সোজা কথায় বলা যায় মননে তিনি গড়ছেন সুরের বাড়ী আর চলনে-বলনে মুগ্ধকরা অকৃত্রিম সারল্য। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে লালন করে কাটছে তার প্রবাস জীবন। যার কথা বলছিলাম তিনি হলেন কাজী কাবেরী রহমান। যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলসেবসবাসরত গানের এই মানুষটি সম্প্রতি দেশে এসে ঘুরে গেলেন প্রবাস মেলা কার্যালয়। প্রবাস মেলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তার প্রবাস জীবনের কথা, গান নিয়ে তার ভাবনার কথা। সাক্ষাতৎকার নিয়েছেন শহীদ রাজু।

প্রবাস মেলা: আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং শিক্ষা জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
কাজী কাবেরী রহমান: আমার জন্ম ১৯৭৭ সালের ১৭ই জুলাই ঢাকা জেলায়। আমার বাবা গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। একসময় তিনি খুলনা জেলায় বদলি হন। বাবার বদলির সুবাদে খুলনার খালিশপুরেই আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে। আমার বাবা কাজী মতিয়ার রহমান ও মা জাকিয়া বেগমের ৪ সন্তানের মধ্যে আমি দ্বিতীয়। খুলনা রোটারি স্কুল থেকে ১৯৯৫ সালে এস.এস.সি পাশ করার পর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া আর এগোয়নি। তারপর গান নিয়েই কেটেছে আমার দিনান্তের সময়।

প্রবাস মেলা: গানে কি হঠাৎ করেই এলেন নাকি আগে থেকেই গানে ছিলেন?
কাজী কাবেরী রহমান: না, গানে হঠাৎ করে আসিনি। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি আমার আকর্ষণ তৈরি হয়। আমার মনে আছে ছোট বেলায় আমাদের স্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি গান গাইতাম। প্রশংসা পেতাম আমার সহপাঠী এবং টিচারদের কাছ থেকে। আমার মা-বাবাও আমার গান গাওয়া পছন্দ করতেন। আমার ৬ বছর বয়সে তারা পেশাদার গানের শিক্ষক রেখে আমাকে গান শেখাতে শুরু করলেন। আমার শিক্ষক ছিলেন ওস্তাদ নাসির হায়দার। নজরুল সঙ্গীতে তিনি খুব পারদর্শী ছিলেন। আমিও অনুগত শিক্ষার্থী হয়ে তার কাছ থেকে নজরুলগীতির তালিম নিয়েছি। এভাবে গানের প্রতি আমার অনুরক্ততা বেড়ে চলে।

প্রবাস মেলা: আপনিতো বাংলাদেশ বেতার খুলনা কেন্দ্রের একজন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ছিলেন- এ প্রসঙ্গে যদি বলতেন।
কাজী কাবেরী রহমান: যদিও গানে আমার হাতেখড়ি নজরুলগীতি দিয়ে কিন্তু ১৯৯৫ সালে আমি অডিশন দিয়ে খুলনা বেতারে আধুনিক গানের জন্য নির্বাচিত হই। তারপর ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আমি খুলনা বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলাম। নতুন নতুন গানের জন্য শ্রোতাদের অনেক অনুরোধ আসতো। এভাবে আধুনিক গান গেয়ে আমি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করি।

প্রবাস মেলা: আমেরিকায় প্রবাস জীবন কিভাবে শুরু করলেন?
কাজী কাবেরী রহমান: আমি ডিভি লটারি বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালে আমেরিকায় যাই। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলস শহরে বসবাস করছি। সেখানে আমি ইন্ডিয়ান মালিকানাধীন একটি বিউটি পার্লারে বিউটিসিয়ান হিসাবে কর্মরত আছি।
প্রবাস মেলা: আমরা জেনেছি যে প্রবাসে থেকেও আপনার সঙ্গীত চর্চা থামেনি- এটা কিভাবে সম্ভব হচ্ছে?

কাজী কাবেরী রহমান: যেহেতু গানের প্রতি আমার ভালোবাসা সেই শৈশব থেকেই। তাই আমেরিকায় গিয়েও আমি গান ছাড়তে পারিনি। মাঝখানে সাংসারিক ব্যস্ততায় সংগীত জগৎ থেকে বেশ কয়েক বছর দূরে থাকলেও এই দূর প্রবাসে এসেও আমার স্বামী সৈয়দ এম. হোসেন বাবু’র অনুপ্রেরণায় আবার গানে ফিরে আসি। প্রবাস জীবনের সমস্ত কর্মব্যস্ততার অবসরে একান্ত ভালোলাগার মুহূর্তে গানটা একা একাই মনের মধ্যে গুন গুন করে বেজে ওঠে। আমার কাছে মনে হয় শব্দ, কবিতা- এগুলো হলো মানুষের গহীন মনের ভাষা আর সংগীত হচ্ছে তার নিঃশব্দের আলোড়িত ভাষা। তাই গান, কবিতা আর সুর ছাড়া আমাদের জীবনের ছন্দপতন হয়ে যায়। আমি মনে করি সংগীত আমার জীবনের দুর্লভ পাওয়া। সেকারণে সঙ্গীতকে আমি হারাতে চাই না।

