সৈয়দ আশরাফুল হক সুমন:
গল্পটা তোমাকে নিয়ে পুরো ১ টা দিন ৩ বেলা আয়েস করে খাইতে খাইতে বলতে পারলে ভালো লাগত।
খাবার বিষয় নিয়ে সত্য গল্প, সত্য না খাইয়ে বললে কি আর সত্য স্বাদ টা পাবে!!
এই যেমন আমি বিপত্নীক হওয়ার পর থেকেই খাওয়ার সমস্যায়।
নানান ঘাট পেরিয়ে অবশেষে থিতু হলাম আমার নাইট গার্ড এর বাড়ির খাবারে।
তিন বেলাই ভদ্রলোক দুই তিন মিনিটের হাঁটাপথ পারি দিয়ে পৌছে দেন আমার খাবার, টেবিলে। গরম গরম খাবার।
কখনো গরম কখনো নরম। শুধু সময়ের ব্যাপার।
নাস্তা দিতে দিতে কখনো সকাল নয় টা, দুপুরে নূন্যতম তিন টা আর রাতের বেলা ঐ নয় টা দশ টা।
পেটের মধ্যে যতই ছুচো বুক ডন মারুক না কেনো আমি উনার সময় মতই চলতে বাধ্য।
প্রহরীর কাজটা উনার অবসোনাল।
মূলত সবজি উৎপাদন ও বিক্রি মূল পেশা।
সকালে সবজি বিক্রি, দুপুরে বাগান পরিচর্যা, রাতে স্ত্রী কে পরিচর্যা করে তবেই আসেন আমার খাবার নিয়ে ঘুমাতে।
আমারই বা এ রুটিনের বাহিরে যাওয়ার সাধ্য কই।
তবুওতো তিনবেলা ঘরের খাবার পাচ্ছি, সেও কি কম।
মূল্য যতই দিই, একজনের খাবার সরবরাহে কি বা লাভ,
সে আমিও বুঝি।
সেকারণেই কানামামা ভালোর মত একটু এদিক সেদিক মেনে নেয়া অধমের উওম বলেই মনেকরি।
অবশ্য ফোনে বললে যে – সময়মত খাবার চলে আসে না, তা না।
সমস্যা হয় অন্য যায়গায়।
সে এক বেদনার ইতিহাস।
ফোনকলেই হোক বা সামনাসামনি বলে-কয়ে অন্যান্য সমস্যা সমাধান হলেও, সবজি উৎপাদনকারীর যে সিজনে যে সবজি উৎপাদন,
সে সিজনে সেই সবজি খাওয়ানোর সমস্যাই আসল সমস্যা।
যেমন লাউ এর সিজনে লাউ শিমের সিজনে শিম,
ফুলকপি বাঁধাকপির সিজনে একই।
লাউ শিম বাঁধাকপি ফুলকপির সিজনে জি্হবা বাঁচলেও এখন যেমন চলছে চালকুমড়া আর ধুন্দুল এর সিজন।
নিজেই উৎপাদনকারী হওয়ায় কখনো সবজি বাজার থেকে কিনে খাইতে নারাজ।
এই উচ্চমূল্যের বাজারে নিজের সবজি বাগানের বাহিরের সবজি কিনে খাওয়ার কথা ভাবতেই পারা যায় না।
ঠিক এই কারনেই তিনবেলা তোমাকে সাথে নিয়ে, খাইতে খাইতে সকাল সন্ধ্যা দুপুর গল্প টা, থুক্কু বাস্তবটা উপভোগ করাতে পারলে আমার আর বলে বুঝাতে হতো না।
