কাজী মোশাররফ হোসেন, লস এঞ্জেলস, যুক্তরাষ্ট্র
মাস দু’য়েক হল মেয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন ঝিনুক সাহা। মেয়ের জামাই লস এঞ্জেল্সে সফ্টওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। ঐ বাসাতেই নাতনি সরস্বতী, যাকে তিনি সতি নামেই ডাকেন- খুব ভাব হয়েছে তার সাথে। ভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে ক্লাস শুরু করছে সে। লস এঞ্জেল্স থেকে প্রকাশিত শারদীয় পত্রিকার একটি ম্যাগাজিনে শিরোনামে দেখে চোখ আটকে যায় তার। ঝিনুকের খোঁপায়… বুকের মধ্যে ছলাৎ শব্দে শিহরিত হয় এই বয়সেও। লেখকের নাম পান্না। এই পান্নাই কী সেই পান্না? তার প্রথম কৈশরের ভালোবাসার ছেলেটি? সেও কী এখানেই আছে তাহলে?
পৃথিবী যে গোল তা প্রমাণ করার জন্য আবার দু’জনকেই একত্রিত করার জন্য নিয়ে এসেছে এখানে? এর একটা কিনারা করতেই হয়। গল্পটি আর পড়ছে না সে। ম্যাগাজিনটির সম্পাদককে খুঁজতে ব্যস্ত সে। তার পরিচিত মধ্য বয়স্ক রনজিতকে জিজ্ঞেস করে সে- দাদা এই ম্যাগাজিনের সম্পাদককে আপনি চেনেন? রনজিতকে শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের সকলেই চিনে।
রনজিত আমতা আমতা করে বলেন- কেন কী হয়েছে? আমিই এটির সম্পাদক- কোন ভুল-টুল হয়েছে কী? সবিনয়ে জানতে চায় রনজিত।
আরে না-না দাদা সে রকম কিছু নয়। আর আমি ওসব ওতো বুঝিও না কিন্তু এই যে, এই গল্পটা…
কেন কী হয়েছে দিদি- সাহায্য করার চেষ্টা করে রনজিত।
মানে এই গল্পের নায়িকার সংগে আমার জীবনের একটা মিল আছে। এ গল্পের নায়ককে মনে হয় আমি চিনি- ঐ যিনি নিজেকে পান্না নামে বর্ণনা করেছেন।
দিদি, পান্না আমাদের এখানেই থাকেন এবং রোজ বিকেলেই এখানে আসেন একবার। এসে পড়বেন হয়ত এখনই।
নিজেকে সামলে নিয়ে একটু গম্ভীর হয়ে রনজিত বলেন- এই যে পান্নাদা, এই ভদ্র মহিলা আপনাকে অনেকক্ষণ খুঁজছেন। দিদি ইনি হলেন পান্নাদা। আপনারা আলাপ করুন, অনেকদিন পর দেখা মনে হয়-
অপলক তাকিয়ে থাকে ঝিনুক পান্নার দিকে। দু’কাঁধে দু’হাত রেখে ঝাঁকাতে থাকে। এই পান্নাদা এসব কী হয়েছে তোর?
মাথায় বিশাল টাক। দোহারা গড়নটি ঠিক আছে কিন্তু বয়স যে গ্রাস করেছে সব কিছু। চোখে চোখ রেখে কাঁধ ঝাঁকিয়েই চলেছে ঝিনুক। পান্নার চোখের মণিতে ঝিনুক দেখে চলেছে কুমার নদ, দুপারে দুজনের সাঁতার কাটার জলছবি। শরতে ওদের বাড়ি সাঁজতো অন্য রকমভাবে। শারদীয় পূজার মহোৎসব যে। ঝিনুকের বাবার আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল। অবস্থাপন্ন ঘর, আর শারদীয় উৎসবে পয়সা খরচে কার্পণ্য করেননি কখনো।
ঝিনুকদের বাড়ি, তার পরেই জমিদারের নাতি শ্রী অনিমেষ রায় চৌধুরীদের প্রাচীন জর্ঢু কাচারী ঘরখানা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাপ-ইঁদুরের বাসা ওখানে এখন। সরকারের খাস জমি হিসেবে এখন ইজারা নিয়ে বেগুন তরকারীর চাষাবাদ চলছে। ঐ ভিটে পেড়িয়েই যেত হত ঝিনুকের। ওর বাবার চালের কলঘর থেকে, দুপুরের বাজার নিয়ে আসাই যেন ওর নিয়মিত কাজ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
শরতের কাশফুলে ছেয়ে যেত কুমার নদের দু’পাড়। যা খুব অনায়াসে উপভোগ করত ঝিনুক। চাঁদনী রাতে তা হতো আরও মনমুগ্ধকর। চাঁদনী রাতে আকাশে সাদা-কাল মেঘের ভেলা, দু’পারের কাশবন, পাল তোলা নৌকা বয়ে বেড়াত ভাঁটি ও উজানে।
ঝিনুক একদিন দুপুরে বাজার থেকে আসার পথে পিছু নেয় পান্না, হাতে কাশফুল।
এই ঝিনুক দাঁড়া না একটু। পান্না অনুরোধ করে।
ঝিনুক উত্তর করে- দাঁড়াবো কেন? আমার তাঁড়া আছে। তাড়া আছে বললেও ঠিকই দাঁড়ায় ঝিনুক।
পান্না বলে, ফুল নিবি?