প্রবাস মেলা: আমেরিকায় কোথায় কোথায় পারফর্ম করেছেন?
কাজী কাবেরী রহমান: লস এঞ্জেলেসের বাঙ্গালী কমিউনিটির আমি একজন সক্রিয় সদস্য। আমি বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, ক্যালিফোর্নিয়ার সহ-সভাপতি। সেখানে বাফলা, বালা, বাংলার বিজয় বহর, অরেঞ্জ কাউন্টির গ্রীষ্ম বরণ উৎসব, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ লস এঞ্জেল্স এর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, লস এঞ্জেল্স বৈশাখী মেলা, বাংলাদেশ একাডেমি, অরেঞ্জ কাউন্টির চাঁদ রাত, সহ আরও অনেক কমিউনিটি সংগঠন কর্তৃক আমাদের বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমি নিয়মিত শিল্পী হিসেবে পারফর্ম করেছি। নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের বিশ্ব বিখ্যাত অডিটোরিয়াম নাসাউ কলিসিয়ামে অনুষ্ঠিত ৩৩তম ফোবানা সম্মেলনে হাজার হাজার দর্শকদের মাঝে গান গেয়ে বেশ প্রশংসিত হয়েছি।

প্রবাস মেলা: এখন কী ধরণের গান গাইতে পছন্দ করেন?
কাজী কাবেরী রহমান: এখন আধুনিক গানই বেশি গাওয়া হয়, কারণ শ্রোতাদের অনুরোধ থাকে। তবে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শাহ আব্দুল করিম এর গান পারফর্ম করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতেও আমার বেশ আগ্রহ রয়েছে। তাই এই পরবাসে থেকেও মাঝখানে বেশ কয়েক বছর ভারতের বিখ্যাত পন্ডিত গিরিশ চ্যাটার্জীর কাছে ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের তালিম নিয়েছি। একটা কথা এখানে বলতে চাই, গানের ব্যাপারে আমি নিজেকে শিক্ষানবিশ মনে করি। তাই এখনও চর্চা করছি, প্রতিনিয়ত শিখছি। কারণ সঙ্গীত হল গুরুমুখি বিদ্যা, সাধনার কাজ।

প্রবাস মেলা: এবার দেশে এসে গান নিয়ে কী কী কাজ করেছেন?
কাজী কাবেরী রহমান: বিশেষ করে আমার বোন বনফুল চুমকি কে দেখতে এবার দেশে এসেছি। সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তারপরও কিছু গানের রেকর্ডিং শেষ করেছি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত সুরকার ফরিদ আহমেদ এর সুর, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান এর কথায় আমার প্রথম মৌলিক গান ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না’ সহ আরও তিনটি কভার গান করেছি। এছাড়া ওস্তাদ কাজী নাজির আহম্মেদ হাসিবের সুর ও সৈয়দ এম. হোসেন বাবু’র কথায় ‘সুখে থাকো ভালো থাকো’র পাশাপাশি সৈয়দ তারিক এর পরিচলনায় দুটি গান রেকর্ড করেছি। এই গানগুলোর ভিডিও চিত্র নির্মাণ এর ইচ্ছা আছে।
প্রবাস মেলা: এবার আপনার প্রবাস জীবনের প্রসঙ্গে আসি, আমেরিকার মাটিতে প্রথম যখন পা ফেললেন তখন কেমন লেগেছিল? আর এখন সেখানে কেমন আছেন?
কাজী কাবেরী রহমান: আমি ২০০৯ সালে যখন আমেরিকায় যাই তখন নিজেকে খুব একা একা লাগতো। কেমন যেন একটা শূণ্যতা অনুভব করতাম। শুধু দেশের কথা মনে পড়তো। মা-বাবা, ভাই- বোন, আত্মীয় স্বজন, শৈশবের খেলার সাথী সহ সবার কথা মনে পড়তো। সব মিলিয়ে মাথার মধ্যে শুধু প্রিয় বাংলাদেশের স্মৃতি ঘুরপাক খেতো। খেতে পারতাম না, কাজে মন বসতে চাইতোনা। এভাবে সেখানে এডজাস্ট হতে আমার বেশ সময় লেগেছে। এখন অনেকটা মানিয়ে চলতে শিখেছি। তবে এখনো দেশকে খুব মিস করি। আসলে, জানেন কি- আমরা যারা বিদেশ বিভূঁইয়ে বসবাস করছি তারা প্রায় সবাই কম বেশি নিজের মাতৃভূমি বাংলাদেশ নিয়ে বেশ নস্টালজিক ভাবনায় ডুবে থাকি। মনের মধ্যে সবসময় দেশপ্রেমের একটা অভাবনীয় জাগরণ খেলা করে। তবুও অবলীলায় বলে যাই, আমেরিকায় আছি- এই বেশ ভালো আছি।

প্রবাস মেলা: গান নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ কোন পরিকল্পনা আছে কি?
কাজী কাবেরী রহমান: ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের উপর আরও বেশি অনুশীলন করবো। গদ্য কথার শরীরে সুরের আল্পনা এঁকে আজীবন বেঁচে থাকতে চাই।
প্রবাস মেলা: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
কাজী কাবেরী রহমান: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। প্রবাস মেলার জন্য অনেক শুভ কামনা রইল।