অসীম বিকাশ বড়ুয়া: দক্ষিণ কোরিয়ায় ১২০০ বছরেরও পুরনো ইতিহাসসমৃদ্ধ আন্তর্জাতিক পদ্ম লণ্ঠন উৎসব, বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক মহাকারুণিক তথাগত গৌতম বুদ্ধের জন্ম, মহাপরিনির্বাণ ও বোধিলাভ—এই ত্রিস্মৃতি-বিজড়িত শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে, এবং ২০২০ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ‘সাইট অফ হিউম্যানিটি’ হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কোরিয়ার প্রাচীন সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক এ অনুষ্ঠানটি প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও ২৬ ও ২৭ এপ্রিল কোরিয়াসহ রাজধানী সিউলে অনুষ্ঠিত হয়।
এতে দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থানরত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রায় তিন শতাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি, কোরিয়া-বাংলাদেশ বুদ্ধসা বুদ্ধ সারণা মেডিটেশন সেন্টার ও বুদ্ধ ধাতু বিহারের প্রধান অধ্যক্ষ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ধুতাঙ্গ সাধক ভদন্ত শরণংকর মহাথের মহোদয়ের নেতৃত্বে ডংগুক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জোগেসা টেম্পল পর্যন্ত বুদ্ধের জন্মদিনে পদ্ম লণ্ঠন উদযাপন র্যালিতে যোগদান করেন।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার জোগেসা টেম্পলসহ বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, ভিক্ষুসঙ্ঘবৃন্দ এবং চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানের রাষ্ট্রদূতবৃন্দ। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশিদের পক্ষে ধুতাঙ্গ সাধক শরণংকর মহাথের উপস্থিত থেকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন।
এই উৎসবের সূচনা হয় সিল্লা (৬৬৮–৯৩৫ খ্রিঃ), গোরিও (৯১৮–১৩৯২ খ্রিঃ) এবং পরবর্তীতে জোসন (১৩৯২–১৯১০ খ্রিঃ) সাম্রাজ্যের সময়কালে।
জানা যায়, গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পালিত হয় চীনা চান্দ্র বছরের চতুর্থ মাসের অষ্টম দিনে। হিসাব অনুযায়ী দিনটি কখনও এপ্রিল, কখনও মে এবং লিপ ইয়ার হলে জুন মাসেও পড়তে পারে। প্রতিবছর দক্ষিণ কোরিয়ায় “পুচ্চনিম ওশিন নাল” নামে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। এ বছর বুদ্ধের জন্ম জয়ন্তীর প্রস্তুতি প্রায় তিন মাস আগে থেকেই শুরু হয় গোটা দেশজুড়ে। উৎসবটি বিশ্বজুড়ে “লোটাস ল্যান্টার্ন ফেস্টিভ্যাল” নামে পরিচিত। গৌতম বুদ্ধকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর এ উৎসবটি দক্ষিণ কোরিয়ায় বহু পুরনো এবং এ দিন কোরিয়ানরা হাস্যোজ্জ্বল মুখে সারা দিন উদযাপন করে।
এ দিন পুরো কোরিয়া জুড়ে সাজসাজ রব পড়ে যায়। সারি সারি আসন দিয়ে সজ্জিত রাস্তাগুলোতে সকাল থেকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশ-বিদেশ থেকে আগত দর্শনার্থীদের সমাগম বাড়তে থাকে। ব্যানার, ফেস্টুন, হাতি, ঘোড়া, ড্রাগন, পদ্মফুল, ময়ূর, বুদ্ধের প্রতিবিম্ব, বেবি বুদ্ধা, লাফিং বুদ্ধার স্ট্যাচু সহ হাজার হাজার ডিজিটাল কারুকাজ ও ঐতিহ্যবাহী চিত্রশৈলীতে লক্ষাধিক পদ্ম লণ্ঠন জ্বালানো হয় মহাসমারোহে।
বর্ণিল এই মেলাকে কেন্দ্র করে কোরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা, মোড় ও জংশনে লণ্ঠন ঝোলানো হয়। টেম্পলের চারদিকে রঙিন কারুকার্য ও নানা ঢঙের র্যালির সঙ্গে কোরিয়ানদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘হানবোক’ পরে বাদ্যযন্ত্রের সুরে যানবাহনসহ পাতাল রেলস্টেশনগুলো রূপ নেয় লণ্ঠনমণ্ডিত এক অপূর্ব দৃশ্যে।
উৎসবটি শুধু বৌদ্ধদের জন্য নয়, বরং সব ধর্ম ও দেশের মানুষের জন্য উন্মুক্ত ছিল। আয়োজনের মধ্যে ছিল হানমাদাং, প্যারেড, হানগাং সুল্লে, সার্কেল নৃত্য, পদ্ম লণ্ঠন তৈরি, ইউলিম মাদাং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ইয়ন ডিউন নুরি, ধর্ম দেশনা অনুষ্ঠান এবং টেম্পলের খাবারের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ।
দক্ষিণ কোরিয়া ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের উপস্থিতিতে শুধু সিউলে এবারের উৎসবে প্রায় দশ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে।
প্রতিবছর বুদ্ধের জন্মদিনে উপস্থিত থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বাংলাদেশের ধুতাঙ্গ সাধক শরণংকর মহাথের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সকল বাংলাদেশিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন— ‘ইয়নদংহো উৎসবের মূল লক্ষ্য হোক বুদ্ধের আলোকিত আলোয় সমগ্র বিশ্বকে আলোকিত করা।’