অসীম বিকাশ বড়ুয়া, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে: নিজ মাতৃভূমি তথা মাতৃভাষাকে হাজার মাইল দূরে পরবাসে থেকেও কিছুতেই ভোলা যায়না। তাইতো কবির কন্ঠে গেয়ে উঠি আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভূলিতে পারি। ঠিক তাইতো, কখনো ভোলা যাবেনা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে বীর বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এসেছিল বাংলার স্বীকৃতি। আর সেই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির এই আত্মত্যাগের দিনটি ২০১০ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয় প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
তারই ধারাবাহিকতায় দঃ কোরিয়ার সিউলের বাংলাদেশ দূতাবাস তিনটি ভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যথাযোগ্য ভাবগাম্ভীর্য ও মর্যাদার মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২১ পালন করে।
এ উপলক্ষে সকালে দূতাবাস প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম কর্তৃক জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করবার মধ্যে দিয়ে পরবর্তী অনুষ্ঠান শুরু হয়। সামাজিক দুরত্ব কার্যক্রম অব্যাহত থাকার কারণে শুধুমাত্র দূতাবাসের কর্মকর্তা কর্মচারীগণ উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এরপর দূতাবাস প্রাঙ্গণে অধিষ্ঠিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। অনুষ্ঠানের পরবর্তী অংশে ছিল পবিত্র ধর্মগ্রন্থ সমূহ থেকে পাঠ, ভাষা শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে নীরবতা পালন, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও ইউনেস্কোর মহাপরিচালক কর্তৃক প্রদত্ত বাণীসমূহ পাঠ। পরে উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে দিবসটির তাৎপর্যের উপর আলোকপাত করা হয়। আলোচকগণ তাদের আলোচনায় মাতৃভাষার মর্যাদা ও সম্মানকে সমুন্নত রাখতে সম্মিলিতভাবে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম তাঁর বক্তব্যে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় যেসকল ভাষা শহিদেরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে বলেন, তাঁর ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে ১৯৫২ হতে ১৯৭১ পর্যন্ত স্বাধিকারের বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এ বছরের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শিক্ষা ও সমাজে অন্তর্ভুক্তির জন্য বহুভাষাবাদকে উৎসাহিত করা’ কে উপজীব্য করে রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ সমূহ তুলে ধরেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে দূতাবাস কর্তৃক ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে দঃ কোরিয়াস্থ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, কূটনৈতিকবৃন্দ, দঃ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কোরিয়ান ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কো (কেএনসিইউ) এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দের সক্রিয় অংশগ্রহণে একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করে। উক্ত অনুষ্ঠানে দঃ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক, কেএনসিইউ এর মহাসচিব, পূর্ব তিমুর, পাপুয়া নিউগিনি, ভারত ও দঃ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূতগণ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এবং গিওরমাল কেওনসাজিওন এর মহাসচিব সহ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকগণ অংশগ্রহণ করেন।
উক্ত অনুষ্ঠানের প্রারম্ভিক পর্বে ভাষা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালন করে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো’ গানটি পরিবেশন করা হয়। পরে দূতাবাস কর্তৃক মহান শহীদ দিবস ও কোরিয়ার হাঙ্গুল (Hanguel) দিবসের সামঞ্জস্যের উপর নির্মিত একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হয়। এছাড়াও উক্ত অনুষ্ঠানে দঃ কোরিয়ায় বাংলা ভাষা প্রসারে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দূতাবাস কর্তৃক সম্মাননা প্রদানকৃত দুইজন বাংলাদেশি নাগরিককে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম তাঁর স্বাগত বক্তব্য বলেন, ২১ বছর আগে ইউনেস্কো কর্তৃক মহান শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতির মাধ্যমে একুশের চেতনা বিশ্বব্যাপী মানুষের হৃদয়ে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে যার মাধ্যেমে আমরা ভাষাগত বৈচিত্র্য, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাতে সক্ষম হয়েছি। তিনি পঞ্চাশ বছর পূর্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রতিও আলোকপাত করেন।
