সভায় চার খলিফার কন্ঠে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার কথা ও প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী সমবেত সকলকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করে স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার শপথবাক্য পাঠ করান।

এরপর এলো ঐতিহাসিক মুহুর্ত। সভায় চার খলিফা ও লক্ষ ছাত্র জনতার উপস্থিতিতে ডাকসু সহ-সভাপতি ও স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা আ স ম আবদুর রব পতাকা উত্তোলন করলে লক্ষ ছাত্রজনতা করতালি ও মুহুর্মুহু শ্লোগানে দিকবিদিক না ভেবে উল্লাসে ফেটে পড়ে। এভাবে সেদিন স্বাধীন বাংলার পতাকা ছাত্র জনতা কর্তৃক অনুমোদিত হয়। পরে যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকার এই পতাকাতলেই জনযুদ্ধের সকল কর্ম সম্পাদন করে। সেদিন ২ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতি কেবলমাত্র স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া ব্যতীত পেছন ফেরার সব পথ কি রুদ্ধ হয়ে যায়নি?এটা বুঝতে কি বড় কোন ডিগ্রীর প্রয়োজন?

পরবর্তি দিন ৩ মার্চ ইশতেহার বা প্রক্লেমেশন বা ঘোষণা দিবস, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ এর পর ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে প্রতিরোধ দিবস অত:পর পঁচিশে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী হায়েনা বর্বর সামরিক বাহিনীর স্মরণকালের বর্বরোচিত গণহত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন জনযুদ্ধে রূপান্তর হয়নি? আমরা যদি গভীরভাবে তলিয়ে দেখি-যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো তবে চার খলিফা খ্যাত যথাক্রমে আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আব্দুল কুদ্দুস মাখনের অবস্থা কি হতো? বিশেষ করে আ স ম আবদুর রবের হাড্ডিমাংস কি খুঁজে পাওয়া যেতো? জানি স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে ও পরে এঁদের ভেতর বিরোধ ছিলো-সে প্রশ্নে না গিয়ে সেই বিপদসঙ্কুল সংঘাতময় দিনগুলোতে তাঁদের বীরত্বের দিকগুলোর স্বীকৃতি জাতি এখনো দিয়েছে কি? আমার বিশ্বাস যাঁরা বেঁচে আছেন-জীবিতাবস্থায় না পেলেও শত বছর পরে হলেও আগামী জমানার সন্তান ও ঐতিহাসিকদের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আসবেই।

আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে-ইতিহাসের চাকা আপন গতিতেই ঘূরে। পতাকা তৈরী ও নির্ধারণের ইতিহাসের ম্যানিপুলেশন লক্ষনীয়। তাই পতাকা নির্ধারণ, বানানোর রোমাঞ্চকর সত্য ইতিহাসগুলোরও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিকল্প নেই। কারণ ইতিহাস কঠিন সত্যকে একদিন খুঁজে বের করবে ও ধারণ করবেই।
তথ্যসূত্র:www national day calendar.com; www.us flag.orgb United Nations>events>undayflag day-Wikipedia, বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা, টক’শো, সোশ্যাল মিডিয়া। ফটো ক্রেডিট ও কৃতজ্ঞতা: গুগল, সুমন মাহমুদ, লিনু হক, রশীদ তালুকদার।