সত্যরঞ্জন সরকার, কুয়েত সিটি, কুয়েত
সেকাল একাল নিয়ে গ্রামীণ জীবনকে বিশ্লেষণ করতে হলে স্বীয় অনুভূতির আলোকে স্মৃতিচারণা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সবকালই সময়ের স্রোতে ভেসে যায়। ভেসে যাওয়া ক্ষণের কিছু স্মৃতি, সময়ের প্রেক্ষাপটে যা মনের কোনে দাগ কাটে, যা জমা থাকে তাকে মনের কুটুরী থেকে বের করে পরিবেশন করার এ ক্ষুদ্র প্রয়াসমাত্র। প্রত্যেক মানুষের কাছেই তার বাল্যস্মৃতি সুখকর। ঘাত প্রতিঘাতে বেড়ে ওঠা জীবন যাত্রায় সুখ-দুঃখ, আশা, আকাংখা, হাসি, কান্না, সবকালেই বিদ্যমান, তার পরেও সুখ স্মৃতিকেই মানুষ মনে রাখে। কবির কথায় ‘পুরানো সে দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়’।
যে গ্রামে পাখ-পাখালিরা গানের সুরে প্রাণ জুড়াতো, যে গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় গ্রামীণ খেলাকে কেন্দ্র করে ঐক্যতানে সংঘবদ্ধতার দাপটে একপাড়া অন্যপাড়াকে সমীহ করে চলতো, একালে তা আর দেখা যায় না। গ্রামের মুরুব্বীরা অন্যায়কারীকে আপন পর না ভেবে অতি সহজেই শাসন করতে পারতো এবং গ্রামীণ সালিশের মাধ্যমে ছোট খাটো বিচারের দায়-দায়িত্ব নিজেরাই নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়ে অহেতুক মামলা মোকাদ্দমাা, হয়রানি থেকে মানুষকে রক্ষা করতো। সামান্য-তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে কেউ বিচারের জন্য একালের মত গ্রাম্য টাউটদের পাল্লায় পড়ে সর্বশান্ত হতোনা। গ্রামীণ জীবনে দরিদ্র জণগোষ্ঠীকে অন্যায়ভাবে কেউ ঠকাতে পারতোনা, কেউ না কেউ প্রতিবাদ করতো। আজ সেখানে সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। অন্যের জন্যে প্রতিবাদ তো করেই না, বরং সবাই নিজের গা-বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করে।

উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে মানুষকে এগিয়ে দেওয়ার, গড়ে তোলার সে সংস্কৃতি একালে অনুপস্থিত আগে কম বেতনে স্কুলের শিক্ষকরাও বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রদের খোঁজ খবর নিতেন, পড়াশোনার জন্য উৎসাহ দেওয়ার এ রীতি এখন আর দেখা যায় না। পাড়ার মোড়ে কিংবা হাটে, মাঠে-ঘাটে গুরু জনদের দেখলে যে সমীহবোধ ছিল, এখন তা অনুপস্থিত।
বর্তমানে গ্রামগঞ্জে মাদকাসক্তের যে দৌরাত্ম, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। অতীতে বিড়ি, সিগারেট তথা ধূমপানের জন্য কানমলা খায়নি এমন মানুষের সংখ্যা খুব কমই আছে। সখের বশে বিড়ি, সিগারেট দু’একটান দিয়ে ঘরে ফিরলে যদি তা অভিভাবকদের কানে পৌঁছাত তার জন্য তার শাস্তি ছিল অবধারিত। এ যুগে হাটে, মাঠে, বাজারে অবাধে এগুলোর ব্যবহার চলছে, দেখেও কেউ শাসন তো দূরের