অমর্ত্য সেন
মানুষে মানুষে সম্পর্ক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রকৃতি দ্বারা নির্ণীত হয়। কার্ল মার্কসের এমন দার্শনিক চেতনাকে প্রায়শ সংকীর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে। তার দ্বিশততম জন্ম দিবসে ঐ আন্ত:সম্পর্কের দ্বিমূখী প্রকৃতির স্বরূপ উদঘাটনে তার নির্দেশনা উপলব্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কার্ল মার্কসের ২০০তম জন্মদিনে তার সম্পর্কে আমাদের কিভাবে ভাবা উচিত? বিশ^ রাজনীতিতে তার যে বিপুল প্রভাব রয়েছে তাতো সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত। যদিও এ প্রভাবের ভালো-মন্দ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তথাপি এতে কোন সন্দেহ নেই যে চিন্তাশীলতার বিস্তৃতির মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক বিশে^র যে রূপান্তর ঘটেছে তার সূচনা মার্কসই করেছেন। কেননা সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বোধনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শ্রেণী বিশ্লেষণ। আবার মানুষের নৈতিক অধিকারের দ্বন্দ্বমূলক ভিত্তি হিসাবে কঠোর শ্রম এবং চাহিদার মধ্যে তুলনামূলক বৈষম্যের গভীর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। আর এসবক্ষেত্রে মার্কসের অনেক বিশ্লেষণ আছে যার প্রভাব এখনো বিদ্যমান। তার কিছু কিছু প্রভাব দৈনন্দিন প্রয়োজনে আমাদের ধারণা ও সংযোজনের বিশ্লেষণের মধ্যে এমন শক্তিমান প্রভাব বিস্তার করে, যাতে আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারি না যে ঐ প্রেরণার আসল উৎস কোথা থেকে আসে। তার কিছু ক্লাসিক লেখা পড়ার সময় আমরা প্রায়শ থিয়েটার দেখতে যাওয়া লোকদের মতো অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যাই। যারা সেক্সপিয়ারের হ্যামলেট ভালোবাসেন কিন্তু সমস্যা হলো তারা বুঝতে পারে না কেন এটি এত বেশী কোটেশনে পরিপূর্ণ।
মার্কসীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আজও অনেক গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা হিসাবে বিশেষ বিবেচনার বিষয়। তবে তা শুধুমাত্র মার্কসের নিজস্ব মূল কাজের জন্য নয়, বরং অনেক প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং সৃজনশীল শিল্পী-সাহিত্যিকও এই ঐতিহাসিক মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত রাখতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন- অ্যান্তোনিও গ্রামসি, রোজা লুক্সেমবার্গ, জ্যাঁ পল সাত্রে, ব্রেটল্ট ব্রেশ্ট, পিয়েরি ¯্রাফা, মরিস ডব, এরিক হবসবাউম (এখানে মাত্র কয়েক জনের নাম উল্লেখ করা হলো)। মার্কসের অন্তদৃষ্টিগুলোর ঐশ^র্য ব্যবহারের জন্য আমাদেরকে মার্কসবাদী হবার প্রয়োজন নেই। যেমন এরিস্টটলের কাছ থেকে শেখার জন্য কাউকে এরিস্টটলীয়ান হতে হয় না।
কার্ল মার্কসের সৃষ্টিশীল রচনাসংকলনে এমন সব আইডিয়া রয়েছে যা এখনো উদঘাটন করা হয়নি। আমি তুলনামূলকভাবে অবহেলিত মার্কসের উচুমানের মৌলিক দুটো আইডিয়ার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। যেমন- ঙনলবপঃরাব ওষষঁংরড়হ এবং ঋধষংব পড়হংপরড়ঁংহবংং. ঙনলবপঃরাব ওষষঁংরড়হ বা বস্তুগত বিভ্রান্তি বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, নির্দিষ্ট স্থান থেকে কোন বস্তুকে কীরূপ দেখতে পাই বা ঐ বস্তুটি আসলে দেখতে কিরকম দেখায়। যেমন- চন্দ্র, সূর্যের আপেক্ষিক আকারের