জোসেফ ই. স্টিগলিজ, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
সৌভাগ্যক্রমে ২০ জানুয়ারি ২০২১ জো বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। কিন্তু ৬ জানুয়ারি ২০২০ এ মার্কিন ক্যাপিটাল ভবনে জঘন্য হামলার ঘটনাটি দেখিয়েছে যে, আমেরিকার দীর্ঘকালীন চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে উঠতে একাধিক ব্যক্তি বা একাধিক প্রেসিডেন্টের মেয়াদকাল অতিবাহিত করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের দ্বারা মার্কিন ক্যাপিটলে হামলা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে তাঁর চার বছরের দীর্ঘ আক্রমণের অনুমানযোগ্য ফলাফল। বস্তুত ট্রাম্প নিজেই ওই হামলা উস্কে দিয়েছিলেন। রিপাবলিকান পার্টিরও বহু লোকও এই দুষ্কর্মে সহায়তা এবং মদত দিয়েছিলেন। কেউ বলতে পারেন না যে ট্রাম্প আমাদেরকে সতর্ক করেছিলেন, কারণ তিনি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার উত্তরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন না। তিনি পরিবেশগত বিধি-বিধান পরিবর্তন করে এমন অনেক কর্পোরেট এবং ধনী ব্যক্তিদের জন্য কর হ্রাস করেছিলেন যাতে তারা উপকৃত হয়েছিলো। তাদের পক্ষে তিনি ব্যবসায় বান্ধব বিচারক নিযুক্ত করেছিলেন যাদের অনেকেই জানেন যে তারা শয়তানের সাথে চুক্তি করছে। হয় তারা বিশ্বাস করেছিল যে তার লেলিয়ে দেয়া উগ্রপন্থী বাহিনীকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, বা তারা কোন কিছুর তোয়াক্কা করবে না।
তাই প্রশ্ন উঠছে, এমন অবস্থা থেকে আমেরিকা এখন কোথায় যাচ্ছে? ট্রাম্প কি নীতিভ্রংশ বা গভীর জাতীয়ব্যাধির লক্ষণ? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কি বিশ্বাস করা যেতে পারে? চার বছরে, যে বাহিনী ট্রাম্পকে জন্ম দিয়েছে এবং যে দল তাকে অত্যধিকভাবে সমর্থন করেছিল যে ট্রাম্প আবার জয়লাভ করুক? সেই পরিণতি রোধে কী করা যেতে পারে?
ট্রাম্প একাধিক বাহিনীর প্রচেষ্টার ফসল। কমপক্ষে এক চতুর্থাংশ শতাব্দী ধরে রিপাবলিকান পার্টি বুঝতে পেরেছে যে, এটি কেবল ধর্মীয় উগ্রমৌলবাদী, সাদা আধিপত্যবাদী, পপুলিস্ট জাতীয়তাবাদী জনগোষ্ঠী সহ গণতন্ত্রবিরোধী ব্যবস্থা (ভোটার দমন ও ষড়যন্ত্র করা সহ) ও এর মিত্রদের সখ্যতা গ্রহণ করেই কেবল অভিজাত ব্যবসায়ীদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।
অবশ্যই, পপুলিজম এমন নিয়ম-নীতির সূচনা করে যা অভিজাত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যায়। কিন্তু অনেক ব্যবসায়ী নেতা জনসাধারণকে ধোঁকা দেওয়ার ক্ষমতা অর্জনে দশকের পর দশক ব্যয় করে থাকে। বিগ টোব্যাকো কোম্পানি তাদের তামাকজাতীয় পণ্যের দ্বারা সৃষ্ট স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর মারাত্মক প্রভাবগুলি অস্বীকার করার জন্য আইনজীবি এবং অপবিজ্ঞানের উপর চূড়ান্তভাবে নির্ভর করেছিল। তেমনিভাবে বিগ অয়েল কোম্পানি জলবায়ু পরিবর্তনে জীবাশ্ম জ্বালানীর প্রভাবকে অস্বীকার করার জন্য একইভাবে অপচেষ্টা চালিয়েছিল। তারা চিনতে পেরেছিল যে ট্রাম্পই তাদের একান্ত আপনজন।
