শেখ মহিতুর রহমান বাবলু, লন্ডন, যুক্তরাজ্য
বৈরী আবহাওয়ার কারণে বৈশাখ ফুরিয়ে যাবার অনেক দিন পর হলেও প্রতিবছর পূর্ব লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয় বৈশাখী মেলা। ৩০ জুন রোববার টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের উদ্যোগে এবারও গতানুগতিকভাবে পূর্ব লন্ডনের উইভার্স ফিল্ডে মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে ।
এটা কেবল লন্ডন বা ব্রিটেন নয়। সমগ্র ইউরোপের সবচাইতে বড় ও আকর্ষণীয় মেলা। ইউরোপের অন্যান্য দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা সারা বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে টাওয়ার হ্যামলেটে অনুষ্ঠিত বৈশাখী মেলা দেখার জন্য। এ অঞ্চলের ব্যাবসায়ী মহল, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিমনা এবং সাধারন মানুষও বৈশাখকে সামনে রেখে মেতে ওঠে এক ভিন্ন আমেজে।
কিন্তু দিন দিন গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই প্রাণের উৎসব। জৌলস হারাচ্ছে টাওয়ার হ্যামলেটের বৈশাখী মেলা। অনেকের মতে টাওয়ার হ্যামলেট বৈশাখী মেলার সেই সোনালী দিন আর নেই। অদৃশ্য পাখার ঝাপটায় বিপর্যয় নেমেছে মেলায়। ছোট হয়ে আসছে মেলার পৃথিবী। স্মৃতির অলিন্দে ঠাঁই নিচ্ছে বাংলাদেশের ঐতিহ্য বৈশাখী মেলা। মেলার এই চরম ও পরম দুর্দিনে অনেকের মনের বিনায় বাজতে শুরু করেছে এ অঞ্চলের সাবেক মেয়র লুৎফর রহমানের কথা।

টাওয়ার হ্যামলেটস্ কাউন্সিলের বাংলাদেশি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের বাংলা নববর্ষের বৈশাখী মেলা শুরু হয় প্রায় দুই যুগ আগে। এসময়ে মেলার খবর বিবিসি সহ ব্রিটেনের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হতো ।স্থানীও বাংলাদেশী গণমাধ্যমগুলিকেও দৃশ্যমান ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে । টেলিভিশনগুলো মেলার সম্পূর্ণ কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করতো । ফলে দেশ বিদেশ থেকে মেলায় নামতো মানুষের ঢল। যারা আসতে পারতো না তারা টিভির সামনে বসে সরাসরি অনুষ্ঠান দেখতো। এখন মিডিয়া অবহেলিত। তাই মূল অনুষ্ঠানের ব্যাপারে পুরোটাই হতাশ বাংলাদেশি কমিউনিটি।
খুব বেশীদিন আগের কথা নয়। কয়েক বছর আগেও যে ধরনের বৈশাখী মেলা উদযাপন হতো লন্ডনে এখন আর সে ধরনের মেলা হতে দেখা যায়না। এ মেলাকে ঘিরে বিগ বাজেটর কোনো কমতি নেই । কিন্তু দক্ষ জনশক্তি, প্রচার ও প্রসারের কারণে মেলা তার প্রাণ হারিয়েছে। হতাশা নেমেছে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে।
বছর দুই আগেও বৈশাখী মেলার মিডিয়া পার্টনার থাকতো স্থানীয় কোনো টিভি চ্যানেল ।তারা মাসব্যাপী মেলার প্রচার ও প্রসারের জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে যেত। ইউরোপের প্রতিটা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতো মেলার আমেজ । মেলার দিন ব্রিটেনের অন্যান্য শহরে ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশিরা টিভির সামনে বসে সরাসরি উপভোগ করতো টাওয়ার হ্যামলেট বৈশাখী মেলা। বিশেষ করে এ দিনটি উৎযাপন উপলক্ষে অনেকে ছুটি নিয়ে ও ব্যবসা বন্ধ করে ছুটে আসতো মেলা প্রাঙ্গনে। টিভিতে সরাসরি প্রচারিত অনুষ্ঠান দেখতো বাকিরা । এখন এ সুযোগ আর নেই।এতে করে প্রাণ হারিয়ে ফেলছে মেলা। প্রযুক্তির এই স্বর্ণ যুগে মেলা কতৃপক্ষ কেন প্রচার বিমুখ এ প্রশ্ন আজ অনেকের ।
এ প্রসঙ্গে কাউন্সিলের সাবেক নির্বাহী ডেপুটি মেয়র ওহিদ আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে মেলা পরিচালকদের বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় বৈশাখী মেলা নামেমাত্র অনুষ্ঠিত হচ্ছে।’ সংস্কৃতি বিচারে এটাকে বৈশাখী মেলা বলা যায় না উল্লেখ করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এমনকি এ মেলায় গণমাধ্যমের কোনো অংশগ্রহণ নেই। কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ সংবাদপত্রের নজর কাড়তে ব্যর্থ হয়েছে। আগে যেভাবে মেলা উদ্যোক্তা পক্ষ বিজ্ঞাপন দিয়ে নানাভাবে প্রচারণা চালাতেন এবং সাংবাদিকদের সম্পৃক্ত করতেন বর্তমানে তা করা হচ্ছে না।ফলে মানুষ জানতেই পারছেন মেলা সম্পর্কে’