কথাই ধরা যাক। বস্তুতপক্ষে আমাদের পৃথিবী থেকে চন্দ্র, সূর্যকে দেখলে তাদের আকার প্রায় একই বলে মনে হবে। (এই বিষয়ে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত তার আগন্তুক সিনেমায় বেশ কিছু চমকপ্রদ সংলাপ উপস্থাপন করেছিলেন)। কিন্তু এই পরিলক্ষণের সমাপ্তি টেনে আমরা বলতে পারি যে, পৃথিবী থেকে চন্দ্র সূর্যকে সমান আকারের বলে মনে হলেও তাদের ভর বা ঘনত্বের বিবেচনায় তা মারাত্মক ভুলই হবে। আবার এটাও অস্বীকার করার আপাত উপায় নেই যে, পৃথিবী থেকে চন্দ্র সূর্য দেখতে একই রকম দেখায়- এটা ভুল। এটাই ঙনলবপঃরাব ওষষঁংরড়হ বা বস্তুগত বিভ্রান্তি। ঙনলবপঃরাব ওষষঁংরড়হ নিয়ে মার্ক্সের অণে¦ষণ কোন বস্তুর বহিস্থ আকার পর্যবেক্ষণে স্থানিক নির্ভরতার বিজড়ণ অনুধারণের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। ঙনলবপঃরাব ওষষঁংরড়হ বিষয়টি শোষণমূলক সমাজে শ্রমিকদের শোষণের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রবণতা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে যাতে ঐ সমাজে শোষণ যে চলছে তা তারা বুঝতে পারেনা। শ্রম শোষণমূলক সমাজে ঙনলবপঃরাব ওষষঁংরড়হ এর স্বপক্ষে মার্কসের বহুল অণে¦ষণমূলক উদাহরণটি হলো- ঋধষংব ঈড়হংপরড়ঁংহবংং. (ভ্রান্ত স্বজ্ঞান) এই ধারণাটির অবতারণা মার্কসের নিজস্ব হলেও বর্তমান সময়ে এটির বহুবিধ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। ঙনলবপঃরাব ওষষঁংরড়হ ধারণাটি বোঝার জন্য এর একটি শক্তিশালী প্রয়োগক্ষেত্র উদাহরণ হিসাবে টানা যায়। যেমন- অত্যন্ত যোনতাপূর্ণ সমাজে অবহিত রাজনৈতিক আন্দোলনের অনুপস্থিতিতেও নারী বা পুরুষ তাদের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে না। যেহেতু সমাজে এমন সব জেন্ডার অসমতার উপাদান রয়েছে যেগুলো পরিবার থেকে উদ্ভূত মনে হলেও বাস্তবে তা সততার চাদরে মোড়া সমাজ নির্দেশিত পদস্থিত সাধুতা বলে লালিত হয়।
তবে যাইহোক, মার্কসকে একটি সংক্রীর্ণ সূত্রধারার পরিপেক্ষিতে বিবেচনা করা বিপজ্জনক। যেমন তাকে একজন মামুলি বস্তুবাদী হিসাবে দেখা হয়। অথচ তিনি প্রচলিত মত এবং বিশ^াসের গুরুত্বের উপর ভিত্তি করে বিশ^কে ব্যাখ্যা না করে বরং বস্তুগত শর্তাবলীর গুরুত্বের আলোকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেছিলেন। এটা শুধু মার্কস সম্পর্কে মারাত্মক অপব্যাখ্যা নয় যে, তিনি শুধু ধারণা ও বস্তুগত অবস্থার (ওফবধং ধহফ গধঃবৎরধষ ঈড়হফরঃরড়হ) মধ্যে দ্বিমূখী সম্পর্কের উপর জোর দিয়েছিলেন। অধিকন্তু এটা ধারণার সুদূর প্রসারী ফলাফল দেখার ক্ষেত্রে একটি মারাত্মক সুযোগের হাতছাড়া হতে পারে যেটার উপর মার্কস গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করেছেন।
ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার শৃংখলা নিয়ে বিতর্কের সাথে আমি বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চাই। এরিক হবসবাউম এর অপেক্ষাকৃত কমঅধিত একটি লেখা আছে, ডযবৎব অৎব ইৎরঃরংয ঐরংঃড়ৎরধহ এড়রহম?- যেটি ১৯৫৫ সালে গধৎীরংঃ ছঁধৎঃবৎষু তে ছাপা হয়েছিল। যেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছের- সমকালীন বিশে^র তুলনায় বুদ্ধিভিত্তিক সমাজে কিভাবে মার্কসবাদী নির্দেশক আইডিয়া ও বস্তুগত অবস্থার মধ্যে দ্বিমূখী সম্পর্ক অত্যন্ত বিপরীত শিক্ষা দিয়েছিল যা মার্কস তার চারপাশে অহরহ দেখেছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, হেগেল এবং হেগেলিয়ানরা বস্তুগত অবস্থার উপর ধারণার প্রভাবকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে খুব বেশী জোর দিয়েছিলেন। এর বিপরীতে, বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের ইতিহাসের প্রভাবশালী বিদ্যালয়গুলোর প্রবণতা কি ছিল?