ভদ্রলোক বর্তমান উচ্চমূল্যেই দৈনিক ধুন্দুল ও চাল কুমড়া বিক্রি করে বাজার থেকে ফিরে, আসেন আমার নাস্তা নিয়ে।
নাস্তায় ধুন্দুল এর ভর্তা, ধুন্দুল এর ভাজি, ধুন্দুল দিয়ে ডাল ভুনা সহ, ধুন্দুল এর আজকের বাজারের টাটকা সবজি’র মত বাজারের টাটকা গল্প নিয়ে।
শালার বাইশা (২২ জনের গ্রুপ) গ্রুপের বাটপার পাইকার আজকাও ৫ টা টেহা কম দিল স্যার।
আমার জীবনডা এই বাটপার পাইকার শেষ কইরা দিল স্যার।
আইচ্ছা কইন, আমার আগের লোক রে দিল ৩০ টেহা কইরা আর আমারে দেয় কম।
কি কইতাম আর।
সইল ডা আমার জলতাছে।
ধুন্দুল এর ভর্তা ভাজি আর ডাল ভূনা খাইতে খাইতে বলি, ক্যান কি হইল আবার।
বাদ আর কি আছে। এই শালার পুত শালারা আমার জীবন ডা শেষ কইরা দিলো।
হইছে টা কি শুনি।
কি আর অইবো।
বাজারো ঢুকতেই মালের পাতি ধইরা টাইন্যা নিলো গা একজনে।
আমি কইলাম দাম কইয়া নে।
পরে টেহা দেওনের সময় গইন্যা দেহি ২৫ টেহা কইরা।
টেহা দেইখা তো আমার চান্দি গরম।
মাহাজনের বোগলো গিয়া কইলাম, ধুন্দুল কত কইরা ??
হালার পুত হালা কয়,তরডি মোডা হইয়া গেছে।
আমি কইলাম, এই মোডার লাইগা ৫ টেহা কইরা কে জি ‘ত কম দিবাইন। হেগো দিলাইন ৩০। আমারে ২ টেহা কম দেইন।
এত কইরা কইলাম। শালার গরের শালা শুনলই না।
বাদে অনেক পিরাপিরি করাতে, আমার ৬০ টা টেহা দিল কম । কে জি তে ৩ টেহা নাই।
জীবন ডা আমার শেষ।
ধুন্দুল এর ডাল ভূনা দিয়ে খাওয়া শেষ করে বললাম,
নিলেন কেন??
আমার ধুন্দুল ডা একটু মোডাই।
গেছে কাইল বৃষ্টির জন্য ধুন্দুল কাটপার পারিনাই।
দেখলেন না, গেছে কাইল সকাল সকাল নাস্তা দিয়া গেলাম।
কাইলকার ধুন্দুল টা খাইতে মিস্টি মিস্টি লাগছে না।
এইডা কচি ধুন্দুল এর গুন।
আজকার ডা একটু মোডাঅই। ভর্তা কইরা দিছে দেহুইন না !
ঠিক আছে সমস্যা নাই।
জান তাহলে।
দুপুরে দেখা হবে,
বলে ধুন্দুল এর বাটি আর ভাতের বাটির অবশিষ্ট সহ হাতে ধরিয়ে দিলাম।
আজ বাহিরে কাজ নেই,
তাই বাসায় অলস সময় কাটাচ্ছি।
শুয়ে বসে সময় আর কতক্ষন কাটে।
পত্রিকা’র পাতা দুই তিনবার এদিক সেদিক করতে করতেই দেখি, সালাম ভাই আজ দুইটার মধ্যে খাবার নিয়ে হাজির।
স্যার উডেন। গরম গরম খাইয়া লন।
আপনি খাইছেন?
