ডা. মুশফিকুল আলম পাশা
থ্যালাসেমিয়া (Thalassemia) রক্তের একটি রোগ যা সাধারণত বংশগতভাবে ছড়ায়। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতি কম থাকে। থ্যালাসেমিয়া মৃদু এবং তীব্র দু’রকমের হতে পারে। এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে, ভালোভাবে চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণও হতে পারে। প্রতিবছর পৃথিবীতে প্রায় ১ লক্ষ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেনস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া রোগে ভুগে থাকেন। মৃদু থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় চিকিৎসার তেমন প্রয়োজন হয় না। অপরদিকে তীব্র থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগীকে নিয়মিত রক্ত দিতে হয়।
থ্যালাসেমিয়া কেন হয়?
থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ। সাধারণত ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জীনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। বাবা এবং মা উভয়ের অথবা বাবা অথবা মা যেকোনো একজনের থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়াতে পারে। বাবা এবং মা উভয়ের থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে সেক্ষেত্রে শিশুর থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ২৫ ভাগ।
থ্যালাসেমিয়ার প্রকারভেদ
থ্যালসেমিয়া প্রধানত দুই ধরণের হয়ে থাকে। যথা- আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া।
থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ
থ্যালাসেমিয়া রোগের ধরণ এবং এর তীব্রতার উপর ভিত্তি করে এর উপসর্গগুলোও ভিন্ন হতে পারে। তবে থ্যালাসেমিয়া হলে সাধারণত কিছু লক্ষণ দেখে অনুমান করা যায়। যেমন- অবসাদ বা অস্বস্তি অনুভব, শারীরিক দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, মুখ-মন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, মুখের হাড়ের বিকৃতি, শারীরিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া, পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া বা পেট ফুলে যাওয়া, গাঢ় রঙের প্রস্রাব, অতিরিক্ত আয়রন, সংক্রমণ, অস্বাভাবিক অস্থি, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, হৃৎপিন্ডে সমস্যা, ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া বা জন্ডিস ইত্যাদি লক্ষণ বা উপসর্গগুলো দেখা যায়।
থ্যালাসেমিয়া হলে শিশুর শরীরে কী ঘটে
মানুষের রক্তের লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল তিন মাস। লোহিত রক্ত কণিকা অস্থিমজ্জায় অনবরত তৈরি হচ্ছে এবং তিন মাস শেষ হলেই প্লীহা এ লোহিত কণিকাকে রক্ত থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল অনেক কমে যায়। তাদের হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি না হওয়ায় লোহিত কণিকাগুলো সহজেই ভেঙে যায় এবং অস্থিমজ্জার পক্ষে একই হারে লোহিত কণিকা তৈরি সম্ভব হয়ে ওঠে না। এতে একদিকে যেমন রক্তশূন্যতা সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে প্লীহা আয়তনে বড় হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত আয়রন জমা হয়ে হার্ট, প্যানক্রিয়াস, লিভার, অন্ডকোষ ইত্যাদি অঙ্গের কার্যক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। বার বার রক্ত পরিবর্তনের কারণে থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের রক্তবাহিত বিভিন্ন রোগ যেমন-হেপাটাইটিস হতে পারে, অস্থিমজ্জা প্রসারিত হয়ে যায় এবং এতে হাড় পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। এতে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
থ্যালাসেমিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে যারা
যাদের শরীরে থ্যালাসেমিয়া রোগের জীন আছে, কিন্তু রোগের কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না তাদের থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক বলা হয়। এরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। তবে এরা এদের সন্তানদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া রোগের বিস্তার ঘটায়। পিতা-মাতা উভয়েই বাহক হলে থ্যালাসেমিয়া শিশুর জন্ম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যে কেউ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হতে পারে। কাজেই বিয়ের আগে সবারই জেনে নেওয়া দরকার, তিনি থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কি-না।
থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক জানার জন্য যা করবেন
রক্তের বিশেষ ধরনের পরীক্ষা হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস দিয়ে আমরা এই রোগ নির্ণয় করতে পারি।