- হবসবাউম এখানে লুইস বার্ণস্টেইন নেইমারের প্রভাবশালী ঐতিহাসিক রচনাগুলোর উল্লেখ করেছেন। তারা এমন একটি বস্তুবাদকে আলিঙ্গণ করতে চেয়েছেন যা মানুষের কর্মকে পুরোপুরিভাবে সহজেই একটি সাধারণ বস্তুগত স্বার্থে অনুপ্রাণীত করে তুলেছিল- বিশেষভাবে বলতে গেলে আরো সংকীর্ণ-ব্যক্তিস্বার্থে প্ররোচিত করেছিল। এটা সম্পূর্ণই ভিন্ন ধরণের পক্ষপাতে দুষ্ট। হবসবাউম যুক্তি দেখান যে, বর্তমানে মার্কসীয় লাইন বিশ্লেষণের জন্য একটি সুষম দ্বিমূখী দর্শন অবশ্যই দাবি করে। বিশেষত বস্তুগত অবস্থার উপর ধারণা এবং এর প্রভাব কি হতে পারে সে বিষয়ে জোর দেয়া উচিৎ।
উদাহরণস্বরূপ এটি স্বীকার করা অত্যন্ত জরুরী যে, ব্রিটিশ ভারতে বহুলালোচিত অভিশংসনের শুনানীর সময় ওয়ারেন হেস্টিং এর দুর্ব্যব্যহারের প্রতি এডমুন্ড বার্ক প্রভূত সমালোচনা করেছিলেন। বিষয়টি সরাসরি বার্কের দৃঢ়ভাবে বিচার পরিচালনা এবং ন্যায়পরায়ণ চিন্তার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। পক্ষান্তরে নেইমারের মতো স্বার্থপর, স্বমোহিত তথাকথিত বস্তুবাদী ঐতিহাসিকরা মনে করেন, ওয়ারেন হেস্টিংস এর অনুসৃত নীতির কারণে বার্কের প্রতি যে অসন্তোষ তৈরী হয়েছে তার তুলনায় তার (বর্কের) স্বআহরিত উদ্বেগের প্রভাবে তিনি বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এটি সংকীর্ণভাবে বস্তুবাদের প্রতি অতিনির্ভরশীলতা- যার সংশোধন প্রয়োজন। হবসবাউম যুক্তি তুলে ধরেন যে, প্রাক-নেইমার যুগে রাজনীতির বস্তুবাদী নীতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মার্কসবাদীরা এটিকে তাদের প্রধান ঐতিহাসিক কর্তব্য বলে মনে করতো। কিন্তু বুর্জোয়া ঐতিহাসিকেরা যখন প্রথাগত বস্তুবাদের যে নির্দিষ্ট স্বরূপ গ্রহণ করেছেন, তখন মার্কসবাদীরা তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, ইতিহাস হলো চিন্তাশীলতার জন্য মানুষের সংগ্রাম এবং সেইসাথে তাদের বস্তুগত পরিবেশের প্রতিবিম্ব। বিখ্যাত ডানপন্থী ঐতিহাসিক মিস্টার ট্রেভর রোপার এটা বিশ^াস করে শুধু ভুলই করেন নি যে, ইংরেজ বিপ্লব ছিল দেশের বনেদি ভদ্রলোকদের ভাগ্যের পতনশীলতার প্রতিফলন। আবার তার বিশ^াসে এটাও ছিল যে, পিউরিটানিজম (চঁৎরঃধহরংস-শুদ্ধিবাদ) ছিল তাদের অত্যাসন্ন দেউলিত্বের প্রতিফলন।
হবসবাউম এর সমালোচনার সাথে এটি যোগ করা যায় যে, তথাকথিত ‘যুক্তিসংগত পছন্দ তত্ত্ব’ হলো- (জধঃরড়হধষ ঈযড়রপব ঞযবড়ৎু- এটি সাম্প্রতিককালে মূলধারার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বেশ প্রভাব বিস্তার করছে) যা একক মনস্তাত্ত্বিক কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করে মানুষের একক প্রেরণার বিষয় হিসাবে একক ব্যক্তিস্বার্থে প্রতিফলিত হয়, যার ফলে ব্যাপকভাবে সামাজিক ভারসাম্য হারিয়ে যায়Ñ যার জন্য মার্কস গভীর যুক্তি উপস্থাপন করছিলেন। বস্তুত একজন যুক্তিসংগত পছন্দ তত্ত্বের সমর্থক মার্কসের ঊপড়হড়সরপ ধহফ চযরষড়ংড়ঢ়যরপ গধহঁংপৎরঢ়ঃং ধহফ ঞযব এবৎসধহ ওফবড়ষড়মু পড়ে অনেক বিষয় জানতে পারেন। যদিও মার্কস হেগেলিয়ানদের বিবেচনার জন্য যা চেয়েছেন তা থেকে এটা অন্য ধরণের পাঠ হতে পারে। তবে এটি মার্কসের অসাধারণ শিক্ষাবিজ্ঞানের উভয় অংশকে চিহ্নিত করণ এবং দ্বিমূখী সম্পর্কের বিচার-বিশ্লেষণে পথ তৈরি করে দিবে। আবার মার্কসের চিন্তা ভাবনাকে সংকীর্ণ দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার প্রবণতা পরিহার করার উপায়ও খুঁজে পাওয়া যাবে।
