মো: মোস্তফা কামাল মিন্টু
ওমানের সুলতান ইতিমধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বছর রাজত্ব করার ইতিহাস রচনা করেছেন। সুলতান কাবুস বিন সাঈদ সেই ১৯৭০ সাল থেকে এখনো ওমানের ক্ষমতায় রয়েছেন। ওমান এমন একটি পরম রাজতন্ত্র দেশ যেখানে সুলতানের কথাই শেষ এবং তার কথা মানতে জনগণ বাধ্য। কয়েকবছর আগে আরব বসন্তের ঢেউ দেশটিতে পড়লেও সুলতান কাবুস অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেগুলো মোকাবেলা করেছেন। রাজতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনা করলেও দেশের জনগণের নাগরিক অধিকারের বিষয়ে তিনি যথেষ্ট সচেতন। বৈশি^ক পররাষ্ট্রনীতিতেও ওমানের সুলতান নিরপেক্ষ ভূমিকা রেখে সবার সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে চলেন। প্রবাস মেলা’র এবারের সংখ্যার ফ্যাক্ট এবাউটে ওমানের সুলতান কাবুস বিন সাঈদ এর আদ্যোপান্ত নিয়ে আমাদের আয়োজন।
জন্ম ও পড়াশোনা
সুলতান কাবুস বিন সাঈদ ১৯৪০ সালের ১৮ নভেম্বর সালালাহ্ এর জুফারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সুলতান সাইদ বিন তাইমুর ও শাইখা মাজনুন আল মাশানির একমাত্র পুত্র। সুলতান কাবুস সালালাহ্ ও ভারতের পুনেতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেছেন। পুনেতে তিনি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মার ছাত্র ছিলেন। ১৬ বছর বয়সে তিনি ইংল্যান্ডে পড়াশোনার জন্য যান। ২০ বছর বয়সে তিনি রয়েল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্স্টে যোগ দেন। স্যান্ডহার্স্টে থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেয়ার পর তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাকে ১ম ব্যাটেলিয়ন ক্যামেরনিয়ান্স (স্কটিশ রাইফেল)-এ নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি জার্মানিতে একবছর দায়িত্ব পালন করেছেন। সামরিক দায়িত্ব পালনের পর কাবুস সালালাহ্ তে ফিরে আসার পর ইসলাম এবং দেশের ইতিহাসে উপর পড়াশোনা করেছেন।
ওমানের ক্ষমতায় কাবুস
সফল এক অভ্যুত্থানে ওমানের সুলতান কাবুস বিন সাঈদ আল সাঈদ তার পিতার ক্ষমতাচ্যুতির পর ১৯৭০ সালের ২৩ জুলাই ওমানের ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতায় এসেই তিনি ঘোষণা করেন যে, রাষ্ট্রকে আর মাস্কাট ও ওমান নামে ডাকা হবে না। রাষ্ট্রীয় একতার জন্য এর পরিবর্তে রাষ্ট্রের নাম ওমান সালতানাত রাখেন তিনি।
আন্তর্জাতিক নীতি
সুলতান কাবুস সরকারিভাবে ওমানের নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখেন। ইরানের সঙ্গে তার স্বাভাবিক সম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ওমানের মিত্রতা অনেকদিনের। পারস্য উপসাগরের আরব রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ওমানের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে ওমান ইরান ও পাশ্চাত্যের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখে। এর ফলে ওমান যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছে। যা বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে ওমানের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে।
দীর্ঘ রাজত্বকাল
আরব শাসকদের মধ্যে ওমানের সুলতান কাবুস বিন সাঈদ আল সাঈদ ব্যতিক্রমই বটে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য যে কোনো রাজার চেয়ে বেশি দিন রাজত্ব করছেন তিনি। তার রাজত্বের ৪৯ বছর চলছে। মরুভূমির দেশ ওমানকে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এতবছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে শাসন করে আসছেন।
নারী প্রগতি
ওমানের সুলতান কাবুস নারী প্রগতিতে উৎসাহী। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর মতো ওমানের সুলতান তাদের মেয়েদের ঘরে বন্দী করে রাখার পক্ষপাতী নন। ওমানের মহিলারা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা ও পড়াশোনা করতে পারেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে সুলতান কাবুস বিশ্ববিদ্যালয়ে পরুষ ছাত্রদের জন্য কোটা রেখেছেন। কেননা স্কুল-কলেজে মেয়েরাই সাধারণত ভালো ফলাফল করে থাকে। ফলে ছেলেরাই উল্টো পিছিয়ে পড়ছে। কর্মক্ষেত্রেও ছেলেদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেয়েরাও একসঙ্গে কাজ করে আসছে। তথ্যপ্রযুক্তিতেও ওমানের মেয়েরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই এগিয়ে। তাদের রয়েছে নানা উদ্ভাবনী ক্ষমতা।