না বাড়িতে গোসল দিয়া খামু।
তাহলে জান, গিয়ে খেয়ে আসেন।
বলে জলদি খাবার বাটি খুলে দেখি, গরম ভাতের উপর সেই ধুন্দুল ভর্তা, ভাতের এক পাশে ধুন্দুল ভাজি আর এক আলাদা বাটিতে ছোট চিংড়ি দিয়ে ধুন্দুল এর ঝোল।
আবার ধুন্দুল দেখে গেলাম ডিম ভাজতে।
কপাল এমনই যে ফ্রিজ খুলে দেখি একটাও ডিম নেই।
কি আর করা।
ধুন্দুল এ দোদুল্যমান আমার জীবন।
শুধু সকাল দুপুর নয়। সবজি উৎপাদনকারীর এ ধুন্দুলে আপ্যায়ন পর্ব পরপর আজ দুই সপ্তাহ চলমান।
গুনে গুনে ১২ দিনে আজ।
ঠিক এ কারনেই তিনবেলা একসঙ্গে খাওয়ার সহিত বিষয় টা বলতে চাইতেছিলাম। কি আর করা।
ব্যাস্ততায় বাজারও করে দেয়া হচ্ছে না বেশ কদিন।
বলতেও পারছি না যে, অন্য কোন সবজি কি কেনা যায় না ??
আবার টাকা দিয়ে উনার বিক্রির সবজি বাদ দিয়ে অন্য সবজি কিনতে বলাও খারাপ দেখায়।
আগামি কালের চিন্তা করে দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সন্ধ্যা ভ্রমন শেষে বাসায় ফিরতেই দেখি, দারোয়ানের হাতে টিফিন ক্যারিয়ার।
স্যার, সালাম ভাইয়ের দাওয়াত আছে তো, ফিরতে একটু লেট হইব। তাই আগেই খাবার দিয়া গেছে।
ঠিক আছে টেবিলে রেখে দিয়েন। বলে ফ্রেস হয়ে, সালাম ভাইয়ের দাওয়াত এর কথা শুনে মনে মনে আশা, ভালো কিছু আমার জন্যও নিশ্চই।
টিফিন কারিয়ার টা চেক করতে খুলতেই, চরকগাছ চোখ।
আরে ভাই, আপনি সপরিবারে যাচ্ছেন দাওয়াত খাইতে।
আমার জন্য নাহয় একটা ডিম ভূনা করে দিতেন।
তা না ঐ ধুন্দুল এর ভাজি ধুন্দুল এর ভর্তা আর চিংড়ি দিয়ে ধুন্দুল এর টলটইল্যা ( সালাম ভাইয়ের স্বাদের ) ঝোল।
কি আর করা, বরাবরের মত ডিমের উপরই জীবন চলমান।
রাতে ফোনে সালাম ভাই কে বলে রাখলাম, সকালে উনার সঙ্গে বাজারে যাব।
মাঝেমধ্যে ই যাই তাই উনি অভ্যস্ত।
সকালে দুজনে একত্র পাইকারি বাজারে।
আজ বাজার খুব চড়া।
শুক্র শনি রবিবার বাজার চড়াই থাকে।
৩৫ টাকা মূল্যে ধুন্দুল বিক্রি করে নতুন একটা পান চিবুতে চিবুতে এসে বললো, চলেন স্যার,
কাম শেষ।
পান মুখে দেখে বললাম, নাস্তা করব না, খুধা লেগে গেছে আর আপনি মুখে পান দিয়ে এলেন।
তো কি হইছে।
দুই চাবান দিয়া ফাল দিমু। মুখটা শুকায়ে গেছিলো।
চলেন নাস্তা করি।
তার আয়েসি পান চিবানো দেখে বরাবরের রিতির বাহিরে বললাম, তাহলে চলেন,
আগে মাছ বাজার।
দেখি নদীর কোন মাছটাস পাই কিনা।
নাস্তা পরেই করি।
বলে এগোলাম মাছবাজারের দিকে।
নিজেও জানি নদীর মাছটাস কিছুই এখানে পাওয়া যাবে না।
ভদ্রলোক কে নির্ধারিত টাকার বাহিরে কিছু কিনে দেয়ার সন্মান দেখানো আর কি।
কপাল ভালো, সত্যিই আজ বিলের কৈ শিং সহ মেশানো মাছের ডালা পেয়ে গেলাম।
এখনো ক্রেতারা সব আসেনি বলেই পেয়ে গেলাম।
দামের চিন্তা না করে বেশি দামেই সালাম ভাইয়ের অমতেই নিয়ে নিলাম ডালিসহ মাছ।
তাজা মাছের লাফানো দেখে মনে হচ্ছিল, এখনি হোটেলে বলি পিয়াজ বেশিদিয়ে ক’টা কৈ মাছ ভেজে দাও দেখি।
তা সম্ভব না হলেও, পিয়াজ কিনে নিলাম ডিম ভাজার কথা বলে।
উনার জন্য বললে যদি প্রস্টিজে লাগে !