কথা এদের থেকে পালাতে পারলেই বাঁচে। গ্রামে তখন শহরের তুলনায় অনেক কিছু ছিলনা, কিন্তু যা গ্রামে ছিল তা অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা অসম্ভব। এখন কাউকে শাসন করতে যাওয়া মানে বিপদ ডেকে আনা, কিংবা কি দরকার বাড়ির ভাত খেয়ে বনের মেষ তাড়ানোর? আন্তরিকতা না থাকলে হঠাৎ কাউকে শাসনের ফল হিতে বিপরীত ঘটতে পারে। তাছাড়া পক্ষপাতের এ সময়ে নিরপেক্ষতার প্রশ্নটাও জরুরী। ‘পরের জন্য প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’-এ সব কথা যেন ইদানিং জীবনের আর পাঁচটা জিনিসের মত পণ্যই হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ মুখে হয়তো কোন স্বার্থে, আহ্লাদে গদগদ ভাব দেখানো হচ্ছে, কিন্তু তা কেবল মুখেই বাহ্যিকভাবেই হয়তো, মনে মোটেই সেই ধরনের উষ্ণতা নেই।

বড় বড় শহর আজ গ্রামকে অজগরের মতো গিলে খাচ্ছে- ফলে শহর তো আন্তর্জাতিকতা, মাল্টিকালচারের জন্মদাতা, ফলে সেখানকার দেখাদেখি পাল্লা দিয়ে শহরে আজ হৃদয়হীনতার কালচার জন্ম নিচ্ছে। আধুনিক সমাজে মানবতা ও হৃদয়ের উষ্ণতা বলতে কোন কিছুর আর লেশমাত্র নেই। আমরা যে স্বার্থান্বেষী হয়ে উঠেছি কেবল নিজের কথা ভাবতেই বিভোর, এখন অন্যের জন্য কথা বলার সুযোগ কই? তবে অতীতের তুলনায় আমরা যে অনেক বদলে গেছি তা কে অস্বীকার করতে পারে?
আজ মানুষ প্রতিবেশীদের ব্যাপারে বেশী খোঁজখবর নেওয়া এক ধরনের আনকালচার্ড প্র্যাকটিস বলে মনে করেন। তাই তারা এই অভব্য কাজে বিরত থাকতেই পক্ষপাতী। গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও ক্যারিয়ার সচেতনতা এখন অনেক বেশী। আর তাই পাড়ায় পাড়ায় বসে খই ভাজতে যাবে কোন দুঃখে। আর তাতেই গ্রামীণ সংঘবদ্ধতার অপমৃত্যু ঘটছে। গ্রামীণ জীবনে এটা একটা বড় ঘটনা। যেন যা হচ্ছে, তা হোক না, তাতে আমরা কি করবো? এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি আজ সর্বত্র। আগে এক নিমিষে এক পাড়ায় বসে অন্যপাড়ার ঘটনা, রটনা, মুহূর্তেই জানা হয়ে যেতো, এখনকার মতো ‘যার যার তার তার’ ভাবটা মোটেই ডানা মেলতে পারিনি। এর ফলেই লোপ পাচ্ছে গ্রামের অতীত বৈশিষ্ট্য।
আগে গ্রামে নতুন জামাই এলে তাকে ঘিরে যে আনন্দ সেকালে দেখেছি এখন তা আর নেই। তখন প্রত্যেক পরিবারেই ছিল আতিথেয়তার ব্যবস্থা। এমনকি পাড়া বেড়ানোর নামে নতুন জামাইকে নিয়ে এক বাড়ির সংগে অন্য বাড়ির আতিথেয়তার পাল্লা চলতো, আজ সে সবের অবলুপ্তি অত্যন্ত লক্ষণীয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে প্রাণের স্পন্দন, পাড়ার অন্যতম নিদর্শনের যে ঐতিহ্য ছিল আজ তা ক্রমেই ¤্রয়িমান হয়ে পড়েছে। কেউ এখন কবির সংগে সুর মিলিয়ে বলে না ‘তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়ে’?
