চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল নাগাদ সমগ্র আমেরিকায় সাড়ে ১১ হাজারেরও বেশি নরহত্যা সংঘটিত হয়েছে বলে জানা যায়। আর জাতীয় পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত নিউইয়র্কে অবৈধ হত্যাযজ্ঞ বন্ধ এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের অভিনব পদক্ষেপ হিসেবে স্টেট এটর্নী জেনারেল জেমসের দপ্তর উইকএন্ড’স গান বাইব্যাক প্রোগ্রামের আওতায় গিফট কার্ডের বিনিময়ে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে এবং একই দিনে অ্যাসল্ট-স্টাইল রাইফেল ও ঘোস্ট গান মিলিয়ে ৩ সহস্রাধিক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র জমা করেছে। ব্রুকলীন ডিস্ট্রিক্ট এটর্নী এরিক গঞ্জালেস জানান যে, ফেরত দেয়া প্রতিটি অ্যাসল্ট-টাইপ রাইফেল এবং ঘোস্ট গানের বিপরীতে প্রত্যেককে ৫০০ ডলারের এবং প্রতিটি হ্যান্ড গানের বিপরীতে ১৫০ ডলারের গিফট কার্ড দেয়া হয়েছে। এদিকে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় দেড় বছরাধিক বাকি থাকলেও ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গন যথেষ্ঠ সরগরম হয়ে উঠছে। বিশেষত ২০২০ সালের নির্বাচনে ডেমক্র্যাটিক দলীয় সর্বস্তরের নেতা-কর্মী-শুভানুধ্যায়ী এবং অত্যুৎসাহী ভোটারদের সক্রিয় সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় বিজয়ী বাইডেন-হ্যারিসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার বিস্তারিত ফিরিস্তি সর্বমহলের নজর কাড়ছে। স্মর্তব্য, ২০২০ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলতে গেলে এককভাবেই লড়েছিলেন আমেরিকার পুরো ডেমক্র্যাটিক পার্টি, অভিবাসী সম্প্রদায় এবং অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। আর নির্বাচনের পর থেকেই বিজিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে একের পর মামলা-মোকদ্দমা-আইন-আদালতের গন্ডি মাড়াতে হচ্ছে হরহামেশা। অন্যদিকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে আহামরি ধরনের চমক সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছেন। সীমান্ত নিরাপত্তা প্রাচির নির্মাণের স্থলে সীমান্ত ব্রিজ নির্মাণ, অবৈধদের বৈধতা প্রদানের লক্ষে বিদ্যমান অভিভাসন আইনের ঢালাও সংস্কার, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়ন, দাঙ্গা-হাঙ্গামা নির্মূল, সহিংসতার মূলোচ্ছেদ, শ্রেণী বৈষম্য বিলোপ, আত্মহত্যার প্রবণতা হ্রাস ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বাইডেন-হ্যারিসের কর্মকান্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ঝড় বইছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি, কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি, ম্যাস শ্যুটিং, বেকারত্ব ইত্যাদি বাইডেন প্রশাসনের জন্য বড় ধরনের অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বস্তুত আত্মহত্যা, আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানি এবং ম্যাস শুটিং বাইডেন প্রশাসনের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এহেন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে মমস ডিম্যান্ড অ্যাকশন লিখা সম্বলিত লেবাসধারী সাম্প্রতিক স্কুল শুটিংয়ের শিকার ডেনভার হাই স্কুলের শিক্ষার্থীগণ এবং ২০১২ সালে অরোরা থিয়েটারের ম্যাস কিলিংয়ে নিহত মহিলার অভিভাবকবৃন্দের সরব উপস্থিতিতে কলরাডোর গভর্নর জারেড পলিজ ২৮ এপ্রিল বন্দুক নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট ৪টি বিলে স্বাক্ষর করেছেন। পক্ষান্তরে ডেমক্র্যাটিক দলীয় গভর্নর পলিজের আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট বিলগুলোতে স্বাক্ষরের কয়েকদিন পূর্বেই ইউ.এস সুপ্রিম কোর্ট সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট রাইটস সম্প্রসারণের সপক্ষে রুলিং দিয়ে বাইডেন প্রশাসনের জন্য লেজে-গোবরে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
