হাকিকুল ইসলাম খোকন, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি: বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধকালীন ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত) বীর উত্তমের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতির শোক।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশ সময় ২৫ আগস্ট ২০২০, মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে মারা যান সি আর দত্ত। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।
বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতির চেয়ারম্যান মো: মঞ্জুর হোসেন ঈসা, মহাসচিব অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম সেকুল, সাংগঠনিক সম্পাদক লায়ন মো: আল আমিন সি আর দত্ত বীর উত্তমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
সি আর দত্তের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত। তিনি বলেন, ‘সি আর দত্ত মারা গেছেন। বাংলাদেশ সময় আজ সকাল ৯টায় তিনি মারা যান।’
রানা দাশ গুপ্ত আরও বলেন, বয়স ৯৩ বছর হওয়ায় তার নানান দূরারোগ্য রোগ ছিল। তিনি আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। তার মেয়ের বাসায় ছিলেন। ওখানে হঠাৎ করে গত শুক্রবার তিনি বাথরুমে পড়ে যান। পড়ে গিয়ে পায়ে ফ্র্যাকচার হয়েছিল। তখন তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। ওই অবস্থায় তাকে ফ্লোরিডার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে যাওয়ার পরপরই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। গতকালকে তার মেয়ে ওখান থেকে ফোন করে জানায়, গতকাল রাত ৯টার দিকে তিনি ভেন্টিলেশনে আছেন। অবস্থা আশঙ্কাজনক। কিছুক্ষণ আগে খবর পেলাম যে, তিনি মারা গেছেন।’
চিত্ত রঞ্জন দত্তের জন্ম ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে। তার পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। তার বাবার নাম উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত এবং মায়ের নাম লাবণ্য প্রভা দত্ত। শিলং-এর ‘লাবান গভর্নমেন্ট হাইস্কুল’-এ দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হবিগঞ্জে এসে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে তিনি মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে কলকাতার আশুতোষ কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়ে ছাত্রাবাসে থাকা শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে খুলনার দৌলতপুর কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন৷ পরে এই কলেজ থেকেই বি.এস.সি পাশ করেন।
চিত্ত রঞ্জন দত্ত ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কিছুদিন পর ‘সেকেন্ড লেফটেনেন্ট’ পদে কমিশন পান। ১৯৬৫ সালে সৈনিক জীবনে প্রথম যুদ্ধে লড়েন তিনি। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে আসালং এ একটা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন তিনি। এই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে পুরস্কৃত করে।
১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হিসেব দায়িত্ব দেয়া হয় এম.এ.জি ওসমানীকে। তিনি বাংলাদশেকে মোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করে নেন। সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই শায়স্তাগঞ্জ রেল লাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে ৪নং সেক্টর গঠন করা হয় এবং এই সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন চিত্ত রঞ্জন দত্ত। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর সিলেটের রশীদপুরে প্রথমে ক্যাম্প বানান তিনি৷ চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চা বাগান৷ চা বাগানের আড়ালকে কাজে লাগিয়ে তিনি যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করে দিতেন৷ পরবর্তী সময়ে তিনি যুদ্ধের আক্রমণের সুবিধার্থে রশীদপুর ছেড়ে মৌলভীবাজারে ক্যাম্প স্থাপন করেন৷
চিত্ত রঞ্জন দত্ত ১৯৭২ সালে রংপুরে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন৷ ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সরকার৷ এই বিষয়ে চিত্ত রঞ্জন দত্তকে দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ সরকার৷ পরবর্তীকালে তিনি সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠন করেন এবং নাম দেন বাংলাদেশ রাইফেলস। বর্তমানে এ বাহিনীর নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। চিত্ত রঞ্জন দত্ত ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম ডাইরেক্টর জেনারেল।
এছাড়া ১৯৭১-এর পর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তাকে নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেড কোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৯ সালে বি আর টি সি এর চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন৷
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য চিত্ত রঞ্জন দত্ত বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন। এছাড়া ঢাকার কাঁটাবন থেকে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কটি ‘বীরউত্তম সি আর দত্ত’ সড়ক নামে নামকরণ করা হয়।