গ্রামীণ গৌরব, পাড়াতুতো শব্দটিও এক ধরনের আত্মীয়তার বন্ধনকে তুলে ধরতো। নিজের বিপদে আপদে, পাড়ার লোকের সংগে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও, সময়ে অসময়ে এক অপরের প্রয়োজনে যেভাবে সাহায্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তো তা আজ অনেকটাই কমে এসেছে। সত্যি বলতে কি সাহায্যের জন্যে যে অনুভূতি আজ আর তা দেখতে পাওয়া যায় না। আধুনিক মানুষ যত বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে, সে তার নিজের পরিজনদের থেকে তত বেশী দুরত্ব গড়ে তুলেছে। ছড়িয়ে থাকলে আজ আর কেউ জড়িয়ে থাকছে না। আজ গ্রামের প্রতিটা মানুষই খন্ড খন্ড ভুখন্ডের বাসিন্দা। হৃদয়ের সে স্নেহের উত্তাপ বাষ্প হয়ে মিলে গেছে। একই গ্রামে, একই পাড়ায় বসবাস করলেও আপাত:দৃষ্টিতে তারা সবাই আলাদা আলাদা।

আধুনিক হবার উদগ্র বাসনায় আমরা ভোগলিপ্সু হয়ে যত পাচ্ছি, হারাচ্ছি তার চেয়ে বেশী। গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় পাড়া সংস্কৃতির এই পরিবর্তন নিয়ে যেমন খেদ প্রকাশের অবকাশ রয়েছে তেমনি এটা কেবল বাংলাদেশেই ঘটছে বলে মনে না করে এর যে আন্তর্জাতিক চরিত্রও রয়েছে তা মনে রাখা দরকার। যে ছেলেটা গ্রাম থেকে কর্মসংস্থানের জন্য একা শহরে গেল, কিংবা বিদেশে পাড়ি জমালো সেখানে তাকে একাই সব সমস্যার মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ফলে তার ভিতরে সংঘবদ্ধ জীবনের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাচ্ছে। সে যখন গ্রামে ফিরে আসছে তখন সমাজ, গ্রাম, পাড়ার প্রতি তার এক ধরণের নির্লিপ্ততা পরিলক্ষিত হয়। উপযাচক হয়ে খোঁজ খবর নেওয়া সে হয়তো দীর্ঘদিনের একাকীত্বের ফলে আর পছন্দ করেনা। পুরাতন বন্ধু বান্ধবকে কিংবা প্রতিবেশীদের প্রয়োজন সে এখন আর মনে করেনা। বাস্তবতার সংগে আবেগের যে কোন মূল্য নেই, সেটা সে রপ্ত করেছে। অতএব একালে এমন মানসিকতা তৈরী হওয়াটা অনিবার্য পরিণতি। আর তা আন্তর্জাতিক প্রবণতার সংগে সংগতি রেখেই ঘটে চলেছে, নিয়ত বিরামহীনভাবে। গ্রামীণ যাপিত জীবনের যে বৈশিষ্ট্যগুলো সেকালে বিদ্যমান ছিল একালে তা অবলুপ্ত হবার মাধ্যমে একদিকে যেমন শহরকেন্দ্রিক নানান সুযোগ সুবিধা বাড়তে থাকে তেমনিভাবে মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্কের বদল ঘটে অনিবার্যভাবে। আর তাতে সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হয় মানুষের সমষ্ঠিগত ও সংঘবদ্ধ জীবন।
