ইসরাত জেবিন:
সময়ের আলোচিত নাম জো বাইডেন। গেল ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। যদিও সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে আর ট্রাম্পের সৃষ্ট নানা ঝামেলা পেরিয়ে স্বীকৃতি পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ভবনে ট্রাম্প সমর্থকদের নজীর বিহীন তা-বের পর বিলম্বিত অধিবেশনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পান জো বাইডেন। আসছে ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন তিনি। হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হতে যাওয়া এই মানুষটির জীবনের উত্থান-পতন সহ নানা অজানা দিক নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন-

ক্যাথলিক ধর্ম বিশ্বাসে বড় হওয়া জো বাইডেন এর পুরো নাম জোসেফ রবিনেট বাইডেন জুনিয়র। জন্ম ১৯৪২ সালের ২০ নভেম্বর। বাবা জোসেফ রবিনেট বাইডেন সিনিয়র এবং মা ক্যাথরিন ইউজেনিয়া ফিনেগান এর চার সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান বাইডেনের শৈশব কৈশোর কাটে স্ক্র্যান্টন, পেনিসিলভানিয়া এবং নিউ ক্যাসেল কাউন্টি ডেলওয়্যারে। ডেলওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয় এর পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে ১৯৬৮ সালে সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
শুরুতে আর্থিক অবস্থা ভাল থাকলেও বাইডেন এর জন্মের পর আর্থিক সংকটে পরে বাইডেনের পরিবার। ১৯৫০ সালে স্ক্র্যানটন অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়লে বাইডেন সিনিয়র পরিবারকে চালানোর মতো কাজ যোগাড় করতে সমস্যায় পড়ে যান এবং তখন তার পরিবার জো বাইডেন এর নানার পরিবারের সাথে থাকতেন। পরবর্তীতে তাদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয় এবং সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ির ব্যাবসা তার মধ্যবিত্ত পরিবারকে চালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল।

ছোটবেলায় কথা বলতে সমস্যায় পড়তেন বাইডেন। এজন্য স্কুলে সহপাঠীদের হাসি ঠাট্টার পাত্র হতেন তিনি। এমনকি অনেক শিক্ষকও তার এই সমস্যার জন্য তাকে নিয়া হাসাহসি করতেন। তোতলামি সমস্যা থেকে উত্তরণ পেতে তিনি নিয়মিত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করতেন। নিজের চেষ্টা, অধ্যবসায় আর পরিশ্রম দিয়ে ২০ বছর বয়সে তিনি এই সমস্যা থেকে মুক্তি পান।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হলেও বেশ মেধাবী ছিলেন জো বাইডেন। ছিলেন ভালো খেলোয়াড়ও। জুনিয়র এবং হাই স্কুলে ক্লাস লিডারের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ক্লেমাউন্টে Archmere Academy তে ফুটবল দলের সদস্য ছিলেন বাইডেন। খেলেছেন বেসবলও। এছাড়া ইউনিভার্সিটি অফ ডেলওয়্যারে স্বল্প সময়ের জন্য ফুটবল খেলছেন বাইডেন।

যদিও রাজনীতিতে বাইডেনের আগ্রহ ১৯৬১ সাল থেকে কিন্তু সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে আসেন আরও পরে। জো বাইডেন ক্যারিয়ার শুরু করেন আইনজীবী হিসেবে। উইলমিংটনে এক রিপাব্লিকান নেতার ‘ল’ ফার্মে। তবে রিপাবলিকান মতাদর্শ পছন্দ করতেন না তিনি। তাই নিজেকে সতন্ত্র আইনজীবী হিসেবে পরিচয় দিতেন। ১৯৬৯ সালে ডেমোক্র্যাট নেতার হয়ে আইনি লড়াই করতে গিয়ে নিজেকে ডেমোক্র্যাট হিসবে রেজিস্টার্ড করেন বাইডেন। ডেমোক্র্যাটদের সাথে পথ চলার সেই থেকেই শুরু। সেই বছরেই নিউক্যাসেল সিটি কাউন্সিলে কাউন্সিলম্যান নির্বাচিত হন বাইডেন। একজন কাউন্সিলম্যান হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি একজন আইনজীবী হসেবে সমানতালে কাজ করেছেন ১৯৭২ সাল পর্যন্ত।
১৯৭২ সালে তিনি ডেমোক্র্যাটের হয়ে লড়েন রিপালিকান অধ্যুষিত এলাকা থেকে জনপ্রিয় সিনেটর ক্যালেব বোগসের বিপক্ষে। ওই এলাকা থেকে বাইডেন ছাড়া কোন ডেমোক্র্যাট সদস্যই নির্বাচন করতে রাজি ছিল না। নির্বাচনী প্রচারণার জন্য বাইডেনের হাতে তেমন কোন অর্থ ছিল না। তার নির্বাচনী প্রচারনায় কাজ করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। এই নির্বাচনে তিনি জিতবেন এমন কোন আশা ছিল না। এমনকি নির্বাচন পূর্ববর্তী জরিপে তিনি বোগসের চেয়ে জনপ্রিয়তায় ৩০% পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ওই আসন থেকে ৫০.৫% ভোট নিয়ে জিতে যান জো বাইডেন।
ডেলওয়্যার থেকে কনিষ্ঠ সিনেটর হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই বাইডেনের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর, ক্রিসমাস ট্রি কিনতে গিয়ে সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারান বাইডেনের স্ত্রী নেইলিয়া হান্টার এবং এক বছর বয়সি কন্যা সন্তার নাওমি। সিরাকিউজ ইউনিভার্সিটির ছাত্রী নেইলিয়ার সাথে বাইডেনের পরিচয় কলেজে পড়ার সময়েই। বেশ বাধা বিপত্তি পেরিয়ে পরিণয় পরিনতি পায় ১৯৬৬ সালের ২৭ আগস্ট। এই দুর্ঘটনায় আহত হয় তার দুই ছেলে বো এবং হান্টার। আহত ছেলেদের সুস্থ করে বড় করে তোলার জন্য সিনেটর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তবে তার দলের সদস্যদের অনুরোধে হাসপাতালেই শপথ নেন তিনি। তখন ডেলওয়্যার থেকে ৯০ মিনিট ট্রেন যাত্রা করে ওয়াশিংটন আসতেন। রাজনৈতিক জীবনের পরবর্তী ৩৬ বছর এভাবেই তিনি সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দুর্ঘটনায় স্ত্রী কন্যাকে হারানোর পর তার জীবন দর্শন এবং ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে। প্রচণ্ড কষ্টে তখন তার মনে হত ‘ঈশ্বর তার সাথে খুব খারাপ খেলা খেলেছেন’। তার কাজকর্মে মনোযোগ দিতেও খুব সমস্যা হত তখন। এই অবস্থা থেকে তাকে উত্তরণের পিছনে জিল বাইডেনের অবদান অনেক। জিল ট্রেসি জ্যাকব (জিল বাইডেন) এর সাথে ১৯৭৫ সালে এক ব্লাইন্ড ডেটে দেখা হয় জো বাইডেনের। এরপর ১৯৭৭ সালে ১৭ জুন তাদের বিয়ে হয়।
বাইডেনের জীবনে দ্বিতীয়বার আঘাত আসে ২০১৫ সালে। ২০১৫ সালে ৩০ মে জো বাইবেন তার ছেলে বো বাইডেন কে হারান ব্রেন টিউমারজনিত জটিলতায়। মৃত্যুর আগে তিনি ডেলওয়্যারের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সন্তান হারানোর আঘাতের সাথে তখন অর্থ সংকটের চিন্তাও তাকে পেয়ে বসে। তাই ডেলওয়্যারের বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে তখন ওবামা তাকে বাড়ি বিক্রি করতে মানা করেন এবং সম্ভাব্য সব ধরণের সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন।

