মিনজিন পেই
১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটেছিল তখন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হলেও তারা বুঝতে পেরেছিলেন কেন এমনটি ঘটেছে। চীন সরকারের তখনকার থিঙ্ক ট্যাংক মনে করেছিল যে, তৎকালীণ সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচেভই এর মূল নায়ক। এজন্য কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না (সিপিসি) তাকে অনেক দোষারোপ করে। তারা মনে করেন সংস্কারবাদী এই নেতা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখেননি। কিন্তু চীনা নেতারা সোভিয়েত ইউনিয়নের এই পতনের অন্যান্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরকেও উল্লেখযোগ্যভাবে তুলে ধরেছিলেন। বর্তমানে চাইনিজ নেতারা সেসব ফ্যাক্টরকে যুক্তিযুক্ত নয় বলে নাকচ করে দিয়েছেন।
ফলে বর্তমানে সন্দেহাতীতভাবেই সিপিসি সোভিয়েত পতন থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিয়েছে। ক্ষমতাসীন সিপিসি নেতারা মনে করেন, রাজনৈতিক বৈধতার (Political Legitimacy) জন্য সবচেয়ে অপরিহার্য বিষয় হলো শক্তিশালী অর্থনৈতিক কৃতিত্ব প্রদর্শন করা। সিপিসি’র একক মনোযোগ এখন সেদিকে। জিডিপি দ্রুত বৃদ্ধিই এখন তাদের সবচেয়ে বড় আরাধনা। গত কয়েক দশক ধরে তা তারা করে দেখিয়েছে। চীনে জিডিপির এই প্রবৃদ্ধি সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক অলৌকিকতার (Economic Miracle) তকমা পেয়েছে। এর উদাহরণ হলো, ১৯৯১ সালে চীনের নামমাত্র মাথাপিছু আয় ছিলো ৩৩৩ মার্কিন ডলার। আর ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭,৩২৯ মার্কিন ডলারে। এ যেন রকেট গতির প্রবৃদ্ধি। চীনে সিপিসি ক্ষমতায় থাকার এটিই একমাত্র এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করছেন সিপিসি’র নেতারা।
কিন্তু একটি হতাশাজনক অর্থনীতির পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত থাকাই সোভিয়েত নেতাদের একমাত্র ভুল ছিলনা। উপরন্তু তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি ব্যয়বহুল এবং অজেয় অস্ত্র প্রতিযোগিতার মধ্যে ডুবে ছিলেন। তাদের শাসনকালে তারা দেশের সম্পদ এবং অর্থ দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্র কৌশলগত স্বার্থে বিনিয়োগ করেছিলেন। যার ফলে তারা সাম্রাজ্যবাদী কূটচালে পড়ে স্নায়ুযুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং আগ্রাসী হয়ে উঠেন। বর্তমানে চীনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। সে কারণে বিশ্লেষকরা মনে করছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো সিপিসি’র ক্ষেত্রে একই রকম বিপর্যয়মূলক ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে চীন প্রকৃতপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে যাচ্ছে না। চীনের প্রতিরক্ষা বাজেটের দিকে তাকালেই এটা মনে হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন কথা বলছে। চলতি বছর চীনের সরকারি প্রতিরক্ষা বাজেটে প্রায় ১৭৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ বছরের সামরিক বাজেটের এক চতুর্থাংশের সমান। চলতি বছর মার্কিন কংগ্রেস যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক খাতে ৭০০ বিলিয়ন ডলারের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর মতে চীনের প্রকৃত সামরিক ব্যয় নির্ধারিত সরকারি বাজেটের তুলনায় অনেক বেশী। এক উপাত্তে তারা দেখিয়েছে গত বছর চীন সামরিক খাতে ২২৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে যা তখনকার ঘোষিত সরকারি বাজেট (১৫১ বিলিয়ন ডলার) থেকে ১৫০ শতাংশ বেশী ছিল। বিষয়টি এমন নয় যে চীন একটি বন্দুক প্রতি কত টাকা ব্যয় করছে বরং তা সামরিক খাতে চীনের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধিকেই নির্দেশ করে। যার অর্থ দাঁড়ায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে লিপ্ত হবার জন্য তার দেশ প্রস্তুত আছে। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থ-সম্পদ এর যোগান দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করবে, চীনা অর্থনীতির সেই সক্ষমতা এখনো গড়ে উঠেনি।
যদি চীনের একটি টেকসই প্রবৃদ্ধির মডেল থাকতো যার উপর এর উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অর্থনীতির ভিত্তি দাঁড়াবে, তাহলে হয়ত চীন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মোটামুটি অস্ত্রপ্রতিযোগিতার সক্ষমতা লাভ করতে পারতো, কিন্তু চীনের সেধরণের অর্থনৈতিক ভিত্তি কখনো ছিলনা। শুধু জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ধরে রাখলে সব সমস্যার সমাধান হবে না। দ্রুত হারে বয়োবৃদ্ধি, উচ্চ ঋণের মাত্রা, কর্মক্ষমতার অসমতা এবং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে ম্যাক্রো লেভেলে চীনের প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই ফ্যাক্টরগুলো সিপিসির সীমিত সম্পদকে গিলে খাবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অর্থনীতির উপর বয়োবৃদ্ধদের নির্ভরতার হার বাড়লে চীনকে স্বাস্থ্যসেবা ও পেনশন খাতে বড় আকারে খরচ বাড়াতে হবে।