পরিশেষে, ২০০তম জন্মদিনে মার্কসকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে আমরা কেবল একজন মহান বুদ্ধিজীবীকে উদযাপন করি না বরং এমন একজন ব্যক্তিকে উদযাপন করি সমাজ সভ্যতা সম্পর্কে যার সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ও পুংখানুপুংখ পরীক্ষা আমাদেরকে অনেকগুলো অন্তর্নিহিত তাৎপর্য তুলে ধরার প্রস্তাব দেয়। তাই মার্কসের প্রতি সম্মান জানানোর চেয়ে তার কর্মের গবেষণা করার প্রতি গভীর মনোযোগ দেওয়া এখন সময়ের দাবী।
(ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে অনুবাদ করেছেন শহীদ রাজু, নির্বাহী সম্পাদক, প্রবাস মেলা।)
অমর্ত্য সেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ, হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও দর্শনের অধ্যাপক।
দিল্লির পাঠ চুকিয়ে দেশে ফিরে কাজ করতে চাই… হৈমন্তী বড়–য়া
উচ্চশিক্ষা কিংবা জীবিকার তাড়নায় তরুণ বয়সে অনেকেই বিদেশে পাড়ি দেয়। স্বচ্ছল পরিবারের সদস্যরা উচ্চশিক্ষার জন্য প্রবাসে পাড়ি জমান। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা জীবনের তাড়নায় উন্নত জীবনের আশায় দেশ ছাড়েন। ছাত্র কিংবা কর্মজীবী দু’ধরনের তরুণ-তরুণী দেশের মায়া ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে থাকেন। এই কঠিন সময়ে একদিকে যেমন দেশ ও প্রিয়জন থেকে দূরে থাকার বেদনা থাকে, তেমনি থাকে সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর সংগ্রাম। এমন ঘরকুনো মানসিকতার জন্য প্রবাস জীবনে বিশ্বকে জানা ও দেখার অপার আনন্দ প্রায়শ: ম্লান হয়। তাদেরও মনের গভীরে স্বদেশের সোনালি স্মৃতি বার বার জেগে উঠে। প্রবাসে প্রতিটি তরুণ-তরুণী পুনরায় ঘরে ফিরতেই ব্যাকুল হয়ে থাকেন সারাটিক্ষণ। মনের গভীরে থাকে পুনরায় ঘরে ফিরে আসার ব্যাকুলতা। ঠিক তেমনি এক বাংলাদেশি হৈমন্তী বড়–য়া সারাক্ষণ ব্যাকুল হয়ে থাকেন দেশে আসার জন্য। প্রায় ২ দশক ধরে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন শহরে পড়ালেখা করছেন। সম্প্রতি তিনি দেশে এসে প্রবাস মেলা কার্যালয় পরিদর্শনে আসেন। আলাপচারিতায় উঠে আসে তার শিক্ষা জীবনের নানান গল্প। প্রবাস মেলা’র পাঠকদের জন্য সেসবের বিশেষ অংশ তুলে ধরছেন মোস্তফা কামাল মিন্টু।
বিগত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের হার অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এইচএসসি কিংবা স্নাতক পাস করেই উচ্চতর ডিগ্রী লাভের আশায় অনেকেই পাড়ি দিচ্ছেন ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর নানা দেশে। সে তুলনায় আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার হার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তেমনই একজন হৈমন্তী বড়–য়া। জন্ম ঢাকায়। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ই বাবা-মায়ের ইচ্ছায় কলকাতায় চলে যান। সেখানকার শ্রী শিক্ষায়তন স্কুল, কলকাতা থেকে মাধ্যমিক ও স্কটিজ চার্চ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে সম্মান ডিগ্রিও শেষ করে নেন। পরে দিল্লিতে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে সমাজ বিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করেন। এরপর ২০১৪ সালে এমপিল ডিগ্রিও শেষ করেন। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পিএইচডিতে ভর্তি হন। পিএইচডিতে তার বিষয় হচ্ছে ঝড়ঁঃয অংরধ: ওহফরধ ধহফ ইধহমষধফবংয ঋড়ৎবরমহ চড়ষরপু
