ফারুক ফয়সল, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
রমজান আলী মৃত্যুর আগে তিনটি কাজ সমাধান করে যায়। এগারো মাস আগে আত্মীয়, মুরুব্বী, পড়শিদের পরামর্শ মত ছেলে কোরবান আলীর বিয়ে দিয়ে বউ ঘরে নিয়ে আসে। সবাই বিশ্বাস করেছিল, বউ ঘরে এলে, দায়িত্ব ঘাড়ে পড়লে কোরবান আলী স্বাভাবিক একজন সংসারী মানুষ হবে, হয়নি। তবে বৌ-এর সাথে ভাব-ভালোবাসা হয়েছে বোঝা যায়। দিনভর টো টো ঘুরে বেড়ানোটা কমেছে। বাড়ি ফেরার টান তৈরী হয়েছে। তবে এখনো কাজ কামের ব্যাপারে একেবারেই গা করার নাম নেই। মা মরা ছেলে, জোড় করে কিছু বলতেও পারেনা।

কোরবান, রমজান আলীর একমাত্র সন্তান। তার যেটুকু যা সম্পত্তি আছে, তার মৃত্যুর পর একমাত্র ওয়ারিশ হিসাবে কোরবান আলীই সব পাবে। ছেলেটা তার আলাভোলা, সংসারের মারপ্যাঁচ বোঝেনা। তাই সে যাতে কোনও ঝামেলায় না পড়ে, সেজন্যে রমজান আলী বসত বাড়িসহ বাড়ির ভিটার লাগোয়া একটি বাঁশঝাড় ও বিঘা দুই ধানী জমি ছেলের নামে রেজিষ্ট্রী দানপত্র দলিল করে দিয়েছে। রমজান আলী মৃত্যুবরণ করে শুক্রবার ভোর বেলা। ফজর নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে ফিরে এসেই ছেলের বৌকে এক গ্লাস পানি দিতে বলার পর পরই জোরালো কাশি ওঠে। কাশতে কাশতে বুকে হাত দিয়ে পৈঠাত পাতা চৌকির উপর শুয়ে পড়ে। ছেলে বৌ পানি এনে অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে কোরবানকে ডাক দেয়। ধরমর করে বিছানা থেকে উঠে পৈঠার দিকে দৌঁড়ে বাপের কাছে যায় কোরবান। বৌকে জিজ্ঞেস করে, ‘কি হছে বাজানের, বাজান ইঙ্কা করিচ্ছে ক্যা’? বৌ উত্তর করে, ক্যাজানি, বাজান মজিদ থ্যকা আস্যাই হামাক ডাক দিয়া খাওয়ার পানি চালো, হামি পানি আন্যা দেখি, বাজান চৌকির উপর শুয়্যা থ্যাকা বুক চাপড়াচ্ছে। কোরবান জিজ্ঞাস করলো, বাজানক পানি খাওয়াবার পারিছলা? বৌ দুইদিকে মাথা নাড়াইয়া কলো, ‘না’। কোরবান একহাতে বাবার মাথা উঁচু করে ধরে, আর হাতে পানির গেলাস বাবার মুখে তুলে ধরে। বাবাকে গেলাসের পানিতে চুমুক দিতে বলে। বাবা পারে না। তখন চামচ দিয়া পানি মুখের ভিতর দিতে গেলে মুখের দুই কস দিয়া পানি গাল বেয়ে নিচে নামে। কোরবান চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। বৌটাও বুক চাপডাইয়া কাঁদতে থাকে। পড়শিরা বাড়ির আঙিনায় জড়ানো হয়। বাজান নাই।

কোরবান আলীর দিন বদলের দিন শুরু হয়। বাজানের মৃত্যু কোরবানকে হটাৎ করেই দায়িত্বশীল মানুষে পরিণত করে। তার বাজান যে জুম্মাবার চলে যায়, তার আগের জুম্মার দিনের কথা মনে হয়। নামাজ, মিলাদ শেষ করে বাড়ি ফেরে। বৌমা বারান্দায় শপ বিছিয়ে খাবার দাবার রেডী করে শ্বশুর আব্বাকে খেতে ডাকে। বাজান তাকে ডেকে নিয়ে একসাথে খাওয়া দাওয়া করে। কোরবান উঠতে যাবে এমন সময় বাজান হাত ইশারায় বসতে বলে। কোরবান বসে। বাজান বৌমাকে বাসন কোসন গুছিয়ে এসে তাদের সাথে বসতে বলে। বৌমা এসে শ্বশুরের কথামত তার পাশে বসে। শ্বশুরকে মাঝখানে রেখে দুজন দুইপাশে বসা। শ্বশুর বলতে শুরু করে, ‘দ্যাখ্ ব্যাটা, হামার বাপ হামাক বিষয় সম্পত্তি তেমন কিছু দিয়া যাবার পারেনি। তোর দাদার যা যেটুক আছলো হামরা চার ভাই আর দুই বোনের মধ্যে ভাগ হয়্যা যাবার পর হামি লিজে এই বসতবাড়িডা খালি বানাইছি। জমি জিরাত কিছু বাড়াবার পারিনি। হামার যা আছলো, সবি হামি তোক দিয়া গেনু বাপ।
দুইডা বলদ আছে। গাড়ি আছে। শুকনা মৌসুমে মাটি কেনা বেঁচার ব্যবসা হামি করিচ্ছুনু। বলদ আছে, লাঙল আছে, মই আছে, লিজের জমিত লিজে যদি চাষবাস করিস, আর ধান ওঠার পর খরার দিনগুলাত যদিল মাটি কাটার ব্যবসাটা করিস, তোর দিন ভালোই চল্যা যাবি’।

