অনেক গুণে গুণান্বিত তিনি। দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বসে থাকেননি, পাক হানাদার বাহিণীর বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়েছেন। ছিলেন ছাত্রনেতা, একসময় নিজের জীবন ও পরিবারের জীবনের একটু বেশি স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য আমেরিকায় পাড়ি জমান। সেখান থেকে পরে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন কানাডায়। এখন তিনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিজেকে বেশি সময় দেন। যার কথা বলছিলাম তিনি হলেন বীর মুক্তিযুদ্ধা মোহাম্মদ ইলিয়াছ মিয়া। সম্প্রতি তিনি দেশে এসে এক বিকেলে এসেছিলেন প্রবাস মেলা কার্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের রোমাঞ্চকর গল্পের পাশাপাশি প্রবাস জীবনের নানা গল্প শুনিয়েছেন প্রবাস মেলা পাঠকদের জন্য।
একজন স্বজ্জন ব্যক্তি হিসেবে দেশে বিদেশে পরিচিত মুখ মোহাম্মদ ইলিয়াছ মিয়া। বর্তমানে তিনি কানাডায় স্থায়ীভাবে থাকলেও নিজের জন্মভূমির উন্নয়ন নিয়ে সবসময় চিন্তায় মগ্ন থাকেন। এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারিগর রেমিটেন্স যোদ্ধাদের অধিকার আদায়ে প্রতিষ্ঠিত কানেক্ট বাংলাদেশের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন।
মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইলিয়াছ মিয়া চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় কাটির হাট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও নাজিরহাট ডিগ্রি কলেজ থেকে এইসএসসি পাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ও এমএ ডিগ্রি নেন।
এক প্রশ্নের জবাবে কৃতি এই প্রবাসী জানান, আমি দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেকের মত আমিও পাক হানাদারদেও বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর ইতিহাসের সেরা হত্যাযজ্ঞ চালায় যাতে হাজার হাজার নিরীহ নারী, পুরুষ, শিশু প্রাণ হারায়। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে গমন করি, শুরুতে ত্রিপুরা রাজ্যের হরিনা ট্রানজিট ক্যাম্পে অবস্থান পরে অম্পি নগরের ট্রেনিং সেন্টারে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে জুলাই মাসে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। এরপর ১ নং সেক্টরের অধীনে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাওজান ও চট্টগ্রাম মহানগরের বেশ কিছু এলাকায় পাক হানাদারদের বিরেুদ্ধে যুদ্ধে লড়াই করি।
কোন প্রেরণা থেকে আপনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আমাদের একমাত্র স্বপ্ন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। আমাদের কোন কিছুর লোভ ছিলোনা, টাকার জন্য কিংবা ক্ষমতার জন্য আমরা যুদ্ধ করিনি। দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ভালোবেসে একটি সুন্দর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি। আমরা চেয়েছিলাম ঘুষ, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শোষণমুক্ত বাংলাদেশ যেখানে সমাজের প্রতিটি মানুষ মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার গ্যারান্টি থাকবে, কিন্তু স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও স্বাধীনতার লক্ষ্য ও আদর্শ এখনও পরিপূর্ণতা পায়নি।
মোহাম্মদ ইলিয়াছ মিয়া ১৯৮৬ সাল থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে দক্ষতার সাথে কাজ করেছেন।
এরপর ৯০ এর মাঝামাঝিতে মোহাম্মদ ইলিয়াছ মিয়া ভিজিট ভিসায় আমেরিকায় চলে যান। সেখানে তিনি নিউইয়র্ক সিটি বোর্ড অব এডুকেশন (Nwe York City Board of Education) এর অধীনে সাবস্টিটিউট টিচার (Substitute Teacher) হিসেবে কিছুদিন কাজ করে। তারপর নিউইয়র্ক সিটি গভর্ণমেন্ট এর অধীনে ৭ বছর Case Manager হিসেবে কাজ করেন। সেখান থেকে ১৯৯৮ সালে ইমিগ্রেশন নিয়ে স্থায়ীভাবে কানাডায় চলে যান তিনি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ৯৭ সালে কানাডায় প্রফেশনাল ও দক্ষ লোক নেয়ার জন্য বিজ্ঞাপন দেখে আমি এপ্লিকেশন করে সেদেশের পারমানেন্ট রেসিডেন্ট এর অনুমোদন পেয়ে ৯৮’র ফেব্রুয়ারি মাসে কানাডায় চলে যাই। সেখানে আমি কানাডার নাম্বার ওয়ান কোম্পানি (Rogers Communication) এ Sales Consultant পদে এখনও কাজ করছি। এই কোম্পানিতে পুরো কানাডাতে আমি সেল্স কনসালটেন্ট হিসেবে প্রথম হয়েছি। একজন বাংলাদেশি হিসেবে এটা নিয়ে আমি গর্ব করি।
জীবনের এই পর্যায়ে এসে পেশাগত, প্রবাসে বাংলাাদেশ কমিউনিটি, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকার ফলে অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন মোহাম্মদ ইলিয়াছ মিয়া।
কমিউনিটি: ২০১০ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিল এর পক্ষ থেকে স্পীকার ক্রিস্টিন সি কুইন কর্তৃক উত্তর আমেরিকান কমিউনিটিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তাকে প্রক্লেমেশন প্রদান করা হয়।
সামাজিক, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া বিষয়ক: বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিট কমান্ড এর ২০১২ থেকে সদস্য সচিব হিসেবে কাজ করছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন অফ কানাডা ইন্ক টরেন্টোর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। চট্টগ্রাম এসোসিয়েশন অফ কানাডা ইন্ক টরেন্টোর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম এসোসিয়েশন অফ নর্থ আমেরিকা ইন্ক নিউইয়র্ক এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
মোহাম্মদ ইলিয়াছ মিয়া চট্টগ্রাম সমিতি, ঢাকা এর আজীবন সদস্য, এছাড়া কাটির হাট মহিলা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম এর প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ডেমোক্রেটিক এসোসিয়েশন নিউইয়র্ক এর সহ-সভাপতি, বাংলাদেশি আমেরিকান পাবলিক এ্যাফেয়ার্স ফ্রন্ট নিউইয়র্ক এর সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ কানাডা শাখার সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি চট্টগ্রাম, মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ এবং কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা চট্টগ্রাম এর আজীবন সদস্য হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
রাজনৈতিক কর্মকান্ড: মোহাম্মদ ইলিয়াছ মিয়া বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি, সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম উত্তর জেলা শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সহ জেলা, উপজেলার নানা পর্যায়ে বিভিন্ন পদে দক্ষতার সাথে কাজ করেছেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে সংযোগ স্থাপন করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত কানেক্ট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মোহাম্মদ ইলিয়াছ মিয়া জানান, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও প্রবাসীদের অধিকার এই স্লোগান নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এক কোটিরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশিরা যাতে দেশে-বিদেশে নিরাপদে থাকতে পারে, দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে সে সুযোগটুকু করে দিতে হবে। আমরা চাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মেধা ও যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে যাতে ভূমিকা রাখতে পারে সরকারকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।
(আলাপচারিতায় সাক্ষাতকারটি তৈরি ও সম্পাদনা করেছেন মো: মোস্তফা কামাল মিন্টু।)