ওমানের দ্রুত বিকাশ
সুলতান কাবুস ওমানকে আধুনিকতার দিকে নিয়ে গেছেন দ্রুত গতিতে। ৪৮ বছর আগে ওমান ছিল আরব বিশ্বের সবচেয়ে পেছনে পড়ে থাকা দেশগুলোর একটি। অন্যদিকে বিশ্বের যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি প্রগতি করেছে ওমান সেই তালিকার শীর্ষে বলে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। ওমানে বহু বিদেশি কাজ করেন। মূলত ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইরান থেকে আসা বিদেশি কর্মীরাই মোট জনসংখ্যার অর্ধেক। ওমানিদে শিক্ষার হার প্রায় ৯১ শতাংশ।
শিয়া সুন্নি বিরোধ
ওমানে অধিকাংশই ইবাদি মুসলমান। ইবাদিরা নিজেদের সুন্নি বা শিয়াদের কোন অংশই মনে করেন না। যার ফলে সুলতান কাবুস ওমানকে উপসাগরীয় অন্যান্য দেশের মত যাবতীয় শিয়া-সুন্নি বিরোধ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন।
শিক্ষা-সংস্কৃতিতে উন্নতি
১৯৭০ সালের আগে ওমানে ৩টি স্কুল এবং তাতে ১ হাজারের মতো ছাত্র ছিল। বর্তমান সুলতানের সময় থেকে শিক্ষার বিস্তার ব্যাপক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন প্রতি বছর হাজার হাজার তরুণ-তরুণী ওমানি বেরুচ্ছেন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাদের অধিকাংশই সরকারি চাকরি করেন। সেখানকার সরকারি চাকরিতে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি।
ওমানের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ‘সুলতান কাবুস বিশ্ববিদ্যালয়’ ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজি ভাষা ওমানে সবচেয়ে বেশি শেখানো বিদেশি ভাষা। মাধ্যমিক স্তরের পরবর্তী সব লেখাপড়া ইংরেজিতেই হয়। ওমানের বেতার সংস্থার ইংরেজি চ্যানেল আছে। এ ছাড়াও দেশে অনেক ইংরেজি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। আরবি ছাড়াও ওমানের দক্ষিণাংশে অনেক আধুনিক দক্ষিণী আরবি ভাষা প্রচলিত। এর মধ্যে আছে জিবালি, মেহরি, হার্সুসি এবং হবিয়ত ভাষা। এসব ভাষায় রচিত নানা রকম সাহিত্যকর্ম রয়েছে যা বেশ সমৃদ্ধ।
সুলতানের রাজতন্ত্র
ওমানের রাজনীতি একটি পরম রাজতন্ত্রের কাঠামোতে পরিচালিত হয়। ওমানের সুলতান হলেন একাধারে রাষ্ট্রের প্রধান ও সরকার প্রধান। ওমানের সুলতানরা বংশানুক্রমে ক্ষমতায় আসেন। বর্তমানে কাবুস সাঈদ আল সাঈদ দেশটির সুলতান এবং তাকে সহায়তা করার জন্য একটি মন্ত্রিসভা আছে।
২০০০ সালের অক্টোবরে প্রায় ২ লাখ ওমানি প্রথমবারের মতো আইনসভার সদস্যদের নির্বাচিত করেন। মোট ৮৩ জন সদস্য নির্বাচিত হন এবং এদের মধ্যে পাঁচজন মহিলা সদস্যও ছিলেন।ওমানে ক্ষমতার পৃথকীকরণের ব্যবস্থা নেই। সব ক্ষমতা সুলতানের হাতে রয়েছে। সুলতান সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান। এ ছাড়াও তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালের মৌলিক আইনসহ সব আইন ১৯৭০ সাল থেকে রাজকীয় ফরমানের মাধ্যমে প্রচলিত হয়ে আসছে। সুলতান বিচারকদের নিয়োগ করেন এবং সাজা রহিত বা হ্রাস করতে পারেন।
অশান্তির দানা
মধ্যপ্রাচ্যের আরব বসন্তের হাওয়া ওমানেও মাথাচাড়া দিয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে আর জীবনযাত্রার উন্নতির দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন। কিন্তু ওমানের সুলতান কাবুস বিন সাঈদ আল সাঈদ চমৎকার দক্ষতার সঙ্গে বিক্ষোভ সামাল দেন। সরকার বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর বিক্ষোভ থামে। ওমানের সুলতান ৫০ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের আদেশ দেন।
সুলতানের উত্তরাধিকারী প্রশ্নে
বহু বছর ক্ষমতায় থাকার পরও ওমানের সুলতান কাবুস বিন আল সাঈদ ঠিক আগের মতোই জনপ্রিয়। তবে ৭৯ বছর বয়সী সুলতানের উত্তরাধিকারী নিয়ে চিন্তা ওমানের জনগণের মনে উঁকিঝুঁকি মারছে। ওমানের সুলতান কাবুস সন্তানহীন হওয়ায় তারপর কে সুলতান হবেন তা নিয়ে সবাই পুরোপুরি অজ্ঞাত। ওমানের সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুলতানের পদ খালি হওয়ার তিন দিনের মধ্যে রাজপরিবারকে নতুন সুলতান নির্বাচন করতে হবে। কে হবে সেই নতুন সুলতান যা নিয়ে ওমানসহ বিশ্বের অগণিত মানুষের কৌতূহল রয়েছে।