নগরায়ণের ফলে মানুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টি হওয়াতে ‘হাত বাড়ালেই সব কিছু পাওয়া যায়’ এমন অবস্থায় তার অন্যের উপর নির্ভর করার তেমন প্রয়োজন পড়ে না। সে নিজেই নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক, নির্ধারক হতে পারে। আর তার থেকেই মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে যৌথ জীবনযাপনের প্রতি অনীহা। গ্রামের মানুষ সংঘবদ্ধ জীবন যাপনে অভ্যস্তÍ ছিল। স্বচ্ছলতা-অস্বচ্ছলতার থেকেও মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ানোর যে প্রবণতা সেটা ছিল ঈর্ষণীয়। তার মানে এই নয় যে, মানুষ বর্তমানের তুলনায় কম স্বার্থপর ছিল। স্বার্থপর কথাটির অর্থ হলো নিজের স্বার্থকে অপরের বা সবার স্বার্থ থেকে বড় করে দেখার মানসিকতা। অতীতে মানুষ কম স্বার্থপর ছিল এবং এখন তা বেশী হয়েছে এমনটা ভাববার কোন কারণ নেই। তখনও গ্রামে সুদখোর মহাজনদের কাছে ঋণের দায়ে মানুষ তার জমিজমা ভিটেমাটি হারিয়েছে, আজ সে সব মহাজন সুদখোরদের দায়-দায়িত্ব হয়তো এনজিও কিংবা ব্যাংক ওয়ালারা নিয়েছে। তবে শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে অশিক্ষিত, নিরক্ষর গ্রামের মানুষকে আর আগের মত সর্বশান্ত হতে হচ্ছে না। অতীতে মানুষের জীবন এত বেশী পর নির্ভরতা ছিল যে, তাদের পক্ষে অপরের উপর নির্ভর না করে কোন উপায় ছিল না। প্রতিটা মুহূর্ত যেন উঠতে বসতে মানুষ পরের উপর নির্ভর হতে বাধ্য হত। আর তার জন্যেই তখন সমাজবদ্ধ বা সংঘবদ্ধভাবে বাস করতে বাধ্য হয়েছে।
এখন একজন আরেক জনের উপর কম নির্ভরশীল, আজ সে যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল, মানুষও তাই যান্ত্রিক হতে বাধ্য হচ্ছে। সাধারণভাবে আমরা যা মনে করি, আগে মানুষ কম-স্বার্থপর ছিল বলে সমাজ টিকে ছিল, এখন আমরা অহং-সর্বস্ব তাই গ্রামীণ জীবনে সমাজের অবলুপ্তি ঘটেছে এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। আর এ ধারণার উদ্ভব আমাদের ভাবাবেগ থেকে। আগে মানুষ তার নিজের স্বার্থেই সংঘবদ্ধভাবে সমাজকে আঁকড়ে ধরেছিল। এখনকার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের জন্য ভোগবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদিত পণ্য হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে। ফলে স্বাবলম্বী মানুষ অর্থের বিনিময়ে সবকিছুই রপ্ত করতে পারছে। এটা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চলতেই পারে তবে সমাজের সংগে নিবিড় সম্পর্ক রেখে সমষ্ঠিগত বা পাড়াগত জীবন যাপনে অংশ নেবো কি নেবো না তা সবটাই আজ প্রয়োজন নির্ভর ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করছে। এই যে পরিবর্তন আমাদের দেশে এক দু’দশক ধরে শুরু হয়েছে পৃথিবীর উন্নত দেশে তা প্রায় শতাব্দী ধরেই চর্চিত হয়ে আসছে। ফলে আমরা তাদের আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর বলে মনে করে থাকি। যদি সেখানকার শহর নগর, কিংবা গ্রামের সামাজিক পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করি সেখানেও কাংখীত দ্রব্য সুলভে সহজে পাওয়ার চিত্রটাই সহজে ভেসে উঠবে।
