আবু তাহের মিয়াজী, দোহা, কাতার
ভ্রমণে গিয়েছিলাম ঈদুল আযহা উপলক্ষে ছুটি পেয়ে। সেজন্য প্রথমে প্রবাসের ঈদ নিয়ে সামান্য কথা সবার সাথে শেয়ার করতে চাই। আমি কাতারে একটা কোম্পানিতে কাজ করি। আমার কোম্পানির ছুটি বছরে ২ ঈদে দু’দিন করে চার দিন। ঈদুল ফিতরে দু’দিন, ঈদুল আযহাতে দু’দিন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশেগুলোতে সূর্য উদিত হওয়ার সাথে সাথে ঈদের নামাজের জামায়াত হয়ে যায়। গেল ঈদেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। নাস্তা শেষে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিলাম, তখনি পরিবার-পরিজন, মমতাময়ী মা, প্রিয় বাবা, প্রিয়তমা স্ত্রী, কলিজার টুকরো সন্তান, আদরের স্নেহময় ভাই-বোন পাড়া প্রতিবেশীদের কথা মনে পড়তেই কষ্টের তীব্রতা আরো ভারী হয়ে এলো। মনে পড়ল তাদের সঙ্গে জড়ানো নানা স্মৃতি। বুকফাটা প্রচন্ড কষ্ট আর যন্ত্রণাটাকে বুকে নিয়ে বিছানায় যেয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। যেন কষ্টের ভারটা একটু কমে। তাতেও কাজ হয়নি। কষ্ট বরং আরো তীব্রভাবে এসে আক্রমনাত্মক আমাকে ঝেঁকে ধরল। এভাবেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। বিকেলবেলা রুমে এসে নুডুল্স, চা বানিয়ে খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। ঈদের দিন কোথাও যাওয়া হয়নি।
সত্যি বলতে ঈদের দিনটি প্রবাসীদের জন্য তেমন কোন আকাঙ্খিত দিন নয়, যদিও ব্যক্তি বিশেষের কাছে এর ব্যতিক্রম অবাস্তব কিছু নয়। ঈদের দিনের জন্য এখানে মানুষ ব্যতিব্যস্ত থাকে না, থাকেনা গরু-ছাগল কিনায় ব্যাস্ত, চারিদিকে সাজ সাজ রব বা আনন্দের যে ছাপ দেশের মাটিতে থাকে তা প্রবাসে একেবারে ¤্রীয়মান। কাতার এসেছি প্রায় ১৯ বছর। এবারও ছুটি কাটিয়ে দেশ থেকে কাতার এসেছি দুবছর হতে চললো। বেশ কয়েকটা ঈদও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। তবুও এ প্রবাসের ঈদে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি।
বিশেষ করে এবার প্রবাসে আসার পর তৃতীয় সন্তান তাহসান দুনিয়ার এলো দেখে, কিন্তু তার জন্মদাতা পিতাকে এখনো সে দেখেনি। ইমুতে ভিডিও কল করলে শুধু বলে কী? কী? হয়তো এটাই বুঝাতে চাচ্ছে যে তুমি কেমন পিতা তোমার মায়া দয়া নেই বুঝি? আমাকে তোমার বুকে নিতে ইচ্ছে নেই বুঝি? মেজ ছেলে ইকরাম তো শুক্রবার আসলে বলে আগামীকাল শুক্রবার, আমাদের স্কুল বন্ধ তোমার বন্ধ নেই? তুমি আসতে পারনা? বড়ছেলে তালহা বলে আব্বু তুমি বলেছিলে রোজার ঈদে আসবে আসোনি, কোরবানির ঈদে কেন আসোনি? সন্তানদের এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে খুঁজতে মনটা আরো খুব ছটপট করছিল। বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবছিলাম। ভাবতে গিয়ে এক প্রকার উপায় খুঁজে পেলাম। ভাবলাম একটা মনটাকে একটু সতেজ করে তুলতে ভ্রমণের চেয়ে ভালো ঔষধ আর হতে পারে না। তবে এই ভ্রমণে যেতে চায় শুধু রোমাঞ্চপ্রিয় কিছু মানুষ, যাদেরকে প্রকৃতি টানে চুম্বকের মত, দুর্গমকে পাড়ি দেওয়ার নেশা কেড়ে নেয় যাদের রাতের ঘুম। তারা ছুটতে থাকেন একের পর এক নতুন নতুন স্থানে। তাই নিজের ভাবনাকে শেয়ার করতে ছুটে যাই পাশের রুমের কলিগদের কাছে। সেখানে উপস্থিত হতেই তারাও সবাই মিলে অফার করলো চলেন কোথাও ভ্রমণ করে আসি। আমি মহা আনন্দিত কণ্ঠে বললাম, আমিও এই প্রস্তাব নিয়েই এসেছি। একথা শোনার সাথে সাথে সাঈদুল, জাকির, খাইরুল ইসলাম, সামসু তাদের চোখেমুখে পূর্ণিমার চাঁদের হাসি দেখতে পেলাম। ভ্রমণের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হল দোখান রিসোর্ট।
