প্রায় চার দশকের মত প্রবাস জীবনে আছেন। এর মধ্যে ১৯৭৯ সাল থেকে থেকে ৮২ পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডে উচ্চ শিক্ষার জন্য ছিলেন। তারপর ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন ওমানে, এরপর সপরিবারে চলে যান কানাডায়। একাধিক ব্যবসার পাশাপাশি প্রবাসী কমিউনিটি ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে তার রয়েছে ব্যাপক সম্পর্ক। বলছিলাম কানাডার টরন্টোতে বসবাস করা মোহাম্মদ সোলায়মানের কথা। সম্প্রতি তিনি দেশে এসেছেন, একফাঁকে ঘুরে গেলেন পাক্ষিক প্রবাস মেলা কার্যালয়। তার সাথে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার প্রবাস জীবনের নানা কথা। সেসবের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হল।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার কৃতি সন্তান মোহাম্মদ সোলায়মান। পিতার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পড়তে হয়েছে তাকে। ১৯৭৪ সালে এসএসসি শেষ করে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৭৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করেন তিনি। এরপর তার দাদার পরামর্শে ওমান সরকারের স্কলারশীপ নিয়ে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান। সালটি ছিল ১৯৭৯।
হঠাৎ কি কারণে বিদেশে পড়াশোনার জন্য মনযোগ দিলেন? জবাবে মোহাম্মদ সোলায়মান জানান, আসলে আমার সেরকম কোন ইচ্ছাই ছিলনা। কিন্তু আমার মরহুম দাদার পরামর্শে বিদেশে স্কলারশীপের জন্য এপ্লাই করলাম। প্রথমে ওমান সরকারের অধীনে সুইজারল্যান্ডে উচ্চ শিক্ষার জন্য আবেদন করি। সেখানে ৩০ টির মত আবেদন জমা পড়ে। এরপর পর্যায়ক্রমে ১২ জন তারপর ৪ জন এবং সর্বশেষ সেখান থেকে চূড়ান্ত প্রার্থী হিসাবে একমাত্র আমিই ওই স্কলারশীপের জন্য নির্বাচিত হলাম।
এক প্রশ্নের জবাবে কৃতি এই প্রবাসী বলেন, জুরিখের স্ট্যানবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ম্যাকানিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশোনা করেন। ১৯৮২ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষে ওমান সরকারের অধীনে ডিরেক্টর রয়্যাল প্রটোকল এন্ড সিকিউরিটি পদে যোগদান করেন।
সেখানে চাকরিরত অবস্থায় লন্ডন থেকে রয়্যাল প্রটোকল এন্ড সিকিউিরিটি এর উপর ৮২-৮৩ সালে ট্রেইনিং নেন। এরপর ১৯৮৩-৮৪ সালে জার্মানি থেকে বুলেট প্রুফ সিকিউরিটি সিস্টেম এর উপর ট্রেইনিং গ্রহণ করেন।
ডিরেক্টর রয়্যাল প্রটোকল এন্ড সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত অবস্থায় অনেকের সাথে তার চমৎকার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একসময় চাকরি ছেড়ে ১৯৮৬ সালে নিজেই বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায় তিনি যথেষ্ট সাফল্য দেখান।
এরপর ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার কথা চিন্তা করে ১৯৯৪ সালে সপরিবারে কানাডার মন্ট্রিয়লে পাড়ি জমান মোহাম্মদ সোলায়মান। সেখানে যাওয়ার কিছুদিন পর আবারও ব্যবসায় মনযোগ দেন। মন্ট্রিয়লে তিনি প্রোপার্টি ম্যানেজমেন্ট এন্ড কার ডিলারশীপ ব্যবসা শুরু করেন। এরপর ৯৮ সালে পরিবার নিয়ে টরন্টো শহরে চলে যান। সেখানে ফাইনান্সিয়াল ইন্ড্রাস্ট্রিতে (আরইএসপি) গভর্নমেন্ট প্রোগ্রামের ডিলারশীপ হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর ফাইনান্সিয়াল সেভিংস প্রোগ্রাম ফর দ্যা হায়ার এডুকেশন সির্কাস হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেন মোহাম্মদ সোলায়মান।
২০০৫ সাল থেকে মোহাম্মদ সোলায়মান রিয়্যাল স্টেট ব্যবসা শুরু করেন। গ্যাস স্টেশন, রেস্টুরেন্ট, ফার্নিচার শো রুম সহ একাধিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে এখনও তিনি সফলতার সাথে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ সোলায়মান জানান, বিদেশে থাকলেও দেশের কৃষ্টি কালচার আমরা সবসময় লালন করি। প্রবাসে নতুন প্রজন্মের যারা আছেন তাদের জন্য আমরা বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে অনুষ্ঠান করে দেশীয় সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করি।
একজন কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব হিসেবেও মোহাম্মদ সোলায়মান সাফল্য দেখিয়েছেন। তিনি চট্টগ্রাম এসোসিয়েশন অফ কানাডা’র ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে ৩ বছর তিনি এই সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি OATH কমিশন ফর সিটি অফ টরন্টোতে ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন।
পারিবারিক জীবনে মোহাম্মদ সোলায়মান ও পারভীন আক্তারের সংসারে রয়েছে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। তার স্ত্রী পারভীন আক্তার একটি ফার্স্ট ফুড শপে এসিসট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন।
ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সোলায়মান দম্পতির গর্বের শেষ নেই। কারণ তারা সেখানে পড়ালেখায় মেধার স্বাক্ষর রেখে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে দেশের সম্মান বাড়াচ্ছেন বলে তিনি মনে করেন।
তাদের বড় মেয়ে মারজিনা সোলায়মান এমবিএ শেষ করে বাই ল্যাঙ্গুয়েল ক্যাশ ম্যানেজার হিসেবে কানাডার একটি নামকরা ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানীতে চাকরি করছেন। ছোট মেয়ে ফারজানা সোলায়মান টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মাসিটিক্যাল এ মাস্টার্স শেষ করে মাইলাইন ইন্টারন্যাশনাল ফার্মাসিটিক্যালস্ এ মেডিক্যাল স্পেশালিস্ট হিসেবে চাকরি করছেন। বড় ছেলে রাসেল সোলায়মান সিভিল ইঞ্জিনিয়ার শেষ করে সিটি অফ এজেক্স এ প্লানিং অফিসার হিসেবে সরকারি চাকরি করছেন এবং ছোট ছেলে রায়হান সোলায়মান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে বর্তমানে কানাডার ফ্যাশন ইন্ক এ ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন।
ছেলে-মেয়েরা বিদেশে বেড়ে উঠলেও তাদের শিকড়কে ভুলে যায়নি জানিয়ে মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, পারিবারিক পরিবেশে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি। ছেলে-মেয়েদেরকে বাংলা কৃষ্টি-কালচার সম্পর্কে ধারাণা দেওয়ার চেষ্টা করি। শতব্যস্ততার মাঝেও আমি প্রায় সময় দেশের মায়ায় এখানে চলে আসি। ছেলে-মেয়েরাও সময় সুযোগ পেলে দেশের উন্নয়নে কিছু করতে চায় বলে মোহাম্মদ সোলায়মান জানান।
(মোহাম্মদ সোলায়মান এর সাথে আলাপচারিতায় অংশ নিয়ে লেখাটি তৈরি করেছেন প্রবাস মেলা’র নির্বাহী সম্পাদক শহীদ রাজু)