আবু তাহের মিয়াজী, আল-খোর, কাতার:
একটুখানি সবুজ খুঁজি, একটু সবুজ হাওয়া, এই শহরে একটু সবুজ, অনেক বেশি পাওয়া’। ঠিক তাই চারদিকে আকাশছোঁয়া কংক্রিটের বাড়িঘর উঁচু উঁচু টাওয়ার এবং প্রচ- দাপদাহে মন চায় একটু সবুজের পরশ। মন ছুটে যেতে চায় সবুজের টানে দূরে কোথাও। কিন্তু সেই সবুজের ছোঁয়া যদি পাওয়া যায় মরুর বুকে, তাহলেতো কথা-ই নেই। ঈদের পরেরদিন আব্দুর রশিদ ভাই ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন আমি ফ্রী আছি কি-না? বললাম জ্বি ভাই ফ্রী আছি। বললেন আমরা ঘন্টা খানিকের মধ্যে আসতেছি, আপনি রেডি থাকবেন পার্পেল আইল্যান্ড যাবো।
এ কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে মনে মনে বললাম, যাকে প্রকৃতি টানে রোমাঞ্চিত হয়ে চুম্বুকের মতো। তাকে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে দাওয়াত দিলে তখন আর বলতে পারে না যে আজকে আমার মন ভালো নেই। মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। প্রবাসে ঈদ আসলে কমবেশি সবার মন কাঁদে দেশের মাটিও মানুষের জন্য। প্রবাসীদের প্রবাস জীবন রোবটের জীবনের মতো মনে হয়। আব্দুর রশিদ ভাই আমার নতুন বাসা চিনে না, আগের বাসায় এসেছিল আবার কর্মস্থলে এসেছিল ফ্যামিলি নিয়ে কিন্তু নতুন বাসা চিনে না বলে বললেন হোয়াটসঅ্যাপে লোকেশান দিয়ে রাখেন।
ঘন্টা খানেক পরেই আব্দুর রশিদ ভাইয়ের ফোন, ভাই আপনি বাহিরে আসুন আমরা এসেছি। বাহিরে এসে তাকিয়ে দেখি দুটি গাড়ি, একটাতে আব্দুর রশিদ ভাইয়ের ফ্যামিলি অন্যটি থেকে মাশুক ভাই নেমে এসেছেন, মাশুক ভাইকে দেখে তো সারপ্রাইজ মনে হলো। অনেকদিন পরে মাশুক ভাইয়ের দেখা। সাথে দেখতে পাই আজ থেকে প্রায় বার বছর আগের জয়নাল ভাইকে সাথে নিয়ে এসেছেন তারও ফ্যামিলি। জিজ্ঞেস করে জানতে পারি তিন মাসের ভিজিটে এনেছেন ফ্যামিলি। চেষ্টায় আছে পারমেনেন্ট করার জন্য।
যাইহোক ঈদ উপলক্ষে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে চেপে বসলাম রশিদ ভাইয়ের গাড়িতে, এবার আমাদের কাঙ্খিত পার্পলের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছুটলো। যেতে যেতে কতো সুখ-দুঃখের আলোচনা। এর মধ্যে ভাবী পিছন থেকে বের করে দিলেন পানের বাক্স। পান মুখে দিয়ে তো আরো জমে উঠেছে আমাদের গল্পের ঝুড়ি। এরইমধ্যে পৌঁছে গেলাম আমরা প্রকৃতি, সবুজ আর সরলতা ঘেরা সৌন্দর্যের মনোমুগ্ধকর পার্পল আইল্যান্ড।
গাড়ি থেকে নেমে খানিক সামনে এগুতেই আলিঙ্গন করে সুস্বাগত জানায় কাঠের ব্রিজ। প্রথমেই যে কেউ ব্রিজটি দেখবে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবে। তার দুপাশে মানে ডানে সবুজ, বায়ে সবুজ রয়েছে প্রচুর সবুজ গাছগাছালী। নাম না জানা নানা পাখির কিচিরমিচির ডাক মনে প্রশান্তি এনে দিল। ব্রিজের নিচে পানিতে মাছ, কাঁকড়া, গাছপালা পুষ্প এবং বন্যপ্রাণী দেখতে লাগলাম। এবার আমরা ব্রিজ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম সবুজের ছায়ায়, সেখানে আমরা সবাই মাদুর বিছিয়ে আছরের নামায আদায় করলাম আর দুই ভাবী কয়েকটি গাছের আড়ালে শিশুদের নিয়ে নামাজ আদায় করলেন। নামাজের পরেই চলে এলো ভাবীর হাতের চা নাস্তা আর সিলেটের খাশিয়া পান। মুখে দিয়েই যখন চাপ দিলাম কড়কড়ে মুড়মুড় শব্দে মনে হলো সারা বিশ্ববাসীর রাজা-বাদশাহ আমি! মনে হলে সুখের তরী বইছিল মনের দরিয়ায়….