যেই কথা সেই কাজ, ঈদের পরেরদিন দুপুরের খানিক পরে পাঁচজনের টীম নিয়ে ছুটে চললাম কোম্পানির মিনিবাস (মাইক্রো) নিয়ে আল-খোর থেকে দোখান রিসোর্ট। পথিমধ্যে বড়ো একটা জামিয়া (শপিং মল) দেখে সেখানে গাড়িটি পার্কিং করে কিছু ঠান্ডা পানির বোতল চিপস, ফ্রুট, জুস, চকলেট নিয়ে আবার চললাম। ভ্রমণে যাচ্ছি মনের গহীনে আনন্দের জোয়ার বইছে। গাড়ি চলছে উত্তর থেকে দক্ষিণে সূর্যি মামার উত্তাপ তখন প্রচণ্ড। আমাদের দেশের তপ্ত রোদ্দুরের বাতাসে ঘুম পাড়ায় আর মরুভূমির বাতাসে ঘুম তাড়ায়, তবুও উচ্ছ্বাসিত মন নিয়ে আমাদের গাড়ি বিশাল মরু পথ ধরে চলছে। যতদূর দৃষ্টি যায় পিচঢালা পথটা এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে মরুভূমি ভেদ করে। ভর দুপুরে আমরা চলছি তো চলছিই। রাজ্যের ক্লান্তি চোখে। ঝাপটা দিয়ে বাতাস যেন জাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। আনমনা হই। মরুপথে নেই সবুজ গাছগাছালি, নেই পাখিদের কলরব, নেই রাস্তার দুইদিকে ফুলের সুভাষ। দু’চোখে দেখছিলাম চারদিকজুড়ে বিশাল আকাশ আর ধুধু মরুভূমি।
প্রায় অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর জাকির সাব প্রস্তাব করল রিসোর্ট’র সাথে একটা পার্ক আছে দেখার মত। আমারা যদি সেই পার্কে যাই মন জুড়িয়ে যাবে। তার প্রস্তাবে সবাই একমত হল, বীচে যাওয়ার প্রথমে পার্ক ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত ঠিক করা হলো। প্রস্তাবের ঘণ্টাখানিক পথ পেরিয়ে পার্কের গেটে উপস্থিত হলাম। ভেতরে প্রবেশ করার আগেই বাইরের দৃশ্য দেখে আমি চমকিত হলাম, মুগ্ধ হলাম। মরুর বুকে এত রূপবিলাসী জায়গা এর আগে কাতারে কখনো দেখা হয়নি। পার্কটির সাথেই দেখার মত একটি ওভারব্রীজ, ওভারব্রীজের চারপাশে কাশফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে কাতার সরকার, এ যেন চিরচেনা আমার সেই মাতৃভূমি সোনার বাংলাদেশ। তারপর সবাই একটা করে খাওয়ার পানির বোতল আর চিপস হাতে নিয়ে পার্কে প্রবেশ করলাম। খুব গরম লাগছিল। সূর্যটা মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে। তীব্র রোদে ঘাম ঝরে পড়ছে কপাল বেয়ে। ভেতরে প্রবেশ করে তো আমরা আনন্দে আত্মহারা। মনে হলো নববধুর জন্য একটা পালকি সাজিয়ে রাখা। আমরা হলাম তার বর যাত্রী! চিত্ত বিনোদনের জন্য, সুইমিংপুল, বাচ্চাদের খেলার সামগ্রী বড়দের জন্যে খেলাধুলা বসার সুব্যবস্থা, ফুলের মৌ মৌ গন্ধ। বিশেষ করে সবুজের সমারোহ। কোথাও শুকনো, কোথাও আর্দ্র, কোথায় সেঁতসেঁতে, কোথাও কাদার কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টি করে গাছ পালনের দৃশ্য আমার মত পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে । এক কথায় প্রকৃতি দিয়ে চারদিক সাজিয়ে রেখেছে। প্রকৃতিপ্রেমী যে কোন মানুষের মন কেড়ে নেবে। উদ্ভিদের সাথে আমার কথা বলতে ভালো লাগে! আমি যেন তাদের মনের কথা বুঝতে পারি। তাদের আপন করে নিতে তৃপ্তি লাগে।