আজ গ্রামীণ জীবনের পাড়ার সমষ্ঠিগত প্রেরণার যে অবলুপ্তি তাতে এক ধরনের বিষন্নতা আনে বৈ-কি। সামাজিক প্রয়োজনেই একদিন একাত্মতায় ভরা গ্রাম আজ বিচ্ছিন্ন, নিঝুম দ্বীপ। এর বাসিন্দারা আজ একজন অন্যজনের অচেনা-অথচ কিছুদিন আগেও পাড়ায় পাড়ায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দুর্গাপূজা, যাত্রাগান, পালাগান, ঈদ, গ্রাম্যমেলার আসর বসতো। তখন এত দলাদলি ছিল না। বিশেষ বিশেষ উৎসবে এক বাড়ির কিংবা এক পাড়ার খাবার অন্য বাড়ি বা অন্যপাড়ায় অনায়াসে পৌঁছে যেতো। পাড়া প্রতিবেশীরা দল বেঁধে পূজাপার্বনে যেমন অংশ নিত যাত্রাগানেরও আয়োজন হত সঙ্গবদ্ধভাবে। শীতের দিনে তো গ্রাম্য বনভোজনের যা আধুনিক যুগের “পিকনিকেরও” চল ছিল। তাছাড়া গ্রামীণ খেলা যেমন হাডুডু, দাঁড়িয়াপাল্লা, ফুটবল, ঘোড়াদৌঁড়, ষাড়ের লড়াই, নৌকাবাইচ এসবের আয়োজন গ্রামকে মাতিয়ে রাখতো। গ্রামে এসব শুরু হবার আগে থেকেই অতিথিদের ভিড়ে গ্রাম একরকম জমজমাট হয়ে থাকতো। ছোট খাটো দোকানীরাও এসবের জন্য বিশেষ করে মেলায় বা বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে পসরা সাজিয়ে বসতো। যা গ্রামবাসীদের একত্রিত করার মাধ্যম ছিল। এখনও এসব গ্রামীণ জীবন থেকে হারিয়ে যায়নি, অর্থাৎ মরেনি এর শ্বাস-প্রশ্বাস এখনও রয়েছে। হয়তো যৌবনের সে তেজী ভাব আর নেই। আমাদের মত মধ্যবয়সী মানুষের মনে তাই হয়তো সুক্ষ্ম বিষাদের যন্ত্রণা দগ্ধ করে বৈ-কি।
এহেন পরিবর্তনের কারণ কি? সত্যি কথা বলতে কি গ্রামের মানুষের জীবনে এখন আর অবসর সময় বলে কিছু নেই। দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা বেড়েছে। বেড়েছে নানান ধরনের প্রয়োজনবোধ, যা আবার ভোগবাদী সমাজে একে অপরের টেক্কা দেওয়ার মানসিকতা থেকে জন্ম নিচ্ছে। এরও মূল কারণ ভোগবাদ। দৈনন্দিন জীবনের নতুন নতুন রকমারী জিনিস, প্রযুক্তিগত ধ্যান-ধারনায় আমূল পরিবর্তন মানুষের কাছে ‘একান্ত প্রয়োজন’ বলে পরিগণিত হচ্ছে। আর তা চরিতার্থ করতে মানুষকে প্রতিনিয়ত উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে, যাতে লোপ পাচ্ছে সংঘবদ্ধ জীবন, হারাচ্ছে আড্ডার পরিবেশ। সময় নেই বৃথা কাজে মনোনিবেশ করার, আগে গ্রামে একে অপরের সাহায্য করার মধ্যে মানুষ তৃপ্তি অনুভব করতো, আজ তারা তা করে না।
বর্তমান অবস্থায় তৃপ্তি আছে ভোগে, সরল, সহজ অনাড়ম্বর যৌথ জীবনে মানুষ আজ আনন্দ খুঁজে পাই না। কারণ আধুনিক জীবনের প্রবাহ বৈচিত্র্যে বৈচিত্র্যহীনতায় আবদ্ধ থাকতে চাই না। যার জন্য আধুনিক মানুষ একলা চলতে বেশী উৎসাহী। সকলকে নিয়ে একসংগে বাস করা মান্ধাতা মনোবৃত্তি। গ্রামে সংঘবদ্ধতার সংস্কৃতিতে এক ধরণের সাম্যতা পরিলক্ষিত হতো, আজ স্বতন্ত্রবোধের জন্য যে আধুনিকতা, যা বৈচিত্র্যের দিশারী সেই বৈচিত্র্যইতো মানুষের সামনে প্রগতির সুযোগ নিয়ে এসেছে। প্রগতির যারা বার্তাবাহক, সময় বিশেষে তারা অপসংস্কৃতির ধারক বলে পরিগণিত হয়েছিল। সময়ের পরিবর্তনে একদিন তাই-ই সমাজে সংস্কৃতি বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। আর তাই