ঝিনুক এদকি ওদিক-তাকিয়ে বলে, কই?
পান্না তার বাম হাতে ধরা ২ গাছি কাশ ফুলের দিকে ইঙ্গিত করে।
ঝিনুক একটু মুখ ভেংচিয়ে বলে এটা তো কাশফুল। ওটা আবার ফুল হলো? নদীর পাড় থেকে তুলে আনলেই হলো।
পান্না বলে তবুও তো তুলে আনতে হয় কারো কথা মনে করেই। এই বলে ঝিনুকের বেনীতে দুগোছা কাশফুল ঝুলিয়ে দেয় পান্না।
ঝিনুক নেকামো করে বলে, ভাল হবে না কিন্তু, কাকুকে সব বলে দেব। চেঁচাতে থাকে ঝিনুক।
পান্না দৌড়ে পালায় কেউ আবার দেখে ফেলবে নাতো। দৌড়ায় আর বলে- যা না পারলে বলতো আমার বাবাকে।
ঝিনুক প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি পৌঁছায়। কেউ আবার দেখেনি তো?
ওর মা ওর মাথায় কাশফুল দেখে টিপ্পনি কাটে, কিরে কাশফুল দিয়ে কী কাশফুল কন্যা হয়েছিস নাকি?
ঝিনুকের মুখ থেকে কথা বের হয় না। মার সাথে রান্নার কাজে হাত লাগায়।
এরপর প্রতিদিন কুমার নদে সকাল সাতটায় আধঘণ্টা, একঘণ্টা সাঁতার কাঁটে অকারণেই। একটু চোখাচোখী হয়, একটু হাসাহাসি, বিভিন্নভাবে পানি ছিটিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় সাঁতরিয়ে একজনের মনের কাছে আরেক জনের ছুটে যাওয়ার প্রয়াস। যদিও দু’জনেই সাঁতার কাঁটতো কুমার নদের দু-কূলে অনেকটা হাঁসের মতো।
কলেজ ফাইনালের আর বেশি বাকি নেই ঝিনুকের। হঠাৎ দেখা গেল সানাই বাঁজছে ঝিনুকদের বাড়িতে। ওদের বাড়িতে আর কেউ নেই বিয়ে যোগ্যা। ওতো এখনো বিয়ে যোগ্যা হয়ে ওঠেনি। তবে? দু’দিন ধরে খুব মিস করছে পান্না ঝিনুককে। দু’দিন সে সাঁতার কাটতে আসছে না। নিশ্চয়ই বিয়ের তোর জোর চলছে। ওদেরকে কেউ কিছু না বললেও ওদের প্রতিদিনের একই সময়ে ¯œান করা ও সাঁতারের মহড়া দেওয়াটা অনেকেরই নজড়ে পড়েছিল। তবে কী ঝিনুক গৃহবন্দি?
বিয়ে হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে আর কোথাও দেখা যায়নি।
ঝিনুকের বিয়ের দুবছরের মাথায় তার বাবা সব কিছু বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিল। না, আর কখনো দেখা হয়নি ঝিনুক ও পান্নার। শরতের মেঘগুলো যেমন ভেসে যায় জীবনের দিনগুলোও তেমনি নীরবে চেলে যেতে থাকে।
পড়ালেখো শেষ করে চাকুরিতে ঢুকেছিল পান্না।
ডিভি লটারির বদৌলতে লস এঞ্জেল্সে এখন সে স্থায়ী বাসিন্দা।
ঝিনুকের মেয়ের গল্পটা অন্য আবার রকম। ওর মেয়ের বিয়ে হয়েছে এই লস এঞ্জেল্স শহরেই। এখন সে আমেরিকার সিটিজেন এবং সে-ই ঝিনুককে লস এঞ্জেল্সে এনেছে।
সরস্বতির ডাকে ঝিনুক যেন সম্বিত ফিরে পায়। আরে দিদি তুমি কী করছ? এখানে কত লোক দেখেছো? লোকে কীভাবে নিবে এ রকম করলে?
লজ্জা পায় ঝিনুক।
ও তাই তো। অনেকদিন পর দেখা কিনা। ছিঃ কি লজ্জায় ফেল্লাম তোকে।
বেশ করছে, এখন চলো কোথায়ও যাওয়া যাক, তোমাদের দীর্ঘদিনের কথাগুলো ভাংচুর করো, বলল সরস্বতী।
কাশ ফুলের কথাই মনে পড়ে যায় ঝিনুকের। চল, যেখানে কাশবন আছে এমন কোথাও যাই, বলে ঝিনুক।
কাশবন কোথায় আছে দাদু? জানতে চায় সতী তার পান্না দাদুর কাছে।
মালিবু বীচ, সংাক্ষিপ্ত উত্তর পান্নার।
হু, রুচি আছে পান্নাদার, সমুদ্র পারের একটা হেভী লোকেশন। লেটস গো দ্যান বলে উঠে সতি। পান্না তার টয়োটা করলার দিকে এগোও কিন্তু বাধ সাধে সতি, নো নো মাই তেসলা উইল গিভ ইউ গাইস রাইড। আমি এজ এ ড্রাইভার ফর মাই টু এস্পেশাল গেস্ট।
উচ্চস্বরে হেসে উঠে সতি। গো টু দ্যা ব্যাক সিট, দ্যাট ইজ রিজার্ভ ফর ইউ। সামনে শুধুই আমি। ফ্রি ওয়ে ওয়ান টেন দিয়ে ইন করলো টেন ফ্রি ওয়েতে।
ও মাই গুডনেস সূর্য মামা দেখি আমার ঠিক অপজিটে। নো প্রোবলেম- আমিও অটো ড্রাইভে দিয়ে দিলাম- জাস্ট সামনেটা একটু দেখা। স্পীড এডজাস্টমেন্ট, অটো ব্রেক সবই আছে তেসলায়। টেন ফ্রি ওয়ের ৪র্থ এঙ্গি ক্রস করতে পারলেই প্যাসিফিক কোষ্ট হাইওয়ে নো মোর ট্র্যাফিক তাই না দাদু? প্রশ্ন করে সতি।
হু, উত্তর দেয় পান্না।
হোয়ার আই হ্যাভ টু পার্ক পান্নাদা? প্রশ্ন করে সতি।
যেখানে তোমার ভাল হয় পার্ক করতে পার দিদি- বলে পান্না।
একটু হার্ড ব্রেক করেই গাড়িটা থামায় সতি। ওকে নেমে পড়–ন সবাই। সূর্য কিছুক্ষণের মধ্যে ডুববে।
সূর্য মামা তার লাল আভা ধারণ করেছে কেবল। সূর্যের লাল রশ্মি প্রশান্ত মহাসাগরের শান্ত সাগরে রক্তিম হয়ে ঝলমল করছে। কী অপরূপ সে দৃশ্য। কুমার নদের জল, তীরের কাশ ফুল সবই ঠিক আছে কিন্তু তাতে প্রশান্ত মহাসাগরের এই বিশালতা কোথায়? পান্না ও ঝিনুক সেই বিশালতায় মুগ্ধ হয়ে পাশাপাশি বসে তা উপভোগ করছে। পাশে যে সতি আছে তা যেন তাদের কোন খেয়ালই নেই। দুজন দুজনের হাত শক্ত করে ধরে আছে সন্ধ্যার আলতো আলোয়। আবার তলিয়ে যায় নিজেদের কৈশরের বেলায়। তখন একটু কথাও বলতে পারতো না দু’জনে। লোকে কী ভাবে, কখন আবার কি রটে যায় যোয়।
এখনও কি মন কেমন কেমন করে সেই কৈশরের ভালোলাগার জন্য? প্রশ্ন করে ঝিনুক।
প্রশান্ত মহাসাগরের বিশালতা আজ ঝিনুকের মনকেও বিশাল করে দিয়েছে। যদি ওর পরিণত বয়স পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করতো, ওরা কখনো এতটা কাছে আসতে পারতো না কিছুতেই।
এভাবে কতক্ষণ কেটে যায় কেউ খেয়াল করেনি। কাশবনের শন শন বাতাসে একটা কাশফুল তুলে আনার কথা মনে পড়লো পান্নার।
পান্না বলে, একটা কাশফুল তুলে আনি ঝিনুক- তোমার খোঁপায় পড়িয়ে দেই এই সুন্দর সন্ধ্যায়?
সন্ধ্যায় কাশফুল ছিঁড়বে? না থাক। গাছটা অনেক কষ্ট পাবে। ও বরং গাছেই দুলুক আমরা শুধু দেখেই যাব।
না, শরতের কাশফুল আর তোলা হয় না।
সতি চল বাড়ি যাই। তোর আবার ভার্সিটির পড়া আছে না?।
তিনজন গাড়ির দিকে পা বাড়াল…