প্রবাস মেলা ডেস্ক: বহুজাতির দেশ কানাডা রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে স্বীকৃতি দিতে এ সংক্রান্ত একটি বিল সর্বসম্মতিক্রমে সংসদে পাস করেছে (৩২৫ বনাম শূন্য ভোট) গত ১৫ জুন। চলতি সপ্তাহের শুরুতে কানাডিয়ান সিনেট থেকে বিলটি ‘থার্ড রিডিং’সহ চূড়ান্তভাবে পাস হয়েছে। অপেক্ষা এখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণার, যা কানাডার রানীর প্রতিনিধি ঘোষণা করবেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে কানাডা হতে যাচ্ছে সর্বপ্রথম দেশ যারা সবার আগে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটিকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে।
সালাম, বরকত ও রফিকসহ বহু বাঙালির আত্মত্যাগে বাঙালি জাতি তার মায়ের ভাষা ফিরে পেয়েছে। যার পথপরিক্রমায় বিশ্বের সব মায়ের ভাষা সংরক্ষণে বৈশ্বিক স্বীকৃতি মিলেছে। জাতিসংঘ ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। মায়ের ভাষা সংরক্ষণে এখন সারাবিশ্বে ২১ ফেব্রুয়ারিকে গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। জাতিসংঘের পর একক দেশ হিসেবে কানাডা সরকারের স্বীকৃতি পাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৩ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হবে কানাডার জাতীয় ভাষা দিবস হিসেবে। গত দেড় দশক ধরে কানাডায় রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে ভাষা দিবস হিসেবে যুক্ত করার জন্য কানাডার মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড সোসাইটি থেকে যে প্রচেষ্টা চলছিল, তা আরও একধাপ এগিয়ে গেছে সফলতার দিকে। কানাডিয়ান সংসদে এই সংক্রান্ত বিল গত ১৫ জুন (বিএল এস-২১৪) ৩২৫ বনাম শূন্য ভোটে পাস হয়েছে। কানাডার এমপি কেন হার্ডি বিলটি পার্লামেন্টে উত্থাপন করেন। বিলটি এরই মধ্যে কানাডিয়ান সিনেট থেকেও থার্ড রিডিংসহ চূড়ান্তভাবে পাস হয়েছে। সিনেটর মবিনা জাফের বিলটি সিনেটে উত্থাপন করেছিলেন। কানাডার এমপি কেন হার্ডি এবং সিনেটর মবিনা জাফের মাতৃভাষা এবং একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য অনুধাবন করায় এবং তাদের কয়েক বছরের আন্তরিক চেষ্টায় বিলটি পাস হয়েছে।
কানাডা থেকে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড সোসাইটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম গতকাল এই প্রতিবেদককে ‘কানাডা সরকার যাতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয় এ জন্য আমরা পরিশ্রম করেছি এবং আমাদের পরিশ্রম কাজে লেগেছে। কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সিনেটর মবিনা জাফর সর্বপ্রথম দেশটির সিনেট থেকে এই সংক্রান্ত একটি বিলের অনুমোদন পেতে সহযোগিতা করেন। কানাডার সিনেট কমিটিতে কয়েক ধাপ পর্যালোচনার পর গত জানুয়ারিতে সিনেট কমিটি বিষয়টি অনুমোদন করেছে। সিনেট কমিটিতে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সিনেটর মবিনা জাফরি ইস্যুটি স্পন্সর করেন। সর্বশেষ কানাডার আরেকজন সিনেটর কেন হার্ডির স্পনসরে কানাডার সংসদ থেকে বিলটি গত জুনে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন লাভের পর কানাডিয়ান সিনেট থেকেও বিলটি থার্ড রিডিংসহ চলতি সপ্তাহে পাস হয়েছে। এখন কানাডার রানীর প্রতিনিধি বিষয়টির চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে। অনুমোদনের পর কানাডা হবে প্রথম দেশ যারা রাষ্ট্রীয়ভাবে একক দেশ হিসেবে সর্বপ্রথম আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।’
জাতিসংঘ এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছে। যা বিশ্বে স্বীকৃত। এর মধ্যে একক দেশের স্বীকৃতি দেওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে কানাডার মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড সোসাইটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘জাতিসংঘ তার নিজস্ব আইডেন্টিতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্র সরকারিভাবে দিবসটি ঘোষণা করেনি। যা কানাডা করতে যাচ্ছে। প্রতিটা রাষ্ট্র যদি সরকারিভাবে দিবসটি ঘোষণা করে তবে সব রাষ্ট্রেই বাধ্যবাধকতা হিসেবে প্রতিবছর দিবসটি উদযাপন করা হবে। এতে একুশের চেতনার প্রকৃত বাস্তবায়ন ঘটাতে এবং বিশ্বের সব মায়ের ভাষা সংরক্ষণে সচেতনতা সৃষ্টি ত্বরান্বিত হবে।’
মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম আরও বলেন, ‘একুশের চেতনা ছড়িয়ে দিতে এর আগে আমরা কানাডার সারা শহরে একটি স্থায়ী মনুমেন্ট স্থাপন করেছি। এবার কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে শহীদ মিনারের আদলে একটি মনুমেন্ট স্থাপন করছি। পাশাপাশি একুশের চেতনাকে বৈশ্বিক পর্যায়ে আরও ছড়িয়ে দিতে ভ্যাঙ্কুভারে স্থাপন করতে যাওয়া শহীদ মিনারকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কাজ করছি। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি যে তারা যদি দেশের প্রতিটি মিশনে শহীদ মিনারের এই প্রতীক সম্পর্কে অবহিত করে, এতে একুশের চেতনার বিকাশ ত্বরান্বিত হবে।’
উল্লেখ্য নব্বইয়ের দশকে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম জাতিসংঘের কাছে সর্বপ্রথম একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানান। মাঝে অনেক ঘটনার পর বিগত ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ওই সময়ে ১৮৮টি দেশ এতে সমর্থন জানিয়েছিল। বিগত ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহ যথাযথ মর্যাদায় পালন করছে। এরপর ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে প্রতিবছর একুশ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ মর্মে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।
সূত্র: সময়ের আলো