সম্প্রতি কলরাডোসহ সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি, আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে নির্বিচারে মানুষ খুন বা ম্যাস শ্যুটিং বেড়েই চলেছে। তাই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবং সুদীর্ঘকাল ধরে আইনগত সুরক্ষা পাওয়া আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদনকারী কল-কারখানার বিরুদ্ধে সহিংসতার শিকারদের ক্ষতিপূরণ মামলা রুজুর পন্থা উদ্ভাবনের লক্ষেই গভর্নর পলিজ গান কন্ট্রোল বিলগুলোতে স্বাক্ষর করেছেন বলে জানা যায়। গভর্নর পলিজ স্বাক্ষরিত বিলের আওতায় আগ্নেয়াস্ত্র ক্রেতার বয়স সর্বনিম্ন ১৮ বছরের স্থলে ২১ বছর লাগবে এবং বন্দুক ক্রয়ের পর ক্রেতার অতীত ইতিহাস যাচাই-বাছাইর জন্য ৩ দিন শেষে আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করা হবে। আগ্নেয়াস্ত্র ক্রেতার সর্বনিম্ন বিষয় ১৮ বছরের স্থলে ২১ বছর করায় ৩ বছর আগে কার্যকর হওয়া ক্যালিফোর্নিয়া, ডেলাওয়ার, নিউজার্সী, নিউইয়র্ক, হাওয়াই এবং রোড আইল্যান্ডসহ অপর কয়েকটি স্টেটের তালিকায় স্থান পেতে যাচ্ছে কলরাডো। সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের উদ্ধৃতি দিয়ে উক্ত আইনটির প্রবক্তাগণ বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে যত টীনেজার সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে তার চেয়েও বেশি সংখ্যক প্রাণ হারিয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতায়। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ অ্যাক্টিভিস্ট, বিলগুলোর উদ্যোক্তা ডেমোক্র্যাটিক দলীয় সিনেট প্রেসিডেন্ট স্টিভ ফেনবার্গ এবং স্বাক্ষরদান অনুষ্ঠানের উৎসুক জনতার উদ্দেশ্যে গভর্নর পলিস বলেন, আমাদের কমিউনিটি, বিদ্যালয়, গ্রোসারী স্টোর এবং নাইটক্লাবসহ সর্বক্ষেত্রে এবং স্তরে কলরাডোর জনগণ যাবতীয় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায়। এ সময় বিলের সমর্থক আইনপ্রণেতা, ভিকটিমদের স্বজন ও জনগণ অশ্রুসিক্ত নয়নে উদ্বাহু বাড়িয়ে গভর্নরের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে সিনেটর প্রেসিডেন্ট ফেনবার্গ বলেন, মেঘে মেঘে বেলা বহুদূর গড়িয়ে গেছে এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে আমাদের আরও অনেক করণীয় রয়েছে বলে মন্তব্য করেন ফেনবার্গ। গভর্নর স্বাক্ষরিত তৃতীয় বিলটি স্টেটের বিদ্যমান রেড ফ্ল্যাগ ল (লাল পতাকা আইন) কে শক্তিশালী করবে। আত্মহত্যা কিংবা আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে অন্যের উপর হামলা চালনার পূর্বেই আগ্নেয়াস্ত্রধারীর অস্ত্র জব্দ করার মুখ্য উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই প্রণয়ন করা হয়েছে রেড ফ্ল্যাগ ল তথা চরম ঝুঁকি প্রতিরক্ষা আদেশ (এক্সট্রিম রিস্ক প্রটেকশন অর্ডার)। কথিত আইনটি উঠতি বয়সী এবং প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে কর্মসূত্রে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত চিকিৎসক, মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী এবং শিক্ষকগণকে কোন আগ্নেয়াস্ত্রধারীর আগ্নেয়াস্ত্র সাময়িকভাবে অপসারণের লক্ষ্যে জাজ বা বিচারকের নিকট আবেদন করার বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করবে। ইতোপূর্বে পরিবারের সদস্যবর্গ এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাগণ এ ধরনের আবেদন জানানোর ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন। উল্লেখ্য, সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের পরিসংখ্যান অনুসারে ২০২১ সালে জাতীয় পর্যায়ে আত্মহত্যার তালিকার ষষ্ঠ স্থান দখল করেছিল কলরাডো এবং এ বছর উক্ত স্টেটে ১ হাজার ৪০০ আত্মহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। এদিকে ৪টি আত্মহত্যার বিষয়াদি ভালভাবে পর্যবেক্ষণ শেষে র্যান্ড কর্পোরেশন ওয়েটিং পিরিয়ডের সাথে আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে আত্মহত্যা হ্রাসের প্রবণতার যোগসূত্র দেখতে পেয়েছে। এর বিরোধিতাকারীগণ বলেন, আত্মরক্ষার চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিরাও উক্ত ব্যবস্থায় সময়মত আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করতে পারবেন না। এছাড়া রকী মাউন্টেন গান ওনারসের নির্বাহী পরিচালক টেয়লর রোডস বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত নেতৃবর্গ বিশেষ বয়সীদের বৈষম্যের শিকারে পরিণত করেছেন।
রিপাবলিকানগণ সংখ্যালঘু নেতা রিপ্রেজেনটেটিভ মাইক লিঞ্চ গভর্নর পলিজ স্বাক্ষরিত বিলগুলোকে সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট রাইটস (দ্বিতীয় সংশোধনী অধিকারের মুখে প্রচন্ড চপেটাঘাত হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, আমরাও জাতীয় পর্যায়ে সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট পরিপন্থী স্টেটের তালিকাভূক্ত হচ্ছি। লিঞ্চ আরও বলেন, কলরাডো অঙ্গরাজ্য জুড়ে অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধির পটভূমিতে গভর্নর স্বাক্ষরিত বিল এবং ডেমক্র্যাটদের প্রণিত আইনগুলো স্থানীয় বাসিন্দাদের আত্মরক্ষার অধিকার ছিনিয়ে নিবে এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে সুইং ডিস্ট্রিক্টগুলোতে ডেমোক্র্যাটদের অভিলাষ চরিতার্থের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। মাইক লিঞ্চ বলেন, স্বাক্ষরিত বিলটি সাময়িকভাবে আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ হওয়ার আশঙ্কা বশে জনগণ বিশেষত সামরিক ভেটারণগণকে মেডিকেল ডাক্তার কিংবা মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের অকপটে কথা বলতে নিরুৎসাহিত করবে। স্মর্তব্য, আগ্নেয়াস্ত্র ক্রয়ের পর ৩ দিন পর তা সরবরাহের বিধান ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা এবং হাওয়াইসহ অপর ৮টি স্টেটে চালু রয়েছে এবং কলরাডো এর তালিকাভুক্ত হতে চলেছে। গভর্নর পলিজ স্বাক্ষরিত ৪র্থ বিলটি সুদীর্ঘকাল যাবত আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদন কারখানাগুলোকে আইনী সুরক্ষাদাতা বিধি-বিধানের ইতি ঘটাবে। ফলশ্রুতিতে মান্ধাতার আমল থেকে আগ্নেয়াস্ত্র কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতায় নিহতদের স্বজনদের ক্ষতিপূরণ মামলা রুজু বা আদায়ের দেন-দরবারের ব্যর্থতার ইতি ঘটবে এবং তারা প্রয়োজনীয় আইনী পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ পাবেন। স্বাক্ষরদান অনুষ্ঠানে কলরাডোর এটর্নী জেনারেল ফিল উইজার নতুন আইনগুলোকে মাদারস অ্যাগেইনস্ট ড্রাঙ্ক ড্রাইভিং, মমস ডিম্যান্ড অ্যাকশন ইত্যাদি নিরাপদ যানবাহন নীতিমালার অনুপূরক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আর গান রাইটস এডভোকেটগণ বিলগুলো বাতিল প্রচেষ্টার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। নির্বাচনী বিশেষজ্ঞদের সুচিন্তিত অভিমত, কলরাডোসহ বিভিন্ন অঙ্গ রাজ্যে গান কন্ট্রোল আইন সঠিকভাবে কার্যকর এবং ম্যাস শ্যুটিং, সুইসাডিং নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বিশেষত কলরাডোর গান কন্ট্রোল বিল বাইডেনের জন্য অগতির গতিই বটে।
সহযোগী সম্পাদক: সাপ্তাহিক ঠিকানা, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।