এদিকে মূলধারার ইংরেজি সংবাদপত্রে বলা হচ্ছে , নির্লজ্জ দুর্নীতি এবং কমিউনিটির স্বার্থপর শ্রেণীর নানা কোন্দলে এই ঐতিহ্যবাহী মেলার প্রতি অন্তত ৫ লক্ষ মানুষের আকর্ষণ হারিয়েছে।বহুজাতিক সংস্কৃতি প্রেমী ব্রিটিশ মূলধারার জনগোষ্ঠীর কাছেও বৈশাখী মেলা ছিল অনন্য বিনোদনের মেলবন্ধন। আজ সকলেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে মেলা থেকে।
অপরদিকে মেলায় ব্যবসার উদ্দেশ্যে যারা স্টল নিয়েছিল তাদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজ করছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ মেলা কমিটির ওয়েবসাইট ছাড়া অন্য কোনো বাড়তি প্রচার না থাকায় মেলায় লোক সমাগম যথেষ্ট হয়নি। এতে করে তারা ব্যাপক লোকসানের মধ্যে পড়েছে। অনেকে বলছে তাদের বিনিয়োগের মূল পুঁজির অর্ধেকের চাইতে বেশি ক্ষতি হয়েছে।এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে মেলায় অংশগ্রহণ করার কোনো আগ্রহ থাকবে না বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে।
এবারের মেলায় স্টল বরাদ্দ পাওয়া নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নীরব অভিমান। ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে স্টল বরাদ্দ নিয়ে।নিয়মনীতি উপেক্ষা করে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান স্টল পেয়েছে এমন অভিযোগ ব্যাবসায়ীদের ।যাদের অনেকে নিজেরা স্টল ব্যবহার না করে মেলার দিন অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে চড়া দামে সেটা বিক্রি করে দিয়েছে। এদিকে কিছু প্রতিষ্ঠান বিগত দুই বছর যাবৎ আবেদন করেও একটি স্টলও বরাদ্দ পায়নি । আবার মেলা প্রাঙ্গনে গিয়ে দেখা গেছে খালি পড়ে আছে অনেক ষ্টল।
এতদিন বৈশাখী মেলার মূল আকর্ষণ ছিল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের শিল্পীর অংশগ্রহণ।এছাড়া কমুনিটিতেও রয়েছে অনেক গুণী শিল্পী।তাদের গ্রহণযোগ্যতাও কম নয়।কিন্তু বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের কোন শিল্পী এবারের মেলায় ছিল না। স্থানীও শিল্পীদেরও অনেকে কেন এ মেলায় আমন্ত্রণ পাননি এ কথা কারো বোধগম্য নয়।বিপুল অর্থ খরচ করে বাংলাদেশ থেকে এবার আনা হয়েছে ব্যান্ড সংগীত শিল্পী ইমরান, লোকসংগীত শিল্পী লাভলি দেব ও বেলি আফরোজ।এদের নামও অনেকের অজানা।এসব ব্যাপারে মেলা কতৃপক্ষের সাথে টেলিফোন কথা বলার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেও দায়িত্বশীল কারো সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
প্রবাসের কর্মব্যস্ততা এবং জীবন সংগ্রামে সবাই হাঁপিয়ে ওঠে। বিদেশি সংস্কৃতির মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে নিজস্ব শেকড় সন্ধানের মধ্যে কিছুটা আত্মতৃপ্তি খুঁজে ফেরে । আমাদের আগামী ও নতুন প্রজন্মের কাছে নিজেদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য বড় মাধ্যম এই পহেলা বৈশাখ। ছেলে-মেয়েদেরকে বলা হয়, এটা তোমার পিতৃপুরুষের আদি উৎসব। বাংলাদেশিরা তার নিজস্ব জাতি সত্ত্বার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য যতগুলো উৎসব পালন করে তার মধ্যে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা অন্যতম।
বিজ্ঞানের জয় জয় কার এ বৈষ্যয়িক যুগে পৃথিবীর উন্নতসব দেশের সাথে বাংলাদেশও তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবে তাকে কোন ভাবেই না বলবোনা।কিন্তু তাই বলে আমাদের নাড়ির টান, শেকড়ের কথা ভুলে গেলে একেবারেই চলবেনা। আমাদের হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম অনেকগুলো লোকজ ঐতিহ্যের মধ্যে বৈশাখী মেলা অন্যতম।সুতরাং বাংলাদেশিদের প্রাণের উচ্ছলতা কে বাদ দিয়ে হিন্দি গান ,বিদেশী নাচের কোনো স্থান বৈশাখী মেলায় হতে পারেনা।যা এবার হতে দেখা গেছে। সে জন্য টাওয়ার হ্যামলেটস্ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা এখন সময়ের দাবি। মিডিয়ার এ সুবর্ণযুগে প্রচার মাধমের গুরুত্ব আমলে আনা দরকার ।তাছাড়া এ দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে যদি বাংলাদেশী আন্তর্জাতিক মানের শিল্পী ও স্থানীয় গুণী শিল্পীদের প্রধান্য দেন আয়োজকরা, মেলার আয়োজক কমিটিতে স্থান করে দেয়া হয় যোগ্য লোক তবেই আবারও প্রাণ ফিরে পেতে পারে পহেলা বৈশাখের হারানো দিন ।