তাজা শিং এর মাখামাখা ঝোল আর কৈ এর ভাজি জি্হবায় স্বাদ এর আয়েস নিয়ে, পেটপুরে পরোটা ডালভাজি ও ডিম ভাজি সহ নাস্তা সেরে বাসায় ফিরলাম।
পিয়াজ গুলো থেকে অল্প রেখে, সালাম ভাই কে দিয়ে বললাম ভাবি কে নিয়ে দেন।
ভোরে বাজারে যাওয়ায় বাহিরে যাওয়ার আর মুড পেলাম না।
গোসল সেরে কৈ শিং খাওয়ার প্রহর হওয়ার অপেক্ষায় আবার দিলাম ঘুম।
বাজারে অনেক্ষন হাটাহাটি করায় না মাছের ঝোলের টানে গভীর এক ঘুমে দুপুর।
গোসল সেরে দেখি দুইটার উপর।
পেটে সেই ছুচোর বুকডন।
উপর থেকে বারবার উকি দিই, সালাম ভাই আসে নাকি।
ফোন দিয়ে খাবার দিয়ে যেতে বলি মাঝেমধ্য।
তা বলব কিনা ভাবছি।
ভাবতে ভাবতেই দেখি দারোয়ান গরম টিফিন ক্যারিয়ার টেবিলে রেখে, প্লেট ধূয়ে ডাকছে,
আসেন স্যার।
গরম আছে খাইয়া লন।
ঠিক আছে আপনি জান।
শেষ হলে ডাকব বলে বিদায় দিয়েই, গরম বাটির ক্যারিয়ার খুলতেই দেখি ভাতের মধ্যখানে ধুন্দুল ভাজি, একপাশে ধুন্দুল এর ভর্তা।
অন্য বাটির ডাকনা খুলতেই উপরে দেখি অস্তো শিং মাছ ভাজা, ধুন্দুল এর ঝোলের উপর সুন্দর করে বসানো।
আহারে ধুন্দুল শিং।
কৈ না হয় নাই হলো এবেলায়। দুটো আলু না হয় একটু পেয়াজ দিয়ে কি ভূনা করা যেত না শিং !!
ঘুরে ফিরে সেই ধুন্দুল শিং।
এক টুকরা পিয়াজ অবশ্য পেলাম ভাতের মাঝে।
এ মাসের তারিখ আজ তের। তেরতম দিন চলমান, ধুন্দুল এর ভাজি ধুন্দুল এর ভর্তা ধুন্দুল এর তরকারি।
এটা কি আনলাকি থার্টিন এর ফল, নাকি উৎপাদনকারীর ফসলের সৎ ব্যাবহার।
যাই হোক তোমার সাথে সকলের দাওয়াত ১৩ দিন না হোক দশ বাদে ১ দিন
নাস্তায় ধুন্দুল, রাতে ধুন্দুল, দুপুরে পারলে আরেক আইটেম বেশি ধুন্দুল এ আপ্যায়িত হতে।
অপেক্ষায় রইলাম গৃহে অতিথি আগমনে যদি ধুন্দুল দশার মৃত্যু না হোক, নতুন কিছু শুরু তো হোক।