তারপরে, প্রযুক্তির প্রভূত অগ্রগতি ভুল বা অসত্য তথ্য দ্রুত প্রচারের জন্য পথ তৈরি করে থাকে। আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থ সর্বোচ্চ প্রভাব বিস্তার করে, ফলে সেখানে উদীয়মান টেক জায়ান্টরা জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত থাকার সুযোগ পেয়ে আসছিলো। এই রাজনৈতিক ব্যবস্থা আরও একটি কাজ করেছিল। তা হল এটি এমন একাধিক নীতিমালা তৈরি করেছিল (কখনও কখনও নিওলিবারেলিজম নামে পরিচিত) যা আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় ধনীদের প্রচুর আয় এবং সম্পদ অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছিলো কিন্তু অন্যসব ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে স্থবিরতা বিরাজ করেছিল। ফলে শীঘ্রই, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির শীর্ষে থাকা একটি দেশ নাগরিকদের আয়ু হ্রাস এবং ক্রমাগত স্বাস্থ্যবৈষম্য সৃষ্টিকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
নিওলিবারাল প্রতিশ্রুতি দেয় যে সম্পদ এবং আয়ের মুনাফার অংশ সমাজে নীচের দিকে থাকা ব্যক্তিরাও পাবে কিন্তু তা মৌলিকভাবে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিলো। বিপুল কাঠামোগত পরিবর্তন দেশের বিশাল অশিল্পায়িত অংশগুলিকে গ্রাস করে ফেলেছে, ফলে যারা পিছনে পড়েছিল তারা মূলত তাদের জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা ঠেকিয়ে রাখতে চাইবে। যা আমি আমার লেখা The Price of Inequality and People, Power, and Profits বইতে সতর্ক করেছিলাম। এই বইয়ে আমার অম্র-মধুর অন্তর্নিহিত কথাগুলো একজন সম্ভাব্য বাক সর্বস্ব নেতার জন্য আমন্ত্রণের একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল।
যেমনটি আমরা বারবার দেখেছি, নৈতিক সীমাবদ্ধতার সাথে মিলিতভাবে আমেরিকানদের উদ্যোক্তা চেতনা প্রভূত পরিমাণে লুটেরা, শোষকশ্রেণি এবং বাক-বাগীশ নেতার জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্প ছিলেন চরম মিথ্যাবাদী ও আত্মপ্রচারবাদী এক সামাজিক ব্যাধির উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আধুনিক গণতন্ত্র বা অর্থনীতির যথার্থ মূল্যায়ন করার কোন সক্ষমতা তার ছিল না। তিনি মূলত মুহূর্তেরই মানুষ ছিলেন।
তাই এখন তাৎক্ষণিক কাজ হলো ট্রাম্প এখনও আমেরিকাকে যে হুমকির মুখোমুখি করছে তা দূর করা। প্রতিনিধি পরিষদে তাকে এখনই ইম্পিচ করা উচিত। কিছু সময় পরেও সিনেটের চেষ্টা করা উচিত, যাতে সে যেন আবার ফেডারেল পদে অধিষ্ঠিত হতে না পারে। এক্ষেত্রে রিপাবলিকানদের স্বার্থ ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে কোন অংশে কম নয় কম নয়। এটি দেখাতে হবে যে কেউই এমনকি রাষ্ট্রপতিও আইনের উর্ধ্বে নয়। প্রত্যেককেই নির্বাচনকে সম্মান জানানো এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার উত্তরণ নিশ্চিত করার অপরিহার্য বিষয়টি বুঝতে হবে।
কিন্তু অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলি সমাধান না করা পর্যন্ত আমাদের আরামে ঘুমানো উচিত নয়। আমদেরকে অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। সহিংসতা প্ররোচিত করা এবং বর্ণবাদী ও ধর্মীয় বিদ্বেষকে রাজনৈতিক কারসাজিতে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া যে বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারে তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। আমাদের অবশ্যই দায়বদ্ধতার সাথে বাকস্বাধীনতার পুনর্মিলন ঘটাতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশগুলি সামাজিক উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে এমন ছবি বা ভিডিও প্রদর্শন করতে অন্যান্য নানান মিডিয়ায় প্রকাশের উপর স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যেমন দর্শকপূর্ণ কোনও থিয়েটারে গুলি না করা, শিশু পর্নোগ্রাফিতে জড়িত না হওয়া বা মিথ্যা, মানহানিকর কুৎসা রটনা থেকে বিরত থাকা। তবে এটা সত্য যে, কিছু স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা এই প্রতিবন্ধকতাগুলিকে অপব্যবহার করে এবং মৌলিক স্বাধীনতার সাথে আপস করে। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকারগুলো সর্বদা গণতান্ত্রিক সরকারগুলো যা-ই করুক না কেন তার তোয়াক্কা না করে তারা যা করার ইচ্ছা পোষণ করে তা ন্যায়সঙ্গত বলে দাবি করে থাকে।