প্রতিটা সমাজের প্রগতির অধ্যায় এক এক রকমের। সে জন্য অন্য সমাজের হঠাৎ কোন অন্ধ অনুকরণ বেমানান, যা মানানসই হতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। এটা জীবনের রূপ বদলানোর মত মানব সম্পর্কের একটা নতুন দিক আত্মপ্রকাশ আর কি? গ্রামের বৈশিষ্টের অস্তিত্বহানির বিনিময়ে শহরের যে অগ্রগতি ঘটছে তা তো কম কথা নয়? আগেই উল্লেখ করেছি এটা আন্তজার্তিক প্রবাহ। শহর যত বাড়বে শহুরে সংস্কৃতির আগ্রাসনে গ্রামকে গিলে খাবে। মানুষ যত আধুনিক হবে তত বেশী নৈর্ব্যক্তিক হয়ে উঠতে বাধ্য হবে। সমস্তটাই সামাজিক পরিবর্তন মাত্র। গ্রামীণ জীবনে যৌথ ঐতিহ্যের ভবিষ্যৎ বড় অন্ধকারাচ্ছন্ন। অন্ধকারের ঘেরাটোপ ছাড়া সাদা চোখে আজ আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হবে না।
এই অবস্থায় একদিকে শহর যেমন আধুনিক ও গতিময় হয়ে উঠবে, তেমনি অন্যদিকে মানুষও এই সামাজিক আবর্তে শুকনো হৃদয়হীন হয়ে উঠবে। হৃদয়ের সংগে হৃদয়ের যোগসূত্র ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হবে। আত্মজের অনুপস্থিতিতে পিতৃহৃদয় কিংবা মাতৃহৃদয় যতই বিচলিত হোক না কেন, প্রয়োজনয়ে তাদের কোলছাড়া করবে তা রুখে দেবার ক্ষমতা গ্রামীণ সমাজের আর থাকবে না। চিরায়ত নিয়মে সব বেমানানই একদিন মানানসই হয়ে যাবে। বয়োবৃদ্ধরা পথের দিকে তাঁকিয়ে দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলেই হতাশ হবেন, প্রতিবেশী অতি উৎসাহীরা হয়তো টিপ্পনী কেটে বলবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া না শিখালে কাছেই থাকতো, আজ পড়ন্ত বেলায় কেউ পাশে নেই। অতৃপ্তির এ পাহাড় সমবেদনায় মানুষ যতই আক্ষেপ করুক না কেন গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় যৌথপরিবারের কিংবা পাড়ার সংঘবদ্ধতার ঐতিহ্য আর কোনদিন ফিরে আসবে না তা বলাই বাহুল্য। অন্তরের ভাবাবেগ, দেওয়া নেওয়া যা ঐতিহ্যের মূল ভিত্তি ছিল তা আজ উঠে যেতে বসেছে। তবে হ্যাঁ সমাজে, পাড়ায়, কিছু হৃদয়বান মানুষ থাকবেন যাদের গ্রাম অন্ত প্রাণ, রাজনীতির শত কূটচালেও অন্যের মঙ্গল চিন্তায় ঘরের খেয়ে বনের মেষ তাড়িয়ে আনন্দ পাবেন। কিন্তু তাদের ভূমিকা হবে একমুখী যা অন্য মানুষের সহযোগিতার অভাবে কখনোই সমাজকে সেভাবে ঐক্যবদ্ধকরে তুলতে সাহায্য করবে না, বরং তাদের সুন্দর স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটবে। প্রতি পদে পদে বাধাগ্রস্থ হয়ে একদিন তারাও হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। ভবিষ্যতে অনাগত দিন আসবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের দাপটে দরজা বন্ধ করে আমার “আমিত্বকে” জাহির করবে। যেখানে দশে মিলি করি কাজ- হারি জিতি নাহি লাজ এসব শুধু আপ্তবাক্য হিসাবেই মানুষ জানবে, বাস্তবে তার কোন প্রয়োগ থাকবে না।
(লেখক, কুয়েত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা)