মম মজুমদার, কোলকাতা, ভারত: শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারত ও মধ্য এশিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রাচীন উট ট্রেন রুট যা রাজস্থানে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হল মরু দেশের প্রবেশ পথ রাজধানী জয়পুর থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জাদুর শহর ১৪৫৯ সালে রাঠোর রাজবংশের রাজপুত প্রধান রাও যোধা এই শহর প্রতিষ্ঠা করেন।
আরাবল্লী পর্বতের গায়ে সোনার রঙে বেলে পাথরে তৈরি ভারত পাকিস্তান সীমান্তে নিকটবর্তী শেষ বৃহত্তম শহর। এই শহরটি ভাগ্যের সাথে বারবার লড়াই করেছে কখনো উত্থান কখনো বা পতন ঘটেছে তবু ও লড়াইয়ের ময়দান থেকে পালিয়ে যায়নি!
ব্রিটিশদের আমলে সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য এই শহর অন্ধকারে তলিয়ে গেলেও স্বাধীনতার পর ১৯৬৫ থেকে ৭১ সাল ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় এই শহরের গুরুত্ব সরকার অনুভব করেন। আগে এই শহরটি অর্থনীতি নির্ভর করত বাণিজ্যের ওপর। পরবর্তীকালে সামরিক বাহিনী ও পর্যটন শিল্পের উপর এই শহরের অর্থনীতি নির্ভর করছে।
ঐতিহাসিক এই শহর পর্যটনকারীদের আকর্ষণের বিষয় আরাবল্লী পর্বতের গায়ে সোনার কেল্লা, সোনার বর্ণে বেলে পাথর দিয়ে তৈরি দুর্গটি দেশ-বিদেশে সকলের কাছে খুবই আকর্ষণীয় জিনিস।
বারো শতকে কোন এক সময় রাওয়াল জয়সাল এর ছোট সৎ ভাই বিজয় রাজ লাঞ্চার থেকে নির্বাসিত হয়ে ভাগ্য সন্ধানে মরুভূমির ২৫০ ফুট উঁচু-পাথরের শিলার কাছে আসেন যেখানে ঋষি ঈসুল থাকতেন। তারই নির্দেশে যদুবংশীয় জলসাল ১১৫৬ সালে সপ্ত মাটির দুর্গ স্থাপন করেন নাম দেন জয়সলমের। ঋষি বলেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে শহরকে আড়াই বার ধ্বংসের মুখে পড়বে কিন্তু জলসাল ঋষির কথা বিশ্বাস করেননি।।
তিনি শহর প্রতিষ্ঠা করে নিজের নামে শহরের নাম রাখেন। কিন্তু ভবিষ্যৎ বাণী সত্যে পরিণত হন। ১২৯৪ সালে আলাউদ্দিন খলজি এই শহর আক্রমণ করে তার সেনাবাহিনীদের হাত থেকে নিজেদের ইজ্জত বাঁচাতে ভাটিয়া মেয়েরা জহর ব্রত পালন করে নিজেদের আগুনে আত্মহতি দেয়! আট বছর দুর্গের বাইরে খলজির সেনারা অবরোধ করে থাকে। অবশেষে খলজির সেনারা দুর্গে প্রবেশ করে ভাটিয়ারা শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। ফলে শহরটি পরিত্যক্ত অবস্থায় বেশ কিছুদিন পড়েছিল। প্রায় দুই শতাব্দি পরে দিল্লির তুর্কি শাসক ফিরোজ শাহ তুঘলক এই শহর অবরোধ করেছিল। ১৬ হাজার মহিলা জহর ব্রত পালন করে মারা যায়। শাসক দু দু ও তার পুত্র তি লস্কি সহ ১৭ ০০ সৈন্য মারা যায় ! আবার শহরটি কিছুদিনের জন্য জনশূন্য হয়ে পড়ে বলিষ্ঠ ভাটিয়ারা আবারো ফিরে আসে শাসক রাওয়াল লুনা করন একজন ধূর্ত আফগান সেনাপতির দ্বারা প্রতারিত হয়! আফগান সেনাপতি রাওয়ালের কাছে রানীদের সাথে তার ঘরের মহিলাদের আলাপ করাবে বলে অনুমতি চেয়েছিল রানা সে অনুমতি দেন মহিলাদের বদলে ধূর্ত আফগান সেনারা দুর্গে প্রবেশ করে। নিজেদের ইজ্জত বাঁচানোর জন্য জহরব্রত করার সময়ও পায়নি মেয়েরা সরাসরি তারা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মারা যায়! এইভাবে ঋষির কথা বাস্তবে পরিণত হয়। বারবার শহরটি বিপদের মুখে পড়ে শেষে বিপদ কাটিয়ে বেঁচে ওঠে। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের যাওয়ার পথগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ১৯৬৫ থেকে ৭১ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারত সরকার এই শহরকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করে।
এখানকার প্রধান দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম সোনার কেল্লা। হলুদ বর্ণের বেলে পাথরে তৈরি এই দুর্গ বা কেল্লাটি রাজস্থানের একমাত্র জীবন্ত দুর্গ এখানে এখনো ৩০০০ জনের বসবাস ব্যবসা হোমস্টে ক্যাফে ও প্রচুর মন্দির। ২০১৩ সালে এই দুর্গ কে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষনা করেন। এখানে ৯৯ টি দুর্গ তার মধ্যে ৯২ টি ১৬৩৩ থেকে ১৬৪৭ সালের মধ্যে তৈরি তিন স্তরের দেওয়াল দ্বারা ঘেরা বিশাল দুর্গ। রন্ধে রন্ধে রোমান্সে ভরা ইতিহাসের কথা চুপি চপি বলে চলেছে পাথরগুলি।
এছাড়াও অন্যান্য দর্শনীয় জিনিসের মধ্যে অন্যতম হলো কুলধারা কথিত আছে জয়সলমের থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে একটি নির্জন বালিয়াড়ি অঞ্চল যেখানে ১৯ শতকে একটি সবুজ ঘেরা গ্রাম ছিল। ১২৯১ সালে যোধপুর এর পালিওয়াল ব্রাহ্মণরা এই গ্রাম পত্তন করেছিল ৮৪ টি ছোট ছোট সম্প্রদায় ভিত্তিক গ্রাম প্রায় ১৫০০ মানুষের বাস ছিল। পালি ওয়াল ব্রাহ্মণরা কৃষি কাজে দক্ষ ছিল ১৮২৫ সালে রাখি পূর্ণিমার রাত্রে এই গ্রামটি সম্পূর্ণ জনশূন্য হয়ে যায়! কথিত আছে জয়সলমেরে একজন অত্যাচারী দেওয়ান সেলিম শিং ব্রাহ্মণ প্রধানের কন্যাকে জোর করে বিবাহ করতে চান গ্রামবাসীরা তীব্রভাবে প্রতিবাদ করা তা সম্ভব হয়নি । প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে সেলিম সিং প্রচুর পরিমাণে কর আদায় করতে থাকে। নিজেদের আত্মসম্মান বজায় রাখতে রাখি পূর্ণিমার রাত্রে গ্রাম ছেড়ে চলে যায় এবং অভিশাপ দিয়ে যায় ভবিষ্যতে কেউ এই গ্রামে বাস করতে পারবে না। তাদের অভিশাপে আজও গ্রামটি জনশূন্য হয়ে আছে।
গ্রামবাসীদের ফেলে যাওয়া পাথরের ঘর জলের কুয়ো ধ্বংসস্তূপ এর মত আজও পড়ে আছে ২০১৩ সালে প্যারানরমাল সোসাইটি কয়েকজন সদস্য রাতে বাস করার জন্য গ্রামে গিয়েছিল। তাদের চরম ক্ষতি হয় কয়েকজনের মৃত্যু হয়। আশেপাশের গানগুলি উন্নত হলেও আজও এই গ্রামটি কালের অতলে ডুবে যাচ্ছে। কুলধারা গ্রামটি বর্তমানে সরকার হেরিটেজ নগর হিসেবে ঘোষণা করেছে। গ্রামে যেতে হলে টিকিট কেটে যেতে হয়।।
স্যামস্যান্ড টিউন স: জয়সলমের থেকে ৪০ কিমি দূরে অবস্থিত বালির কেল্লা গুলো থেকে সূর্যাস্তের রূপ অসাধারণ! সব থেকে রোমাঞ্চকর ভবনের স্থান হল এই অঞ্চল। ধুধু মরুভূমির মধ্যে বেশ কিছু উট বাইক রয়েছে সূর্যাস্তের স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সোনালী বালুবাসীর ওপর বাইকের তীব্র গতিতে চলা র উত্তেজনা অল্প বয়সীদের আকর্ষণীয় বিষয়। চড়াই-উৎরাই বালুর পথ ভেঙে জীপ যখন তীব্র গতিতে লক্ষণীয় স্থানে পৌঁছায় মনে হয় যেন সমুদ্রের মাঝখানে আসা হলো। চারপাশে কেবল সোনালী বালি । বেশ কিছু ক্যাকটাস গাছ রয়েছে পৃথিবীতে সবুজ আছে তার প্রমাণ দিতে দিগন্তের শেষে সূর্য যখন বালুর অতলে তলিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সে দৃশ্য অসাধারণ ! মনে হয় যেন কোন অজানা প্রান্তরে তেপান্তরের মাঠে হারিয়ে গেলাম। তবে এই অঞ্চলের অল্প সংখ্যক মানুষের বাস তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ বেদে বেদুইন জীবন পালন করে। ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা বিদ্যালয়ের মুখে যায় না। মিড ডে মিল কি তারা জানে না ! কেবল পর্যটকদের কাছে ছুটে ছুটে চলে আসে তাদের আদি কলা দেখিয়ে কিছু পয়সা উপায় এর উদ্দেশ্যে।
অবর্ণনীয় কষ্ট তাদের খালিপায়ে তপ্ত বালির ওপর এক পর্যটক থেকে অপর পর্যটক এর কাছে ছুটে চলে দুটো জোয়ারের রুটি অর্জনের আশায়।
এখানকার অধিবাসীদের ব্যবহার অত্যন্ত ভালো খুবই বিশ্বাসী। দারিদ্রতা তাদের সরলতাকে আজও হরণ করতে পারেনি!