বাংলাদেশের অর্থনীতি যে কয়টি ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স অন্যতম। মূলত এ কারণেই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশকে এখন বিশে^র রোল মডেল ধরা হয়। কিন্তু রেমিটেন্সের প্রাণ প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি উদাসীনতা সবসময়ই পরিলক্ষিত হয়। তাদের ন্যায্য অধিকারগুলো প্রায় সময় আড়ালেই থেকে যায়, অথচ লক্ষ-কোটি প্রবাসীর ঘামে ও হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফসল-ই হল আজকের এই সোনার বাংলাদেশ। এসকল বীর প্রবাসীদের দেশে ও বিদেশে নানান সমস্যা চিহ্নিত করে তাদের অধিকার আদায়ের প্লাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কানেক্ট বাংলাদেশ’ (Connect Bangladesh)। ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন ও প্রবাসীদের অধিকার’ এই স্লোগানকে নিয়ে কানেক্ট বাংলাদেশ তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি এই সংগঠনের দুই কেন্দ্রীয় নেতা বাংলাদেশ সফরে এসে এক বিকেলে ‘প্রবাস মেলা’ কার্যালয় পরিদর্শনে আসেন। তাদের একজন যুক্তরাজ্য প্রবাসী মোহাম্মদ শিবলী সাদিক অন্যজন যুক্তরাজ্য ও ইতালি প্রবাসী নুরুল আমিন। দু’জনই কানেক্ট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের সাথে আলাপচারিতায় কানেক্ট বাংলাদেশের আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন মো: মোস্তফা কামাল মিন্টু।
স্বাধীনতাত্তোর বিশেষ করে ৮০ ও ৯০’র দশকে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি কর্ম, জীবিকা অন্বেষণ ও উচ্চশিক্ষার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়। বহু দেশে অনেকে পরিবার পরিজন নিয়ে থাকছেন, যাদের এখন তৃতীয় প্রজন্ম চলছে। অনেক দেশে আমাদের সূর্য সন্তানেরা সংসদ সদস্য, মেয়র নির্বাচিত হচ্ছেন। অনেকে ব্যবসা বাণিজ্যসহ নানান পেশায় ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছেন। তারা সেসব দেশে প্রতিষ্ঠিত বলে জন্মভূমিকে একেবারেই ভুলে যাননি। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের স্বপ্নের কথাও আমরা প্রায় সময় মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি।
বিশ্বব্যাপি প্রবাসী বাংলাদেশিদের অধিকার আদায়ে কাজ করে যাচ্ছে কানেক্ট বাংলাদেশ, প্রায় ৩০টি দেশে এ সংগঠনের কমিটি রয়েছে। যুক্তরাজ্য প্রবাসী মোহাম্মদ শিবলী সাদিক এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন। সংগঠনের মাসিক অনলাইন কন্ফারেন্সেরও তিনি লন্ডন থেকে সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় কানেক্ট বাংলাদেশ কেন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, এই সংগঠনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য-ই বা কি? এর জবাবে মোহাম্মদ শিবলী সাদিক জানান, এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্যই হল প্রবাসীদের অধিকার ও বাংলাদেশের উন্নয়ন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিক অধিকার বঞ্চিত প্রবাসী, তাদের অধিকার সুরক্ষা এবং প্রবাসে সুষ্ঠু জীবন-যাপন করার জন্য ‘কানেক্ট বাংলাদেশ’ কাজ করছে। এছাড়াও প্রবাসে বাংলাদেশ ভাবনা ও এর উন্নয়নে প্রবাসীদের অবদান, সম্ভাবনা ও অংশগ্রহণ করার জন্য ‘কানেক্ট বাংলাদেশ’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ‘কানেক্ট বাংলাদেশে’র মাধ্যমে প্রবাসীদের কিছু দাবি তুলে ধরে বলেন, সকল নির্বাচনে দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, দ্বৈত নাগরিকত্ব আইনের প্রবাসীদের স্বার্থ বিরোধী ধারা বাতিল, দেশের সকল উপজেলায় ১০০ একর সরকারি জমি বরাদ্দ দেয়া, যেখানে প্রবাসী ব্যবসায়ীরা স্পেশাল অর্থনৈতিক জোন হিসেবে তৈরি করবে, সমুদ্রের ব্লু ইকোনোমিতে বিনিয়োগের জন্য প্রবাসীদের বিশেষ সুবিধা দেয়া, উন্নত দেশের গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, সুশাসন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, বিকেন্দ্রীভূত গণতান্ত্রিক প্রশাসন ইত্যাদি বিষয়ে প্রবাসীদের জ্ঞান দেশের প্রয়োজনে কাজে লাগানো, প্রবাসীদের বিশেষ রেজিষ্ট্রেশন সিস্টেম এর মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান (এনআরবিআইডি) করার জোর দাবি জানান।