এবার আমাদের মরু বুকের এই মনোমুগ্ধকর আকর্ষণীয় বেগুনী দ্বীপ দেখা শুরু হলো। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হলো পাথরের পাহাড়ে উঠার। দুই ভাবী ছাড়া সবাই উঠে গেলাম মনের আনন্দে, তখনো প্রচণ্ড গরম যেন সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্ত প্রিয়দেরকে পেয়ে সব ভুলে গিয়ে আনন্দের ঢেউয়ের সাথে ভাসতে লাগলাম। চারদিক ঘুরেফিরে একে অপরের ছবি তুলি আবার রত্নময় জায়গাটিরও ছবি তুলতে থাকি। এরই মাঝে জানতে পারলাম আব্দুর রশিদ ভাইয়ের বড় ছেলে মহসিনের মন ভালো নেই, বিষয়টি জানতে পেরে কারণ জানলাম যে সে সমুদ্রে সাঁতার কাটার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে কিন্তু এ দ্বীপে তো তা নেই। পরে পরিশ্রুতি দেয়া হলো পরের দিন দোখান বীচে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন আমার ভাতিজার মন ভালো হলো। মহসিন মাশাআল্লাহ লেখাপড়া খেলাধুলায় নাম্বার ওয়ান। এইতো গত মাতৃভাষা দিবসে বাংলাদেশ এম্বাসেডর থেকে বক্তৃতায় পুরস্কার নিয়ে এসেছে, আবার কিরাত হামদ নাত খেলাধুলায় ও অনেক পুরস্কার অর্জন করে সে। তারপর সেখান থেকে চলে আসলাম আল-খোর পার্ক। লেখা বড়ো হয়ে যাচ্ছে, ইনশাআল্লাহ আল-খোর পার্ক নিয়ে আগামীতে লিখবো।
ভ্রমণে মানুষের জ্ঞান অর্জন হয়। জ্ঞান অর্জনকে ইসলাম ফরজ করা হয়েছে। হাদিসে উল্লেখ আছে জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ। আরও বলা হয়েছে, তোমরা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন কর। আল্লামা শেখ সাদি (রহঃ) বলেছেন, দুই ব্যক্তি জ্ঞানের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ। চিন্তাশীল ব্যক্তি ও ভ্রমণকারী। ভ্রমণের মাধ্যমে শুধু জ্ঞানই অর্জন করা যায় না, নতুন কিছু দেখে দৃষ্টি পরিতৃপ্তি লাভ করে। স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্যও এটা দরকারি। পবিত্র কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, হে রাসূল, আপনি বলে দিন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ, কীভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। অতঃপর আল্লাহ পুনরায় সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সবকিছু করতে সক্ষম। -সূরা আনকাবুত: ২০
কোলাহলময় এই জীবনটাকে রিফ্রেশ করতে কিছু সময়ের জন্য ঘুরে আসুন কাতার আল-খোর পার্পল আইল্যান্ড। নিশ্চিতে বলতে পারি আপনি যদি এই দ্বীপটিতে ভ্রমণ করেন অবশ্যই আপনার মনকে উড়িয়ে দেবে। আল খোরে অবস্থিত সজিবালয় দ্বীপ কাতার একটি সুন্দর মনোমুগ্ধকর বেগুনি দ্বীপ, প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য নিখুঁত। কারণ এটি একটি লুকানো রত্ন যা সৌন্দর্যের সমস্ত ছায়া ধারণ করে আছে। যদিও এটিকে ‘বেগুনি’ দ্বীপ বলা হয় তবুও এতে প্রচুর সবুজ গাছ রয়েছে। কাতারের এই রত্মময় জায়গাটি আপনাকে অবশ্যই শান্তি নামক জিনিসটির প্রেমে পড়তে বাধ্য করবে। আপনি লবণ জলাভূমি বরাবর হাঁটার সময় মাছ, কাঁকড়া, গাছপালা এবং পুষ্প এবং বন্যপ্রাণীর প্রশংসা করতে বাধ্য হবেন। আর কাঠের ব্রিজ যখনই দেখবেন দুচোখ জুড়ে যদি আকর্ষণ জায়গা নিয়ে কিছু না বলে তাহলে বুঝতে হবে আপনার মন-ই নেই! ব্রিজ দিয়ে সামনে গিয়ে দেখতে পাবেন পাথরের পাহাড়, সেখানে উঠে সবাই পুরো পার্পল আইল্যান্ড সহ আল-খোর আল বায়াত স্টেডিয়াম দেখতে পাওয়া যায়। এই বেগুনি দ্বীপ আপনার প্রতিটি সেকেন্ড প্রতিটি সময় তার মূল্য বুঝিয়ে দেবে। এই পার্পল আইল্যান্ড অবশ্যই একটি অফ মিট আপ করার মতো একটা জায়গা যা ভ্রমণ পিপাসুদের অনেকেই এখনও অন্বেষণ করতে পারেনি। যাদের ইতিহাস শেখার তৃষ্ণা রয়েছে। একাধিক রান্নার অন্বেষণ করা এবং সাহসী কুকিং রোমাঞ্চকর দুঃসাহসিক অভিযানের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের অবশ্যই এই দ্বীপে ভ্রমণ করতে হবে।
আশ্চর্যজনকভাবে মরুর বুকে এই পার্পল আইল্যান্ডে সারা বছর সবুজ গাছগাছালী দেখা মেলে। এবার বলেন তো! কেন আরেকটা সেকেন্ড নষ্ট করে ভাবছেন কি করবেন? এই শান্ত এবং আত্মাপূর্ণ স্পট পরিদর্শন করুন, সমস্ত প্রকৃতির বাসিন্দাদের কথা শুনুন। কাতারের পার্পল আইল্যান্ড হল এমন একটি স্থান যা আপনার মিস করা উচিত নয়। তাই আমি বলি যে, যদি জীবনকে পুরোপুরি বুঝতে চান, জানতে চান, নিজেকে ভালোবাসতে চান তাহলে ভ্রমণের কোনো বিকল্প নাই।