সুপর্ণা বসু দে , কোলকাতা, ভারত
ঘটনার সূত্রপাত একটা ইন্টারভিউ।
স্থান বৃদ্ধাশ্রম।
পাত্র একজন বছর ষাটোর্ধ প্রৌঢ়।
পরনে লুঙ্গি ও হাফ শার্ট।
একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন।
বৃদ্ধাশ্রম খুব একটা মনোরম স্থান নয়। একদিকে পরপর লাগোয়া ঘর। সামনে লম্বা একটা লাল মেঝের বারান্দা। মাঝখানে খানিকটা খোলা জায়গা। অনেকটা মাঠের মতন। একটা পেয়ারা গাছ একদিকে।
সময় সম্ভবত দুপুর একটা বা দুটো।
ক্যামেরার সামনে বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রৌঢ় বলে চলেছেন তার জীবন কথা। তার দুঃখের গল্প। তার বৃদ্ধাশ্রম জীবনের সূত্রপাত।
গল্পটাও সেই একই রকম।
ডাক্তার পুত্র ও ডাক্তার পুত্রবধুর অত্যাচার। ঝগড়া মাঝেমাঝেই হতো।
কিন্তু সেদিন সীমা ছাড়ালো যেদিন বৌমা শাশুড়ির গায়ে হাত তুললেন।
তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন।
এত অপমান! সহ্যের বাইরে। এতোদিন ভালো চাকরি করেছেন। এখনো মাসে একটা মোটা টাকার পেনশন পান।
অতএব এই নরকে থাকা চেয়ে বেরিয়ে আসাই শ্রেয় মনে করলেন। সহধর্মিনীর হাত ধরে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট নিয়ে বেরিয়ে এলেন।
সোজা বৃদ্ধাশ্রম।
দুঃখ করে বললেন- সবাইকে বলছি সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করার আগে মানুষ করা উচিত। আমি যে ভুল করেছি, আপনারা তা করবেন না।
তবে নাতির জন্য দুঃখ হয়।
আসল থেকে সুদ মিষ্টি। তা কে না জানে?
হঠাৎ করে ইন্টারভিউ নিতে নিতে পর্ণা বলে বসলো- এই মানুষ গড়ার শিক্ষাটা ঠিক কি? আচ্ছা কাকু আপনার নাতির জীবনটা সুন্দর বানানোর জন্য আপনারও কিছু দায়িত্ব আছে কি নেই?
ভদ্রলোক বললেন- তার মা-বাবা আছে। তারা শিক্ষিত ও বিত্তবান। ওকে কোনো ভালো স্কুলে ভর্তি করে দেবে। ভালো টিচার ও গাইড পেয়ে যাবে।
আচ্ছা সেটাই যথেষ্ট মনে হয়। আপনার ছেলেও তো ভালো স্টুডেন্ট ছিল নিশ্চয়ই? যখন ডাক্তার হয়েছেন এবং ভালো গাইডও পেয়েছিল- বলে পর্ণা।
এবার ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকালেন, বললেন- মানে? আপনার কি মনে হয় ওর ডাক্তার মা আমার কথা শুনবে?
কিন্তু আপনার নাতি কী শিখল? দাদু দিদাকে মা বকে মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল।
এটাই ঠিক। কারণ তার মা করেছে।
আপনার নাতির নীতি বোধটা শুধু দুর্বলই নয়, বিপদজনকও হয়ে উঠল না? আমরা তো আমাদের মা-বাবা, দাদু দিদার থেকেই তো শিখি।
আমার কি করণীয় ছিল? কাতর কন্ঠে বললো প্রৌঢ়।
বাড়িটা তো আপনার ছেলের তৈরি নিশ্চিত। তাই আপনাকে বেরিয়ে যেতে বলল। স্যার, আপনার ছেলের নামটা বলবেন। তাহলে আমরা তার সাথে যোগাযোগ করতে পারি।
ভদ্রলোক বললেন- না, নাম বললে ওর বদনাম হবে। এটা ওর প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হতে পারে।
কিন্তু অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক এবার অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন। বাড়িটা আমার। আমার পয়সায় বানানো। আমি চাকরিকালীন কোম্পানি থেকে লোন নিয়ে বানিয়েছি।
তবে আপনি আপনার অধিকার ছাড়লেন কেন স্যার? বলল পর্ণা।
ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন।
কেন, আপনি তাদের বাড়ি থেকে বিতাড়িত করলেন না? কেন স্যার? কেন?
ভদ্রলোক মাটির দিকে তাকিয়ে।
পর্ণা কিছুক্ষণ পর বললো- কিছু মনে করবেনা, আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবুও বলি স্নেহ, অপত্য স্নেহ আপনাকে অন্ধ করেছে। সেই কবে থেকেই হয়তো তাই সন্তান সুপুত্র হয়নি বলে দুঃখ করছেন কিন্তু নাম বলছেন না। যাতে তার বদনাম না হয়।
তবে মানুষ করা মানে তো নিজের মেরুদ-কে দুর্বল করা নয়।
ভদ্রলোক চুপ করে রইলেন।
চোখে জল। চোখ নিচে।
হঠাৎ বললেন- তুমি, তুমি ঠিকই বলেছে মা। তুমি আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু একদম ঠিক।
ভদ্রলোক চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন।
বললেন- ঠিক, ভালো হওয়া মানে দুর্বল হওয়া নয়। আমি আজই উকিলের বাড়ি যাব। ওদের নোটিশ দেব।
হঠাৎ পর্ণা দেখে একটা ঘর থেকে একজন ফর্সা শীর্ণকায় মহিলা বেরিয়ে এসে বললেন- আমি তো আগেই বলেছিলাম গো। আমাদের বাড়ি। আমরা বাড়ি ছেড়ে কেন যাব? তুমিই শুনলে না।
ইন্টারভিউ শেষ করে পর্ণা বললো- লড়াইটা অধিকারের।
লড়াইটা মেরুদন্ডের।
লড়াইটা নীতির।
লড়াইটা বাঁচার।
আসুন আমরা সবাই মিলে একটা সুস্থ পরিবেশ তৈরী করি। শুধু পরিবেশই নয়। মনটাও সুস্থ ও সুন্দর করে তুলি।