রফিক আহমদ খান, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া
আহারে বিদেশ কত সুন্দর, সেখানে কতো সুখ, আর কাড়ি কাড়ি টাকা। পাশের বাড়ির ‘ছলিম’ কী সুন্দর দালান করেছে বিদেশের টাকা দিয়ে। তাদের পরিবারে কোনো অভাব নেই। জমিজমাও কিনতেছে তারা। তাদের বউ বাচ্চারা বিদেশি দামি দামি ভালো জিনিস ব্যবহার করে। শীতের দিনে বিদেশি কম্বল গায়ে দেওয়া যায়। বিদেশ গেলে চেহারাও ফর্সা হয়। টাকা পয়সার আয়ের পাশাপাশি ভালো ভালো খাবার ও সুন্দর সুন্দর কাপড় পরা যায় বিদেশে। শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকে। চমৎকার সব জায়গায় গিয়ে সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা যায়। দেশে বেড়াতে গেলে নতুন নতুন কাপড় পরে ঘোরা যায়। টাকা পয়সা খরচ করে মহাধুমধামে বিয়ে করা যায়। ছোট বোন থাকলে বিয়ে দেওয়া যায়।
মনে এরকম বহু রঙিন স্বপ্ন নিয়ে আমরা বিদেশে আসি। বুকভরা আশা নিয়ে স্বপ্নের বিদেশে এসে কিছুদিন যেতে না যেতেই প্রথমে আমরা যে কথাটা মনে মনে হলেও উচ্চারণ করি সেটা হলো, ‘বিদেশ এ রকম জানলে জীবনেও আসতাম না। দেশে এতো কষ্ট করলে অনেক ভালো হত।’ আরো বলি, ‘কষ্ট করে কয়েকটা বছর এই দেশে (প্রবাসে) থেকে বিদেশ আসার খরচগুলো তুলে আর বাড়তি কিছু টাকা হাতে করেই দেশে চলে যাব।’
‘দরকার নেই এ রকম দেশে এত কষ্ট করে বেশি দিন থাকার। এর চেয়ে দেশেই ভালো দেশে ফিরে গিয়ে আর কোনো অবহেলা নয়, আর কোনো ভুল নয়, বন্ধুদের সাথে অযথা আড্ডাও নয়, কঠোর পরিশ্রম করব। নিজ দেশেই পরিশ্রম করে বড় হব।’
কষ্ট করে কয়েক বছর থেকে দেশে ফিরে যাব- এই ধারণা মনে পোষণ করে চলে প্রবাস জীবনের প্রথম দিকের সংগ্রামের দিনগুলো। নতুন নতুন বিদেশ আসলে যে কারোরই কষ্ট লাগে। সেটা যে দেশেই হোক। আসলে সে কষ্ট শুধু কঠোর কাজের কষ্ট না। এখানে প্রিয় স্বদেশ ছেড়ে আসার কষ্ট, পরিবার-বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন ছেড়ে আসার কষ্ট, নতুন দেশে নিজেকে সহজে খাপ খাওয়াতে না পারার কষ্ট সহ বহু কষ্ট ঘিরে থাকে চারিদিকে। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন সাথে না থাকলে সে কষ্ট আরো বাড়ে। সে কষ্টে প্রবাস জীবন শুরু করে দিনগুলো যেতে চায় না যেনো। সময়গুলো অনেক লম্বা মনে হয়। সামনে দুই-তিন বছর সময়গুলো ভাবলেই মনে অজানা ভয় ভর করে। কেমনে কাটাবো সময়গুলো। মানুষের অগোচরে কান্না, কখনো কখনো আবার মানুষের সামনেই কান্না।
যে বুকে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ আসা সেই বুকে কষ্ট ধারণ করে অশ্রুভেজা চোখে হাজারো চিন্তা মাথায় বহন করে কাজ করতে করতে দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, বছর যায়। একদিনকে দশদিনের সমান লম্বা মনে হলেও কোন ফাঁকে কি জানি সময় ঠিকই সময় পার হয়ে যায়।
এক সময় কমতে থাকে কষ্ট অনুভূতি। সময়ের ব্যবধানে হৃদয়ে সয়ে যায় সেই সব কষ্ট। কয়েক বছর যেতে না-যেতে অনেকেই মোটামুটি আয়-রোজগারে আগের চেয়ে উন্নতি করে, কর্মস্থলে পজিশন ভালো হয়। এসবের পেছনে অবশ্যই বাংলাদেশি তরুণদের কঠোর শ্রম ও হৃদয়ে লালন করা নিজেকে বড় করার স্বপ্ন সহায়তা করে। বড় হওয়ার স্বপ্ন, জয়ী হওয়ার স্বপ্নে বাংলাদেশিরা সব সময় প্রবাসে কঠোর পরিশ্রম করে। দেশে- বাড়িতে যে সব কাজকে ছোট মনে হয়েছিলো, সে সব কাজও নির্দ্বিধায় করে এক সময়। আট ঘন্টার জায়গায় দশ ঘন্টা বারো ঘন্টা এমনকি চৌদ্দ পনেরো ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করে বাংলাদেশি তরুণেরা।
এভাবে ত্যাগ, ধৈর্য্য আর কঠোর পরিশ্রম-ই সফলতা এনে দেয় প্রবাসীর জীবনে। সেই পথচলায় প্রবাসেই কাটিয়ে দেয় ছোট্ট এই জীবনের মহামূল্যবান টগবগে তারুণ্যময় সময়টুকু।