তাছাড়া, চীনের অর্থনীতি সোভিয়েত অর্থনীতির চেয়ে অনেক বেশী দক্ষতা অর্জন করতে পারলেও তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতার কাছাকাছিও নেই। এর প্রধান কারণ হলো চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান (State Owned Enterprises- SOEs) যা দেশটির মোট ব্যাংক ক্রেডিট এর অর্ধেক ভোগ করে, কিন্তু কর্মসংস্থান ও অন্যান্য মূল্যসংযোজনে তাদের অবদান মাত্র ২০ শতাংশ। এটা চীনা অর্থনীতির জন্য বিরাট এক বোঝা। এখন সিপিসি’র জন্য সমস্যা হলো SOEs একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ঠিকই, কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সিপিসি’র প্রতি বিশাল অনুগতগোষ্ঠীকে উচ্চহারে বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে পুরস্কৃত করতে হয়। আবার সরকারিভাবে গৃহিত বিভিন্ন বৃহৎ অর্থনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়নে সরকারের হস্তক্ষেপকে সহায়তা প্রদানের জন্যও SOEs কে ব্যবহার করা হয়।
এখন চীনের জন্য প্রথম নির্দেশনা হলো ফুলেফেঁপে উঠা এইসব অদক্ষ-অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে দেয়া। তা না হলে বিষয়টি চীনের জন্য রাজনৈতিক আত্মহত্যার সামিল হবে। এগুলোকে রক্ষা করা মানে যেকোন অনিবার্যতা বাস্তবায়নে বিলম্ব করা। কারণ যতদিন SOEs কে অর্থনীতির অপ্রতুল সম্পদ শোষণ করার অনুমতি দেয়া হবে ততদিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাবে, যার ফলে সিপিসি’র কর্তৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতাও আরো প্রকট আকার ধারণ করবে।
দ্বিতীয় নির্দেশনা হলো, চীনকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে হবে। কিন্তু সিপিসি’র নেতারা এ বিষয়ে বিভিন্ন মহলের দেয়া পরামর্শকে চীনা নেতারা যথাযর্থরূপে মূল্যায়ণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রায় এক দশক আগে ব্যাপক বাণিজ্য উদ্বৃত্তের কারণে চীনের অর্থভান্ডারে প্রচুর নগদ অর্থ জমা হয়। তখন চীন সরকার অনেক ব্যবহুল বিদেশী অঙ্গীকার গ্রহণ করে এবং অত্যন্ত দূর্বল মিত্রদেরকেও ভর্তুকিসহ ঋণ সহায়তা দেয়।
একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যায়, আর তা হলো বহুল আলোচিত মেগা প্রকল্প Belt and Road Initiative (BRI)। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্য চীনকে ১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। এর মধ্যে সিংহভাগ ঋণ সহায়তা হিসেবে দিতে হবে উন্নয়নশালী দেশগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণ করার জন্য। এক্ষত্রে আগাম দুর্দশার চিত্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা সিপিসিকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ করবে। তবুও চীন ইজও কে সামনে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। এটাকে চীনা নেতারা তাদের নতুন Grand Strategy এর ভিত্তিমূল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হিসাবে বিবেচনা করছে।
বিভিন্ন দেশকে উদার অর্থনৈতিক সাহায্যের নামে চীন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের উদাহরণ সৃষ্টি করছে। কম্বোডিয়া, ভেনিজুয়েলা এমনকি রাশিয়ার মতো দেশগুলো এ তালিকার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চীন এর বিনিময়ে যৎসামান্য লাভ আশা করতে পারে। কলেজ অব উইলিয়ামস এ্যান্ড ম্যারি (College of William and Marry) অনুদান ডাটা (Aid Data) বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে, ২০০০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কম্বোডিয়া, আইভোরিকোস্ট, কিউবা, ইথিওপিয়া এবং জিম্বাবুয়ে ২৪.৪ বিলিয়ন ডলার চীনা অনুদান বা ভর্তুকিকৃত ঋণ সুবিধা লাভ করছে। একই সময়ে এঙ্গোলা, লাওস, পাকিস্তান, রাশিয়া, তুর্কেমিনিস্তান ও ভেনিজুয়েলা পেয়েছে ৯৮.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটাকে চীনের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন নীতির প্রতিফলন হিসেবে মূল্যায়ন করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
বর্তমানে চীন ‘চীন-পাকিস্তান’ অর্থনৈতিক করিডোর (Economic Corridor) প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানকে ৬২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সুবিধা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। চীনের প্রণীত এই প্রকল্প পাকিস্তানকে তার দেশে বিদ্যমান লেনদেনের ভারসাম্য (Balance Of Payment) সংকট মোকাবেলা করতে বিরাট ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এর ফলে চীন সরকারের অর্থভান্ডার সংকুচিত হয়ে পড়বে। কারণ একই সময়ে চীনকে তার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের প্রতিরক্ষার স্বার্থে অভ্যন্তরীণ বাজারে পূর্ণ সরবরাহের হুমকি মোকাবেলা করতে হবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো চীনও সামান্য প্রাপ্তির জন্য তার নামসর্বস্ব মিত্রদের বেশী বেশী দিয়ে যাচ্ছে। আবার ক্রমবর্ধমান হারে অস্থির অস্ত্র প্রতিযোগিতা দেশটির জন্য কখনো টেকসই হবেনা। এক্ষেত্রে মিত্রদেশগুলোর দূর্বল অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে কারণে তাদের কাছ থেকে যৎসামান্য সুবিধার বেশী চীন আশা করতে পারেনা। সে কারণে বলা যায়, চীন-আমেরিকা ঠান্ডা লড়াই কেবল শুরু হয়েছে ঠিকই কিন্তু চীন এখনো হারের ট্র্যাকেই রয়েছে।
(মিনজিন পেই– ক্যালিফোর্নিয়া’র ক্লারমেন্ট ম্যাককেইন কলেজের সরকার ও রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক এবং China’ s Crony Capitalism বইয়ের লেখক)
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন: শহীদ রাজু, নির্বাহী সম্পাদক, প্রবাস মেলা।