আমেরিকানদের ভোটের মৌলিক অধিকার এবং গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব উভয়ই নিশ্চিত করতে আমাদেরকে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। আমাদের একটি নতুন ভোটাধিকার আইন প্রণয়ন করা দরকার। ১৯৬৫ সালে গৃহিত পুরানো আইনটি মূলত: দক্ষিণাঞ্চলকে কেন্দ্র করে প্রণয়ন করা হয়েছিলো, যেটা গৃহ যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনের পর থেকেই আফ্রিকান-আমেরিকানদের বঞ্চিত করে সাদা অভিজাতদের ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম করেছিল। তবে এখন সারা দেশে গণতন্ত্রবিরোধী চর্চা দেখা যায়।
আমাদের রাজনীতিতেও অর্থের প্রভাব অবশ্যই কমাতে হবে। আমেরিকার মতো দেশে যতটা অসমতা বিরাজ করছে তাতে সমাজে চেক এবং ব্যালেন্সের জন্য কোনও ব্যবস্থাই কার্যকর হতে পারে না। ফলে এখানে ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট’ এর পরিবর্তে ‘এক ডলার, এক ভোট’ ভিত্তিক সিস্টেম দেশকে পপুলিস্ট বাক-বাগীশ নেতা নির্বাচনের ঝুঁঁকিতে ফেলবে। সর্বোপরি, সামগ্রিকভাবে এ জাতীয় ব্যবস্থা কীভাবে দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে?
শেষ অবধি, আমাদের অবশ্যই বহুমাত্রিক বৈষম্যের সমাধান করতে হবে। আমেরিকার ক্যাপিটল ভবনে সাদা বিদ্রোহী আক্রমণকারী এবং এই গ্রীষ্মে শান্তিপূর্ণ ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ এর প্রতিবাদকারীদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের আচরণের পার্থক্য আরেকবার দেখিয়ে দিয়েছে, বিশ্বজুড়ে আমেরিকার বর্ণবাদী অবিচারের মাত্রা কী উচ্চতায় পোঁছেছে।
তদুপরি, কোভিড-১৯ মহামারী দেশের অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত বৈষম্যের মাত্রাটি কিছুটা কমিয়ে রেখেছে। যেমনটি আমি বারবার যুক্তি দিয়েছি, আমেরিকার সিস্টেমের দৃঢ়মূলে প্রোথিত বৈষম্যগুলির কঠিন আক্রমণ ছোট ছোট খামচি দিয়ে কোনভাবেই প্রতিহত করা করা যাবেনা।
ক্যাপিটল ভবন আক্রমণে আমেরিকা কীভাবে প্রতিক্রিয়া করবে তা দেখিয়ে দেবে দেশটি কোনদিকে এগিয়ে চলেছে। ট্রাম্পকে কেবল জবাবদিহিতার আওতায় রাখলে চলবে না, বরং তার বিষাক্ত প্রেসিডেন্সিতে জন্মলাভকারী আমেরিকার অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের কঠোর রাস্তাটিতেও আমাদেরকে যাত্রা করতে হবে। তাহলেই কেবল একটি উজ্জ্বল দিনের আশা করা যায়। সৌভাগ্যক্রমে ২০ জানুয়ারি ২০২১ জো বাইডেন মার্কিন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। কিন্তু ৬ জানুয়ারি ২০২০ এ মার্কিন ক্যাপিটলে জঘন্য হামলার ঘটনাটি দেখিয়েছে যে, আমেরিকার দীর্ঘকালীন চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে উঠতে একাধিক ব্যক্তি বা একাধিক প্রেসিডেন্টের মেয়াদকাল অতিবাহিত করতে হবে।
জোসেফ ই. স্টিগলিজ: অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। রুজভেল্ট ইনস্টিটিউটের প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং প্রধান অর্থনীতিবিদ। তাঁর সাম্প্রতিকতম বই- People, Power, and Profits: Progressive Capitalism for an Age of Discontent.
(প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন: শহীদ রাজু।)