মো: বাছের আলী
তুরস্ক পূর্ব ইউরোপের একটি দেশ। এশিয়া ও ইউরোপের মাঝামাঝি স্থানে দেশটি অবস্থিত যা একসময় অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। তুরস্কের প্রায় পুরোটাই এশীয় অংশ আনাতোলিয়া তথা এশিয়া মাইনর উপদ্বীপে পড়েছে। বাকি অংশ তুর্কীয় থ্রাস তথা ইউরোপের দক্ষিণ পূর্ব অংশে পড়েছে। যেখানে দেশটির সবচেয়ে বড় শহর ইস্তানবুল এর অবস্থান। তুরস্কের জনসংখ্যা প্রায় ৮২ মিলিয়ন। দেশটির ৮০ শতাংশ জনসংখ্যা তুর্কি আর ২০ শতাংশ কুর্দি। মুসলিম জনস্যংখা প্রায় ৯৯.৮ শতাংশ। বাকিগুলো খ্রিস্টান ও জিউস।
তুরস্ক এমন একটি দেশ সেখানকার মানুষ, আবহাওয়া, স্থাপত্য ও শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং এমন কিছু ট্যুরিস্ট স্পট রয়েছে যেগুলো আপনার অভিজ্ঞতায় এক নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। তাই দেশটিতে যাওয়ার আগে সেখানকার করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো জেনে নেয়া জরুরী।
তুরস্কবাসী
তুর্কিরা অত্যন্ত দেশপ্রেমিক। তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের এবং আধুনিক সমাজের সাফল্য নিয়ে খুবই গর্বিত। পরিবার হচ্ছে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ইউনিট। প্রতিটি ব্যক্তি তাদের পরিবারের প্রতি অনুগত এবং নির্ভরশীল। গ্রামীণ জীবন এখনও সেখানে ঐতিহ্য হিসেবেই দেখা হয়। তবে শহরের মহিলারা অধিক পরিমাণে বাইরে কাজ করতে অভ্যস্ত।
আলোচনা ও অভ্যর্থনা
ব্যবসায়িক এবং সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে পুরুষ, মহিলা এমনকি শিশুরাও একে অপরের সাথে হ্যান্ডশেক করে থাকেন। বড়দের সাথে আগে হ্যান্ডশেক করতে হয়। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে আপনার ঘনিষ্ঠ লোকদের সাথে আগে শুভেচ্ছা বিনিময় করুন। সেখানে ইসলামী রীতিতে আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক (‘Asalamu alaykum’) বলেই শুভেচ্ছা বিনিময় করতে হয়। আলোচনা শেষ হলে বিদায় নেয়ার সময়ও তুরস্কে হ্যান্ডশেক করার রীতি রয়েছে। মিটিং এবং পার্টিগুলোতে তুর্কি পুরুষ-মহিলারা একে অপরের চুমু খাওয়া সাধারণ রীতি। এছাড়া যাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তারা একে অপরকে দু’বার চুম্বন করে থাকে। গুনাইদিন (‘Gunaydin’) তথা শুভ সকাল, ইয়াগুলনার (‘iye’ gunler’) তথা শুভ দিন অথবা মেমনুন অলডাম (‘Memnun Oldum’) আপনার সাথে দেখা করে আমি খুব খুশি এ শব্দগুলো তুরস্কে দেখা হলে বলতে হয়।
পোশাক পরিচ্ছেদ
ব্যবসায়িক মিটিংয়ে পুরুষরা বড় জামা (conservative suits) অথবা স্পোর্ট টাই সহ পরতে পারেন। বেশি গরম আবহাওয়ায় পুরুষরা জ্যাকেট না পরলেও চলবে তবে টাই অবশ্যই পরতে হবে। মহিলারাও বড় জামা (suits, dresses and heels) পরতে হবে। ছোট স্কার্ট, ছোটা কাটা ব্লাউজ কখনোই পরা যাবেনা।
উপহার দেয়া নেয়া
অবশ্যই কোন হোস্টকে আপনার বাসায় আমন্ত্রণ জানালে কিছু উপহার দিতে হবে। উপহার না দেয়া সেখানকার ভালো আচরণ হিসেবে দেখা হয় না। উপহার দিলে ভালোভাবে গ্রহণ করতে হবে। উপহার হিসেবে আপনার নিজ দেশ থেকে কিছু নিয়ে আসা সবচেয়ে ভালো হয়। এছাড়াও গোলাপ অথবা মিছরি কার্নেশন (carnations), চকোলেট, ওয়াইন (যদি হোস্ট খেয়ে থাকেন উপহার হিসেবে দিতে পারেন। হোস্ট এর অ্যালকোহল খাওয়ার অভ্যাস আছে কিনা নিশ্চিত না হয়ে এসব জাতীয় উপহার দেয়া ঠিক হবেনা। তুরস্কে অতিথিদের সম্মুখে উপহার খুলে দেখার রীতি নেই। ব্যবসায়িক পার্টনার হলে উপহার পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। তুর্কিরা আমেরিকার তৈরি কিছু উপহার দিলে খুশি হয়, যেগুলো সেখানে খুব ব্যয়বহুল নয়। যেমন, স্ফটনিক (crystal), ডেস্ক আনুষাঙ্গিক, কলম, কোম্পানির লোগো প্রভৃতি।