গর্ভস্থ সন্তানের থ্যালাসেমিয়া জানার জন্য যে পরীক্ষাগুলো করতে হবে
কোরিওনিক ভিলিয়াস স্যাম্পলিং (Chorionic villus sampling)
অ্যামনিওসেনটিসিস (Amniocentesis)
ফিটাল ব্লাড স্যাম্পলিং (Fetal blood sampling)
থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা
মাইনর থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত চিকিৎসার কোন প্রয়োজন হয় না। অপরদিকে অধিকাংশ থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে নিয়মিত রক্ত গ্রহণ (প্রয়োজনবোধে বছরে ৮ থেকে ১০ বার) করতে হয়। বার বার রক্ত নেওয়ার ফলে বিভিন্ন অঙ্গে অতিরিক্ত লৌহ জমে যেতে পারে এবং এর ফলে যকৃত বিকল হয়ে যেতে পারে। তাই, এরকম ক্ষেত্রে জটিলতা এড়াতে আয়রন চিলেশন থেরাপীর সাহায্যে অতিরিক্ত লৌহ বের করে দেওয়া হয়।
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগ হতে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে একজন ম্যাচ ডোনার লাগবে। আমাদের দেশে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা না থাকায়, এই অপারেশন দেশের বাইরে গিয়ে করতে হয়। এছাড়াও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন এবং ফলিক এসিড সেবন করতে হতে পারে। আবার জীবনযাপন পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন- চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিত কোন ঔষধ বা ভিটামিন সেবন না করা, সুষম ও পুষ্টিকর খাবার বিশেষ করে ক্যালসিয়াম, জিংক, ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে ইত্যাদি।
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে করণীয়
পরিবারের কারও থ্যালাসেমিয়া রোগের ইতিহাস থাকলে সন্তান গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র এবং পাত্রীর রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে হবে তাদের মধ্যে কেউ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত কিনা। আবার নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই, এ ব্যপারে সাবধান হতে হবে।
থ্যালাসেমিয়া পরবর্তী জটিলতা
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের বার বার রক্ত পরিবর্তনের ফলে রক্তবাহিত বিভিন্ন রোগ বিশেষ করে হেপাটাইটিসের সংক্রমণের সম্ভবনা বেড়ে যায়। আবার বার বার রক্ত পরিবর্তনের ফলে রক্তে আয়রণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং তা হৃৎপিন্ড, যকৃত এবং এন্ডোক্রাইন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ করে। অস্থিমজ্জা প্রসারিত হয়ে হাড় পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে যেতে পারে। ফলে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা থাকে। আবার থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর প্লীহা বড় হয়ে যায়।
শিশুর থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়
থ্যালাসেমিয়া মেজর অর্থাৎ যে শিশু বাবা এবং মা উভয়ের কাছ থেকেই সমস্যাগ্রস্ত জীন জন্মগতভাবে পেয়েছে, জন্মের পরপরই শিশুটিকে ফ্যাকাসে দেখা যাবে। শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবে হবে না অর্থাৎ তার হাঁটা, দাঁড়ানো বা বসা সবকিছুই অন্য বাচ্চাদের তুলনায় অনেক ধীরে হবে। ১০ বছরের একটা স্বাভাবিক বাচ্চার তুলনায় একটা অসুস্থ্য বাচ্চা দেখতে ৫ বছরের মত লাগবে। শিশুটির রক্তস্বল্পতা, ক্ষুধামন্দা, সব বিষয়ে অনাগ্রহ ইত্যাদি দেখা যাবে। আবার দুই চোখের দূরত্বটা বেড়ে যেতে পারে, নাকের গোড়া প্রসারিত হয়ে যেতে পারে, কপালের সামনের হাড় ফুলে উঠতে পারে, দাঁত ফাঁক হয়ে যেতে পারে, পেট ফুলে উঠতে পারে, হাত পা ও চোখ হলুদ দেখা যেতে পারে ইত্যাদি অর্থাৎ শিশুটিকে দেখে স্বাভাবিক মনে হবে না। আবার পরীক্ষা করলে তার প্লীহা দেখা যাবে। এই প্লীহা প্রথমে বড় হয়, এর পর আস্তে আস্তে লিভার বড় হয়। এই অঙ্গগুলো বড় হলে, তখন খুব ঘন ঘন রক্ত দিতে হয়। নিয়মিত রক্ত না দিলে শিশুটি স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারে না। যেহেতু থ্যালাসেমিয়ার তেমন চিকিৎসা আমাদের দেশে নেই, তাই এ রোগ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গর্ভস্থ শিশুর থ্যালাসেমিয়া আছে কি-না তাও পরীক্ষা করে দেখা উচিত। শিশু গর্ভে আসার চার মাস পর থেকে থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা তা নির্ণয় করা সম্ভব।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৪.৮ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৭০ লাখ মানুষ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত এবং সারা পৃথিবীতে প্রায় এক বিলিয়ন থ্যালাসেমিয়া রোগী আছে। প্রতিবছর আরও প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন।