জেসন ফারম্যান
কোনরূপ প্রশ্ন না তুলে বলা যায় যে, অভিবাসন অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর জন্য নেট অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করে আসছে। যেসব দেশে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে চলেছে তাদের ক্ষেত্রে এটি আরো বেশী প্রযোজ্য। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত অভিবাসন বিরোধী মনোভাব রাজনৈতিক নির্দেশনা হিসাবে জাগ্রত থাকবে ততদিন ওই সব দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে এবং পুনরুত্থীত পপুলিস্ট গোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
বিশে^র উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধীর গতি। গত এক দশক ধরে তাদের প্রবৃদ্ধির গড় হার ১.২ শতাংশ যা গত ২৫ বছরের গড় হার ৩.১ শতাংশের নীচে নেমে আছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একটি দেশকে অনুদার, অসহিষ্ণু এবং কম অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজে পরিণত করে। সুতরাং এটি যুক্তিযুক্ত যে, গত দশকের ধীরগতির প্রবৃদ্ধি জনবাদী জাতীয়তাবাদী (Populist Nationalism) শক্তির অনাকাঙ্খিত বিন্যাসের পালে হাওয়া দিয়েছে যা ক্রমবর্ধমান হারে বেশ কয়েকটি দেশ ধরে রেখেছে। বিংশ শতাব্দীর অন্ধকার যুগের মতো এখনকার জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী অভিবাসনের ঘোর বিরোধী। আবার কম মাত্রায় হলেও তারা মুক্ত বাণিজ্যেরও বিপক্ষে। এটা দেশগুলির শাসকদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। আজকের অসহিষ্ণু জাতীয়তাবাদী শক্তি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আবার এটা তার উত্থানকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করছে। এই দুর্বিনীত চক্রটিকে একটি সুনীতির এককে পরিণত করতে হবে। যার উপর নির্ভর করছে সকল অসংকোচ কাটিয়ে দ্রুতগতির প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথ তৈরী করা। এজন্য কম করে হলেও জাতীয়তাবাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক ফর্মগুলোর সাথে অভিবাসনকে আরো সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই বিষয়ে অর্থনৈতিক যুক্তি প্রমাণও স্পষ্ট। বর্তমানে অভিবাসন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি শক্তিশালী উপাদান। উপরন্তু পূর্বের তুলনায় অভিবাসন আরো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে বয়ষ্ক লোকের সংখ্যা বাড়ছে এবং তাদের জন্ম হারও কম। দেশীয় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কম থাকায় বয়স্ক লোকদের অবসরের সমানুপাতে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে এসব দেশের বেশ ঘাটতি রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৯৫ সাল থেকে জাপানের কর্মক্ষম জনসংখ্যা সংকুচিত হয়ে আসছে। ২০০০-২০১০ সময়কালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৭০ শতাংশ অভিবাসীদের দখলে ছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের চলমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল কারণ হলো বিপুল সংখ্যক অভিবাসী শ্রমশক্তি নিয়োজিত থাকা। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেবল তাদের স্ব-দেশী শ্রমিকদের উপর নির্ভর করে তবে তাদের শ্রমশক্তি সংকুচিত হতে থাকবে। ফলে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে। দ্রুত প্রবৃদ্ধি একটি দেশের জন্য খুবই কল্যাণকর। এমনকি এটি অধিক জনসংখ্যার ভারবহনে বেশ সহায়তা করে। কারণ কর্মরত অভিবাসীরা যে ট্যাক্স পরিশোধ করে তা পেনশনভোগী এবং অবসর প্রাপ্তদের ভরণপোষণে সহায়তা করে। সুতরাং সাধারণভাবে বলা যায়, জাপানের মতো একটি ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যার দেশের চেয়ে কর্মক্ষম এবং সম্প্রসারিত জনসংখ্যা নিয়ে গড়ে উঠা একটি দ্রুত বর্ধনশীল দেশ অনেক ভালো। অধিকন্তু কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বাড়ানোর পাশাপাশি অভিবাসীরা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মাথাপিছু জিডিপি বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। এর কারণ হলো বিপুলসংখ্যক অভিবাসী নতুন ব্যবসা শুরু করার মাধ্যমে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১৫ সালে জার্মানিতে যারা নতুন ব্যবসা শুরু করেছে তাদের মধ্যে ৪৪ শতাংশই অভিবাসী। OECD (Organisation for Economic Co-operation and Development)-এর তথ্য মতে ফ্রান্সে নতুন উদ্যোক্তা হিসাবে অভিবাসীদের হার স্থানীয় অধিবাসীদের তুলনায় ২৯ শতাংশ বেশী। ঙঊঈউ ভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোতে এই হার অনুরূপ দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয় অধিবাসীদের তুলনায় অভিবাসীরা ২ থেকে ৩ গুণ বেশী প্রেটেন্ট গ্রহণ করেছেন এবং তাদের উদ্ভাবনগুলো থেকে নন-ইমিগ্রান্টরা বেশ সুবিধা পেয়ে থাকেন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, অভিবাসীরা সামগ্রিকভাবে তাদের উদ্ভাবনী চিন্তার মাধ্যমে লভ্যাংশ বৃদ্ধি করে। কিন্তু এই লভ্যাংশ কিভাবে বন্টন করা হবে তা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। তারা মনে করে কারো লাভ হবে কারো লোকসান হবে। এটাই বাস্তবতা। বাস্তবসম্মত প্রমাণাদী সাক্ষ্য দেয়, অভিবাসীরা স্থানীয়দের আয় কমায় না। বস্তুত মোটের উপর তারা স্থানীয়দের আয় বাড়াতে ভূমিকা রাখছেন। ফ্রান্সের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষার উদাহরণ টেনে বলা যায়, একই ডিপার্টমেন্টের মধ্যে অভিবাসীদের কর্মসংস্থান ১ শতাংশ বৃদ্ধি করলে স্থানীয়ভাবে জন্মগ্রহণকারী কর্মীদের বেতন ০.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। আবার এটাও প্রতিয়মান হয়েছে যে, কর্মক্ষমদের জন্য কমংসংস্থানের আকার এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখা ছাড়াও অভিবাসীরা স্থানীয় কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সম্পূরক ভূমিকা পালন করে এবং এতে তাদের আয় বৃদ্ধি পায়।
আমার পেশাগত ফোকাস অর্থনীতির প্রতি। তাই আমি প্রবৃদ্ধির ভূমিকার উপর বিশেষ জোর দিয়ে থাকি। কিন্তু এটাও পরিষ্কারভাবে বলা যাচ্ছে না যে, জনবাদী জাতীয়তাবাদ (Populist Nationalism)-এর উত্থানের পিছনে প্রবৃদ্ধিই একমাত্র ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করে। বস্তুত উন্নত দেশগুলো সাংস্কৃতিকভাবেও পরিবর্তিত হচ্ছে। এটাও জনবাদী জাতীয়তাবাদ-এর উত্থানের একটা বড় কারণ বলে মনে করা হয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ ছিল অভিবাসী। আর বর্তমানে তা বেড়ে ১৪ শতাংশে উপনীত হয়েছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ইয়াসা মাউনক তার অত্যন্ত অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন নতুন বই ‘The Peoples vs Democracy’- তে নোট আকারে অভিবাসীদের বিষয়ে লিখেছেন। এই বইটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী বিরোধী সর্বশেষ অভিঘাতের পর সবচেয়ে বেশী বিক্রি হয়েছে। বইতে তিনি অভিবাসীদের প্রতি অভিঘাতের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতিকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের হলুদ বিপদ (Yellwo Peril) এর সাথে তুলনা করেছেন।
এই প্রবণতা এখনো বহমান। অন্যান্য ধনীদেশগুলোতেও আরো নাটকীয় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। উদাহরণ টেনে বলা যায়, ১৯৬০ সালে সুইডেনে অভিবাসী বংশোদ্ভূত জনসংখ্যা যেখানে দেশটির মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ ছিল, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ শতাংশে। এক্ষেত্রে সুইডেন যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে গেছে। অভিবাসী প্রশ্নে প্রত্যেকটি উন্নত দেশই কোন না কোনভাবে পছন্দ অপছন্দের মুখোমুখি হয়। অভিবাসীদের বহিস্কৃতকরণের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ওই দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বরং অভিবাসীদের প্রতি তাদের অধিকতর উদারতা প্রদর্শন তাদেরকে (উন্নত দেশগুলোকে) আরো বেশী অর্থনৈতিক সুবিধা এনে দেবে। উন্নত দেশগুলোর গৃহিত সরকারি নীতিমালা তাদের উদারতা প্রদর্শনে নিশ্চিত ভূমিকা রাখতে পারে। এতে অভিবাসীদের প্রতি উদারতার ফলাফল অনুধাবণ করা সহজ হবে। একটা কথা এখানে বলে রাখা ভালো, অভিবাসীদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাগুলোর প্রতি আমাদের দৃষ্টি সরানো কোনভাবেই উচিত হবে না। কারণ বিষয়টির সাথে শুধু মানবিক প্রশ্নই জড়িত নয় বরং উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়টিও আমলে আনা গুরুত্বপূর্ণ।
অভিবাসন বিষয়ে গৃহিত নীতিমালা ছাড়াও আমাদেরকে একটি সাংস্কৃতিক প্রত্যাশা বাস্তবায়ণ করতে হবে। কারণ অভিবাসীরা শুধু বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে না বরং তারা একটি নতুন দেশের নাগরিক হিসেবে যুক্ত হয়। অর্থাৎ তারা নতুন ভাষায় কথা বলতে শেখে, যে দেশের অভিবাসী হচ্ছে সে দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে সম্মান করে নিজেকে একাত্ম করে নেয়। সম্প্রতি ফ্রান্সের ইক্স-এন প্রভিন্সে একটি অর্থনীতি বিষয়ক আলোচনা সভায় যোগ দিতে গিয়ে আমি সরাসরি দেখেছি সেখানকার অভিবাসীরা সদ্য বিজয়ী ফ্রান্সের ফুটবল দলকে কিভাবে অভিবাদন জানাচ্ছে এবং জয়ী দেশের নাগরিক হিসেবে উল্লাস করছে। উল্লেখ্য, এবারের ফুটবল বিশ্বকাপে ফ্রান্স দলের ২৩ সদস্যের ১৬ জনই অভিবাসী। তারা নানা নিপীড়ণের শিকার হয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে অভিবাসী হিসেবে ফ্রান্সে বসবাস করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও এমনটি প্রযোজ্য হতে পারে। অভিবাসন ও সমন্বিত জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি এমন হওয়া উচিৎ যার লক্ষ্যে আমরা কাজ করতে পারি। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রেও একদিন অভিবাসীদের সমন্বয়ে একটি ফুটবল টীমের জন্ম হতে পারে যে দলটি দেশটির জন্য অভাবনীয় সাফল্য বয়ে আনবে।
(জেসন ফারম্যান- হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল-এর প্র্যাক্টিস অব ইকোনমিক পলিসির অধ্যাপক এবং পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকস্ এর সিনিয়র ফেলো। তিনি ২০১৩-২০১৭ সময়কালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।)
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন:
শহীদ রাজু, নির্বাহী সম্পাদক, প্রবাস মেলা