অনেক দেশ থাকতে ভারতে কেনো উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে হৈমন্তী জানান, ছোট বেলায় পরিবারের সিদ্ধান্তে কলকাতায় পড়তে গেলেও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে নিজের ইচ্ছাতেই ভারতে পড়াশোনা করতে থাকি। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে সেখানকার ভাষা, সংস্কৃতিসহ নানান বিষয়ে আমাদের দেশের সাথে মিল রয়েছে, এছাড়া ভারতে এখন বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রতিবছর শত শত শিক্ষার্থী ভারতে উচ্চশিক্ষার্থে গেলেও সে তুলনায় বাংলাদেশে খুব কম শিক্ষার্থী ভারত থেকে আসেন বলে হৈমন্তী বড়–য়া মনে করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি প্রচারের অভাবকেই দায়ী করছেন। তিনি জানান, বাংলাদেশের সাথে ভারতের রয়েছে ঐতিহাসিক সম্পর্ক। শিক্ষা, সাংস্কৃতি, ভাষা ছাড়াও নানান বিষয়ে দু’দেশের রয়েছে অনেক মিল। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত অকৃত্রিম বন্ধুর পরিচয় দিয়েছে। ফলে দু’দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সম্পর্কও অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক ভালো। তাই দু’দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সম্পর্ক আরো জোরদার হলে উভয় দেশই লাভবান হবেন বলে তিনি মনে করেন।
হৈমন্তী জানান, বিদেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা অনেক ভালো করছে। একাডেমিক রেজাল্টের পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামগুলোতে মেধার স্বাক্ষর রাখছেন আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা। পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরবেন কিনা এমন প্রশ্নে কৃতি এই শিক্ষার্থী জানান, নিশ্চয়ই আমি আমার মাতৃভূমিতে ফিরতে চাই, আমার অর্জিত মেধাকে মাতৃভূমির উন্নয়নে কাজে লাগাতে চাই। সেজন্য রাষ্ট্রেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছেন বলে তিনি মনে করেন। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে হৈমন্তী জানান, এদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা যারা দেশে কিংবা বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বিদেশ চলে যায় তাদের মেধাকে দেশ গড়ার কাজে লাগাতে সরকারকেই কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। নিজ দেশে অনুকূল পরিবেশ পেলে কখনোই মাতৃভূমি ছেড়ে বিদেশ গড়ার কাজ করতে পারবেনা।
ভবিষ্যতে কি হতে চান অর্থাৎ পড়ালেখা শেষে আপনার স্বপ্ন কি এমন প্রশ্ন করতেই হেসে ওঠেন হৈমন্তী বড়–য়া। এরপর বলেন, ভবিষ্যতে আমি শিক্ষকতা করার পাশাপাশি উন্নয়ন বিষয়ে গবেষণায় নিজেকে কাজে লাগাতে চাই। নিজেকে এগিয়ে চলার জন্য কাকে প্রেরণা হিসেবে পেয়েছেন? এর জবাবে হৈমন্তী তার বাবা ভবেশ বড়–য়া, মা মেরী বড়–য়া ও বড় বোন মিথুন বড়–য়ার উৎসাহ ও প্রেরণাই নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার পাথেয় হিসেবে নিয়েছেন বলে তিনি জানান।