শারীরিক অঙ্গভঙ্গি
তুর্কিরা সাধারণত বিদেশিদের চেয়ে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতে পছন্দ করে। আপনার পা যেন অন্য ব্যক্তির পায়ের সাথে স্পর্শ না করে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। তুর্কিদের অধিকাংশই ধর্মপ্রাণ মুসলমান, তাই এদের অনেকেই আপনার চোখ এড়িয়ে চলতে পারে। কারো সাথে কথা বলার সময় আই কন্টাক্ট ঠিক রাখতে হবে। তবে অনেক তুর্কি মহিলা সরাসরি আই কন্টাক্ট এড়িয়ে চলতে পারে। সেখানকার বয়স্ক বা উচ্চপদস্থ কারো সাথে কথা বলার সময় পকেটে হাত না রেখে যথাযথ নম্র ও সম্মানের সাথে আচরণ করতে হবে। ও.কে (O.K.) দ্বারা তুরস্কে সমকামী বুঝায়, তাই এই শব্দটিকে সেখানে এড়িয়ে কথা বলতে হবে।
কর্পোরেট সংস্কৃতি
তুর্কিরা ব্যবসায়িক মিটিংয়ে খুব সিরিয়াসলিভাবে নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলে এবং আপনার কাছেও তারা এটা প্রত্যাশা করে। মিটিংয়ে কোন কারণে আপনার দেরি হলে কারণ সহ সেটা ব্যাখা করতে হবে। তুরস্কে সহানুভূতি, নম্রতা, সম্মান এবং ভদ্রতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন অফিসে প্রবেশ করলে সবার সাথে হ্যান্ডশেক করুন। কোন কারখানা পরিদর্শনে গেলে সকল শ্রমিকদের সাথে হ্যান্ডশেক করতে হয়। একইভাবে বের হওয়ার সময়ও সবার সাথে হ্যান্ডশেক করতে হবে। তুর্কিরা ব্যবসায়িক আলোচনার পূর্বে ছোট আলাপন করে থাকে। ব্যবসায়িক কোন সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তারাই নিয়ে থাকে।
খাওয়া দাওয়া ও বিনোদন
তুর্কিরা সন্ধ্যা ৭ টার মধ্যেই ডিনার সেরে পেলে। সুতরাং ডিনারের আমন্ত্রণ পেলে সময়ের প্রতি যত্মবান হতে হবে। ব্যবসায়িক মিটিংয়ের যে কোন সময় খাওয়ার শুরু করতে পারেন। কিছু তুর্কি মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও অ্যালকোহল পান করেন। তবে অধিকাংশ তুর্কিরাই এটা পান করেন না। তুরস্কে কোথাও খাওয়ার আমন্ত্রণ পেলে অবশ্যই খেতে হবে, না খেলে হোস্ট আপনার প্রতি ক্ষুব্ধ হতে পারেন। খাবার গ্রহণ শেষ হলে প্লেটে কোন খাবার রাখবেন না এবং ছুরি এবং ফর্ক পাশে রেখে দিন। ডাচ খাবার তুর্কিরা পছন্দ করেন না। আপনি কাউকে খাবারের আমন্ত্রণ জানালে বিল আপনিই পরিশোধ করুন।
সহায়ক নির্দেশিকা
ইসলাম তুরস্কে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম হলেও দেশটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ইসলামের রীতি অনুযায়ী সেখানকার অধিকাংশ মুসলমানরা দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে থাকেন। শুক্রবার ইসলামে পবিত্র দিন হলেও এই দিনটিতে তুরস্কে সরকারি ছুটি থাকে না (Friday is the Muslim holy day although this is not practised in Turkey)। পবিত্র রমজান মাসে সেখানে দিনের বেলায় যেকোন খাবার, পানীয়, ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। তুর্কিদের কোন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবেন না যেমনটি আমেরিকানরা হরহামেশাই করে থাকে। যেমন, বয়স, বেতন প্রভৃতি ব্যক্তিগত বিষয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
তুরস্কে ভ্রমণে যা কখনো করবেন না
ফরাসীদের মত তুরস্কে কখনো জনসম্মুখে চুমু দিতে যাবেন না। কারো বাসায় গেলে ভিতরে ঢুকার আগে অবশ্যই জুতা খুলে প্রবেশ করতে হবে। ঘরের ভিতরে প্রবেশ করার পর বসার সময় পায়ের হাটু গেঁড়ে বসতে হবে যাতে আপনার পা অন্যের প্রতি কোন নির্দেশ দিচ্ছে না বুঝায়। রমজান মাসে সেখানে দিনের বেলায় যে কোন ধরণের খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। উপরের নির্দেশনাগুলো মেনে চললে আপনার তুরস্ক ভ্রমণ আনন্দদায়ক হবে।