দুইজনের দিকে তাকিয়ে নিয়ে আবার বলে, ‘তোক হামি আরেকটা জিনিষ দিয়্যা গেনু বাপ, আল্লার নিয়ামত হামার এই বেটী, তোর বৌ। তুই ওর যত্ন করিস, দেখ্যা রাখিস বাপ। এডা হামাগোরে কাছে অর বাপ মায়ের আমানত।’ বৌমার আর ছেলের ডান হাত টেনে নিয়ে নিজের হাতের মধ্যে ধরে রেখে কান্না ভেজা কন্ঠে বলে, ‘হামার দিন শ্যাষ হইয়্যা আসিচ্ছে বাপ। হামাক কথা দে তুই তোর বৌ আর হামার বলদ দুডার ঠিক মতন দেখা শোনা করবি, যত্ন লিবি।’
কোরবান আলী হাউমাউ কেঁদে উঠেছিলো। বাজানক্ নিশ্চিন্ত করেছিল। বাজান চলে যাওয়ার পর তার ওই কথাগুলি সারাক্ষণ মনে হয়। কোরবান আলী সত্যি সত্যি সংসারী হয়ে ওঠে। বৌটার প্রতি মনোযোগী হয়। জমি জিরাত নিজ হাতে চাষবাসের ব্যবস্থা নেয়। আর সবচেয়ে বেশি যত্ন নেয় বলদ দুটির। তার বাবা গরু দুটিকে সন্তানের মতই যত্ন করতো। এখন কোরবান সেরকমটি করে। আসলে বেশিই করে।
চাষবাসের মৌসুমে বলদ দুটি রোদে পুড়ে, বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে ক্ষেতে লাঙল টেনেছে। এখন খরা মৌসুমে মাটি কেনা বেচার ব্যবসায় মাটি ভরা গাড়ি টানে, মাইলের পর মাইল হাঁটে প্রতিদিন। কোরবানের নিজেরও কষ্ট কম কিছু হয়না। বড্ডো ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরে। নিজের হাত মুখ ধোওয়া, একটু বিশ্রাম নেয়ার কথা ভাবেনা। এসেই বলদ দুটার খাওয়ার ব্যবস্থা করে। তারপর বাড়ির বাইরের আঙিনায় জাম গাছটার সাথে বেঁধে দুটাকে শুরু হয় দলাই মলাই অর্থাৎ ম্যাসাজ পর্ব। এরপর গোয়াল ঘরে ধোঁয়া দিয়ে মশা তাড়িয়ে গরু দুটিকে গোয়ালে রেখে সে যায় ডুব গোসল দিতে। বৌ ইতিমধ্যে ভাত বাড়ে, খাবার রেডী করে। খাওয়ার পাট চুকলে কোরবান পান মুখে পৈটার চৌকিতে বসে। বৌ ধোওয়া মোছার পাট শেষ করে এলে দুজনে ঘরে যায়।
এভাবেই তাদের দিন চলে যায়। ভালোই যায়। কোরবানের সংসারের প্রতি মন বসা দেখে বৌটার খুব আনন্দ হয়। গরু দুটার উপর তারও বেশ মায়া পড়ে যায়। সোয়ামী বাসায় না থাকলে, কি কোনদিন তার শরীর খারাপ লাগায় বিছানায় শুয়ে থাকলে সে তাদের দেখভাল করে। কিম্বা কোনও কোনও দিন কোরবান গাড়ীসহ দেরি করে ফিরলে সে তাকে খুলির কলে গোসল দিতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে গরু দুটাকে খাইতে দেয়। ওদের দুজনের দুইটা নামও সে ঠিক করে। কালো সাদা ডুরেটার নাম লালু, হাল্কা বাদামী আর ধূসরটার নাম দেয় ভুলু। রাতে কোরবান বলে, ‘ভালোই নাম দিছ, সিনেমা দেখছিনু লালু ভুলু’। বৌ বললো, ‘হ, খুব দু:খের সিনেমা, হামরাও কয় বান্ধবী মিলা দেখছিনু , ওই সিনেমাত থাক্যেই তো নাম দুটা লিছি’। ওদিকের কোনো সাড়া না পেয়ে পাশ ফিরে দেখে কোরবান ঘুমিয়ে গেছে। তার অভিমান হয়। সে হ্যারিকেনের সলতে কমিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। ঘুম আসেনা। নানা দুশ্চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকে। দুবছরের উপর তাদের বিয়ে হয়েছে…….