নীরব আহমেদ রুমন, এথেন্স, গ্রীস: গ্রিসের মানোলদা এলাকার কৃষি জমি যেখানে হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিকগণ কাজ করেন গ্রিসের রাজধানী এথেন্স শহর থেকে বাসে প্রায় ৩-৪ ঘন্টা দূরেত্বর শহরের নাম মানোলাদা। এই শহরটি মূলত কৃষি কাজের জন্য পরিচিত। এখানে প্রায় ৯০% লোকই কৃষি কাজের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। প্রায় সকল প্রকারের কৃষি ফসল উৎপাদন হয় মানোলদাতে, তবে স্ট্রবেরি ফলের জন্য এই শহরটি বিখ্যাত হাজার হাজার হেক্টর মাইল স্ট্রবেরি খামার আছে এই মানোলাদায়। আর এই স্ট্রবেরি ঘিরে কয়েক হাজার বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এক কথায় ছোট্ট এক টুকরো বাংলাদেশের দেখা পাওয়া যায় সেখানে। এই শহরটি গ্রীসের আরেকটি অন্যতম শহর পাতরার পাশেই।
গ্রীসের মানোলদাকে-হাজারো বাংলাদেশিদের মিলনমেলা বলা যেতে পারে। অসহায় বেকার ও কাগজহীন বাংলাদেশিদের শেষ কর্মস্থল একটু সুখের আশা খোঁজার জায়গা এবং বেঁচে থাকার জন্য মানবেতর জীবনযাপনের যুদ্ধস্থলও বলা যেতে পারে এই মানোলাদাকে।
মানোলদাতে স্ট্রবেরি ক্ষেতে কার্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা মানোলাদায় প্রতিবছর স্ট্রবেরি সিজনে ৬-৮ হাজার বাংলাদেশির সমাগম ঘটে। শহর থেকে গ্রামে একজনের পরিচয়ে আরেকজন কাজে যায় তাই অসহায় বা বেকার যারা তাদের শেষ কর্মস্থল মানোলাদাই হয়ে থাকে।
যেহেতু হাজার হাজার লোকের সমাগম এখানে সেই ক্ষেত্রে কাজের ব্যাপারে প্রত্যেক মালিকের একেকজন বাংলাদেশি মস্তুরা বা ফোরম্যান এর আওতায় ৫০-৫০০ জন লোক কাজ করে থাকে। আগত সব প্রবাসীদেরকে কতিপয় মস্তুরা বা ফোরম্যানরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাদের কাজের হিসাব থাকা খাওয়া এবং মজুরি দেওয়া থেকে নিয়ে সব কিছু এই মাস্তুরাদের (ফোরম্যানরা তারা মালিকের কাছ থেকে টাকা এনে শ্রমিকদের প্ররিশোধ করে) নিয়ন্ত্রয় থাকে।
যে মোটামুটি গ্রীক ভাষায় কথা বলতে পারে তাকে শ্রমিকদের দায়িত্ব (মাস্তুরাদের কাজ) দেওয়া হয়। মালিকরা বলে দেয় কতজন শ্রমিক তার লাগবে সেই হিসেবে মাস্তুরা লোকজন সংগ্রহ করে।
তারা মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে কাজের আশ্রয় দিয়ে অসহায় শ্রমিকদের কাছ থেকে ঘর নামক পলিথিলের আবাসস্থলের ভাড়া থেকে শুরু করে স্টবেরী খামারের কাজের মজুরি থেকে শ্রমিকদের অভার টাইম এবং সিজনের কাজ শেষে প্রত্যেক শ্রমিকের কাছ থেকে মাথাপিছু ১০০-১৫০ ইউরো নিয়ে থাকে। কতিপয় কিছু মাস্তুরারা যুগ-যুগ ধরে এই মাথাপিছু টাকা নেওয়ার আইন করেছে। এটা তাদের কাছে নরমাল একটা ব্যাপার।
পলিথিনের বানানো তাঁবুতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মানবেতর জীবন যেখান থেকে মাস্তুরারা (ফোরম্যানরা) প্রতি মাসে ভাড়ার টাকা আদায় করে। স্ট্রবেরি খামারে একজন শ্রমিক ২০-২৫ ইউরো মজুরিতে সকাল থেকে ৭/৮ ঘন্টা কড়া রোদে গ্রীন হাউজের মত পলিথিনের ঘরের ভিতরে হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে মাস শেষে যদি শুনে তাকে উল্টো আরো ভর্তুকি দিতে হবে। তাহলে সেই লোকের অবস্থা টা কি হতে পারে? মাস্তুরারা সব সময় এই জিনিসটাই করে থাকে। এছাড়া অনেক মাস্তুরা প্রবাসী শ্রমিকদের কম বেতন দেয় এমনকি তাদের পাওনা টাকা সময় মতন পরিশোধ করে না।
অনেক সময় তারা মানুষের বেতন পেয়েও সব দেয় না। অভার টাইমের নামে প্রবাসীদের কাজের টাকা মালিক থেকে বেশি নিয়ে নিজেরা পকেট গরম করে।
প্রত্যেকটা সিজনের শেষে অনেক মালিকেরাই কয়েক হাজার ইউরো মাস্তুরার নিকটে বোনাস হিসেবে দিয়ে দেয় যা শ্রমিকদের জন্য। কিন্তু এই ফোরম্যানরা হাত থেকে এই টাকাগুলি শ্রমিকদের হাতে যাওয়া তো দূরের কথা শ্রমিকরা খবরটাই পায়না। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে অনেকে বাংলাদেশি ফোরম্যানে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ।
খারাপ মানুষের ভিড়ে অল্প কয়েকজন ভালো মস্তুরারাও আড়ালেই রয়ে যায়। তারা চাইলেও কাউকে পাশে না পাওয়ায় কোন পদক্ষেপ নিতে পারে না।
অন্তত মাথাপিছু যে পরিমাণ টাকাটা মাস্তুরারা নিয়ে থাকে তা বন্ধ করতে বিগত দিনে অনেক কমিটি বা বাংলাদেশ এম্বেসি সোচ্চার হলেও তা বন্ধ করা যায়নি অথবা উনাদের পদক্ষেপগুলি জোড়দার ছিলো না।
গ্রীসে বাংলাদেশ কমিউনিটি এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যেখানে কাজ করা প্রবাসীরা বলেন– আপনারা নেয়া মানোলদায় অসহায় শ্রমিকদের জন্য কিছু করুন। স্ট্রবেরি খামারের মালিকদের সাথে আলোচনা করে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিশ্চিত করুন। খারাপ মান্তুরাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন। সকল মালিকদের এই বিষয়ে অভিহিত করুন। যাতে মানোলদাতে কাজ করা সকল শ্রমিক তাদের সঠিক ন্যায্য বেতন পায়।