বিশিষ্ট আইনজীবী মোহাম্মদ শিবলী সাদিক বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে প্রবাসী সরকার এর মাধ্যমে। তাই আমরা মনে করি যে রাষ্ট্রের উৎপত্তি প্রবাসী সরকারের মাধ্যমে সে রাষ্ট্র প্রবাসীদের কখনো অবজ্ঞা করতে পারেনা। তারা নিশ্চয়ই সে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে। বাংলাদেশের সংবিধানে যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলা হয়েছে সে বিবেচনায় আমি মনে করি প্রত্যেক প্রবাসী একেকজন অর্থনৈতিক মুক্তিযোদ্ধা। বিদেশে তারা দেশের সম্মানার্থে দূতের ভূমিকা পালন করেন, অথচ দেশে তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির নিরাপত্তা নেই। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নেই, প্রায়ই শোনা যায় প্রবাসীর বাড়িতে চুরি, ডাকাতি হয়েছে। সেজন্য আমরা ‘কানেক্ট বাংলাদেশে’র মাধ্যমে প্রবাসীদের মৌলিক দাবিগুলো বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি ক্ষোভের সাথে জানান, বাংলাদেশের গোটা বাজেটের, আমদানী বাণিজ্যের, গার্মেন্টস শিল্পের, মেলামাইন ইন্ডাষ্ট্রি, ব্যাংক, বীমা এমন কোন সেক্টর নেই যেখানে প্রবাসীদের অবদান নেই, অথচ বিমান বন্দরে প্রবাসীদের কামলা বলে গালি দেওয়া হয়! যাদের পাঠানো রেমিটেন্সের উপর ভিত্তি করে দেশের অর্থনৈতিক চাকা ঘুরছে, দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়শীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে তাদের সাথে এমন আচরণ কোন সভ্য দেশে হতে পারেনা। তিনি বলেন, আমরা যখন বিভিন্ন প্রয়োজনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাই, সেদেশের বিমান বন্দরে আমাদের সম্মানের সাথে অর্ভ্যথনা জানানো হয়। অথচ নিজের দেশের বিমান বন্দরে আমাদেরকে অসদাচারণ (হ্যারেজমেন্ট) এর মাধ্যমে রিসিভ করা হয়! এটা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট মহলের এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
সংগঠনের আরেক কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল আমিন জানান, আমি প্রায় ৩৫ বছর বিদেশে থাকি, ইউরোপের দেশ ইতালিতেই ছিলাম প্রায় ৩১ বছর, লন্ডনে আছি ৪ বছর যাবত। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে অনেক প্রবাসী সংগঠনের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। খুব কাছ থেকে প্রবাসীদের দেখার সুযোগ হয়েছে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি দেশের জন্য প্রবাসীদের যে অবদান সে তুলনায় তাদেরকে একেবারেই মূল্যায়ন করা হয় না। সেজন্যই আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত প্রবাসীদের নিয়ে একটি কমিটি করে প্রবাসীদের সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি।
লন্ডন ও ইতালি প্রবাসী নুরুল আমিন বলেন, কানেক্ট বাংলাদেশ একটি উন্নত ও সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করতে চায়। তিনি বলেন, এই সংগঠনের মাধ্যমে আমরা বিশ্বে আমাদের দেশের সংস্কৃতিক ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, ট্যুরিজম, উন্নয়ন তুলে ধরছি। পাশাপাশি আমরা চাই বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বাংলাদেশিদের মেধা, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তিজ্ঞান, কারিগরি দক্ষতা প্রভৃতি বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজে লাগিয়ে যেন দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করেন।
তিনি আরও বলেন, কানেক্ট বাংলাদেশে’ এর মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ, বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি সমৃদ্ধকরণ, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, মানবিক অধিকার ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছি। আমরা আশা করছি দেশের জন্য আমাদের এ অগ্রযাত্রায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহল সহযোগিতার হাত বাড়াবে।
বিভিন্ন দেশে কানেক্ট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী: লুত্ফা হাসীন রোজী-যুক্তরাষ্ট্র, শিব্বির আহমেদ- যুক্তরাজ্য, মনসুর চৌধুরী- ফ্রান্স, ফজলুর রহমান-জার্মানি, নূরুল আমিন- যুক্তরাজ্য, সিকদার গিয়াসউদ্দিন-যুক্তরাষ্ট্র, শাহ্ আলম- ইতালি, শেখ সাদী- ফ্রান্স, আসাদুজ্জামান- সুইজারল্যান্ড, আখি সীমা কাওসার- ইতালি, মো: ইলিয়াস মিয়া- কানাডা, মোহাম্মদ শিবলী সাদিক- যুক্তরাজ্য, মাবুদ সাঈদ- যুক্তরাজ্য, সামছুল হক পাখি- ইতালি, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ- কুয়েত, আব্দুর নূর দুলাল- বাংলাদেশ। এছাড়াও প্রায় ৩০টি দেশে ‘কানেক্ট বাংলাদেশে’র বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্য রয়েছেন।
উল্লেখ্য, আগামী ২৬, ২৭, ২৮ অক্টোবর, ২০১৮ সংগঠনটির রোম সম্মেলনকে ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে বলে দুই কেন্দ্রীয় নেতা জানান। তারা বলেন, কানেক্ট বাংলাদেশের রোম সম্মেলনে সকল কেন্দ্রীয় নেতাসহ বিভিন্ন দেশের প্রবাসীদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে এদেশের উন্নয়নে প্রবাসীদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি জোর দিয়ে জানানো হবে।