এ আনন্দের ভ্রমণ কার না ভালো লাগে! নিশ্চয়ই ভালো লাগে সবার। এক্ষেত্রে নেতিবাচক জবাব দেয়ার মতো কেউ থাকার কথা না। কারণ ভ্রমণের মজাটাই আলাদা। বন্ধুদের সঙ্গে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানোর মাঝে কী যে মজা, যে কোন দিন ঘুরে বেড়ায়নি তার পক্ষে বুঝে ওঠা কখনই সম্ভব না । যে চোখ তা কোন দিন পর্যবেক্ষণ করেনি তার পক্ষে শান্তনা-প্রশান্তির নীড় খুঁজে পাওয়া কোনভাবেই সম্ভব না। এ যেন এক হারানো মানিক খুঁজে পাওয়া। আমরা যারা প্রবাসী তাদের জীবনে এ ভ্রমণের গুরুত্ব আরো অনেকগুন বেশি। একই সাথে এটি সারা জীবনের জন্য একটি স্মৃতির স্মারকও বটে। ভ্রমণের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে আল কুরআন বলছে: ‘বল, তোমরা যমীনে ভ্রমণ কর। অত:পর দেখ পূর্ববর্তীদের পরিণাম কিরূপ হয়েছিল’। তাদের অধিকাংশই ছিল মুশরিক। (সূরা: আর-রূম, আয়াত- ৪২)‘বল, তোমরা যমীনে ভ্রমণ কর তারপর দেখ, অস্বীকারকারীদের পরিণাম কেমন হয়েছে।’ (সূরা: আল্ আনআম, আয়াত-১১)
তারপর সবাই দুই-তিনজন করে আলাদাভাবে ভাগ হয়ে এদিক-ওদিক হয়ে গেলাম। ভাগেভাগে সারা পার্ক ঘুরে বেড়ানোর মাঝেমাঝে সবুজের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে সবাই একসাথে অনেক ফটো তুললাম। নয়ন ভরে উপভোগ করেছি তার স্নিগ্ধতা! পার্কের ভেতর সবাই আনন্দে উল্লাসে ঘুরতে ঘুরতে বহুসময় পার করে দিলাম। একটা কথা না বললেই নয়! কাতারে অনেক পার্ক ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে কোথাও কোন ছেলেমেয়েদেরকে আমাদের দেশের পার্কগুলোর মত নোংরা অবস্থায় দেখিনি। এখানে সবাই মা’বাবা, ছেলে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে এসে কোনোরকম লজ্জিত হতে হয় না। কিন্তু আমাদের দেশের পার্কগুলোতে সেই পরিবেশ নেই। কেনো সেই পরিবেশ নেই? এর জবাব কে দেবে? অথচ মানুষের মনকে সতেজ করে তুলতে পার্ক বা সমুদ্র সৈকতের চেয়ে ভালো ঔষধ আর হতে পারেনা। এবার আমাদের ভালোবাসার পার্ক ছড়ে চলে যেতে হল দোখান রিসোর্ট বীচ। যদিও মন চাচ্ছিল না, আমাদের হাতে সময় কম থাকায় চলে যেতে হবে।
এবার আমারা গাড়ি নিয়ে ছুটলাম বীচ এর উদ্দেশ্যে। কয়েক মিনিটে পৌঁছে গেলাম। বীচে গিয়ে সাগরের নোনাপানিতে গোসল করবো বলে আমরা রুম থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। আমরা সবাই ট্রাউজার জার্সি পরে এসেছি। ব্যাগে করে নিয়ে এসেছি পায়জামা পাঞ্জাবী, ঈদ বলে কথা! একজন ছাড়া সবাই এক এক করে নেমে পড়লাম সাগরের নোনাপানিতে। প্রায় এক ঘণ্টা ইচ্ছেমতো সাগরে সাঁতার কাটলাম। সাথে একটা ভলিবল নিয়েছিলাম। সবাই পানিতে ভলিবল খেললাম, সেখানেও ছবির হিড়িক। সবাই খুব আনন্দ করলাম। তারপর একেক করে উঠে এসে কাপড় পাল্টিয়ে গাড়িতে চেপে বসলাম। এদিকে পেটের ক্ষুধায় পেটে চু চু করছে। যা নিয়েছিলাম সব আগেই খেয়ে শেষ। যা বুঝলাম, পানিতে সাঁতার কাটায় পেটের ক্ষুধা দ্বিগুণ বেড়েছিল।
আমরা যখন গাড়িতে বসে ক্ষুধার আলোচনা করছিলাম, জাকির সাব বলল, আমার এখানে চলুন। আমাকে সেখানে নামিয়ে দিবেন আর খাওয়াও হবে। জাকির সাব হলেন আমার কলিগ খাইরুলের বড়ভাই। সে দোখানে থাকেন, ঈদ উপলক্ষে ছোটভাইয়ের কাছে গিয়েছিল। এবার আমরা সেখানে গেলাম। গিয়ে চিকেন বারবিকিউ, রুটি আর কোল্ড ড্রিংক্স সবাই গলা পর্যন্ত খেলাম। এক কথায়, যেমন ক্ষুধা লেগেছিল তেমনই খেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। তারপর সবাই এক এক কাপ সুস্বাদু চা হাতে নিয়ে জাকির সাহেবের নিকট হতে রওনা দিলাম গন্তব্যে। আল্লাহর রহমতে সবাই সুস্থভাবে আবার যার যার রুমে ফিরে এলাম। তারই মাঝে আপনজনের কাছ থেকে দূরে থাকা হৃদয়ের ব্যথা, প্রবাসের একাকীত্ব সাগরের ঢেউয়ের সাথে জীবনের ক্লান্তি ভুলে থাকার প্রয়াস খুঁজে পেয়েছি ।