ইউনেস্কো সম্পর্কিত কোরিয়ান জাতীয় কমিশনের মহাসচিব হান কিউং কো তাঁর বক্তব্য দুই কোরিয়ার নৃতাত্ত্বিক ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশে দঃ কোরিয়া সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি দুই কোরিয়ার বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় কোরিয়ান ভাষার উপর একটি অভিন্ন অভিধান সংকলনের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেন।
এরপর পূর্ব তিমুরের সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত আদলগিসা মারিয়া সোয়ারেস জেমিনেস বলেন, তাঁর দেশ বহুভাষাবাদ সংরক্ষণে ও বিকাশে বদ্ধপরিকর। তিনি বলেন, পূর্ব তিমুর মূলত দ্বিভাষিক বা বহুভাষিক দেশ যেখানে জনসংখ্যা মাত্র চৌদ্দ লক্ষ। সেখানে সরকারি ভাষা পর্তুগীজ ও তেতুম ছাড়াও ষোলটি ভিন্ন ভাষা রয়েছে।
ভারতের রাষ্ট্রদূত শ্রীপ্রিয়া রঙ্গনাথন তাঁর বক্তব্যে বিশ্বকে মাতৃভাষা ও বহুভাষিকতার গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করার জন্য বাংলাদেশের উদ্যোগগুলোর প্রশংসা করেন। তিনি জানান, ভারতে একুশটি প্রধান ভাষা রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ভাষাভাষী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মানুষেরা তাদের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগের জন্য মাতৃভাষার পাশাপাশি হিন্দি ও ইংরেজী ভাষায় কথা বলে।
নেলসন ম্যান্ডেলার কন্যা এবং দঃ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত জেনানি এন ডামিনি তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশ ও দঃ আফ্রিকার ভাষা আন্দোলনের সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, তাঁর দেশে ও ভাষার জন্য মানুষেরা জীবন উৎসর্গ করে। তাঁদের স্মরণে ১৬ জুন দঃ আফ্রিকায় ‘যুব দিবস’ পালন করা হয়। তারপরে বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি দঃ আফ্রিকার সরকারি ভাষা হিসাবে বিভিন্ন মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন। তিনি জানান, বর্ণবাদ প্রথা চলাকালীন সময়ে মাত্র দুটি ভাষা- ইংরেজী এবং আফ্রিকান সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত ছিল। তাঁর পিতা নেলসন ম্যান্ডেলা কর্তৃক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কারণে দঃ আফ্রিকা এখন এগারটি ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং তার মধ্যে বর্তমানে পাঁচটি ভাষায় দঃ আফ্রিকার জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়ে থাকে।
পাপুয়া নিউগিনির রাষ্ট্রদূত অ্যান্ড্রু ইয়ামানিয়া তাঁর দেশকে সংস্কৃতি ও ভাষার বিচারে পৃথিবীর অন্যতম বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, আটশটির ও বেশি নৃতাত্ত্বিক ভাষা প্রচলিত রয়েছে যা সারা বিশ্বের ব্যবহৃত ভাষার এক তৃতীয়াংশ। দুঃখজনকভাবে বিভিন্ন কারণে তাঁর দেশের বেশ কয়েকটি স্থানীয় ভাষা বিলুপ্ত হতে চলেছে বলে তিনি জানান এবং ভাষাগুলো সংরক্ষণের জন্য তার সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা ও তিনি উল্লেখ করেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ এর মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী তাঁর বক্তব্য দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষা, সংস্কৃতি সংরক্ষণে ও বিকাশে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। সেই সাথে কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ সহ মাতৃভাষা ভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা চালুর কথা উল্লেখ করেন। গিওরমাল কেওনসাজিওন এর মহাসচিব মিস মো সুন ইয়াং তাঁর বক্তব্য উত্তর ও দঃ কোরিয়ার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত কোরিয়ান ভাষা সংক্রান্ত একটি অভিন্ন সংবিধান সংকলনের চলমান প্রকল্প সম্পর্কে আলোকপাত করে বলেন, ২০০৪ সাল থেকে উভয়পক্ষ এ সংক্রান্ত মোট পঁচিশ টি যৌথ সভা করে ত্রিশ হাজারের ও বেশি শব্দ অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে এক মত হয়েছে।
এরপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে বাংলাদেশ, ভারত এবং কোরিয়ার বিভিন্ন শিল্পীদের পরিবেশনা প্রদর্শন করার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।