চার দশকের সফল সিনেটর বাইডেন মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কিছুদিন। কাজ করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে। সর্বদা শান্তির পক্ষে থাকা বাইডেন দারফুরে হামলা এবং জর্জ বুশের ইরাক আগ্রাসনের বিপক্ষে ছিলেন তিনি। এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সরাসরি অস্ত্র হামলায় না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অবদান রাখার পাশাপাশি বিরোধপূর্ণ বলকান অঞ্চলের সঙ্গে শান্তি আলোচনা এবং সোভিয়েতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য ন্যাটোর সদস্য বৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর পিছনেও তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। এছাড়াও ২০১০ সালের ‘পেশেন্ট প্রোটেকশন অ্যান্ড অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার’ আইনের বাস্তবায়ণেও তার ভূমিকার কথা বারবার আলোচিত হয়েছে।
বাইডেনের সিনেটর থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়টা বেশ লম্বা। সর্বপ্রথম তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য সিদ্ধান্ত নেন ১৯৮৭ সালে। ১৯৮৮ সালে লড়াইটা শুরু করতেই তার নামে অন্যের লেখা চুরি ও অসততার অভিযোগ আনা হলে তিনি প্রচারণা থেকে সরে দাঁড়ান। সে বছরই জানা যায় ওনার মস্তিষ্কের দুটো আর্টারি বড় হয়ে গেছে। অপারেশনের সময় ফুসফুসে জটিলতা দেখা দিলে আরও একটি অপারেশন করতে হয় তখন। সাত মাসে সব জটিলতা কাটিয়ে ডেলওয়্যারের সিনেটর হিসেবে ফিরে আসেন। ২০০৮ সালে আবার তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন এর দৌড়ে নামেন। কিন্তু ওবামার তারুণ্যে মুগ্ধ ডেমোক্র্যাট দল থেকে সেবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। তবে প্রজ্ঞা আর জ্ঞানের বিচার করতে ভুল করেননি ওবামা। প্রথমে ওবামার রানিং মেট এবং পরবর্তীতে ভাইস প্রেসিডেন্ট হন বাইডেন। এরপর ২০২০ সালে কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই শুরু হয় প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রাথমিক যাত্রা। তবে সব বাধা কাটিয়ে তিনি অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
বাইডেন কে নিয়ে সমালোচনাও কম নেই। ১৯৮৮ সালে অসসতার অভিযোগ, আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের বর্ণভিত্তিক বিভেদপন্থিদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আদালতের রায়ের বিরোধিতা করে সমালোচনার শিকার হওয়া ছাড়াও ২০২০ সালে নির্বাচনী প্রচারের সময় তার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেন টারা রিড নামের এক নারী। তার অভিযোগ অনুসারে ১৯৯৩ সালে বাইডেনের অফিস সহযোগী হিসেবে কাজ করার সময় তিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এরপর আরও কয়েকজন তার বিরুদ্ধে অসঙ্গত আচরণের অভিযোগ করেন।
সফল এই রাজনীতিবিদ সবসময় রাজনীতির আগে স্থান দিয়েছেন পরিরবারকে। তাই পরিবারের জন্য রাজনীতি থেকে পিছিয়ে যেতেও দ্বিধা করেননি। নিজের স্ত্রী, সন্তানদের হারিয়েও থেমে হয়তো যান নি কিন্তু তাদের কখনো ভুলতেও পারেননি। তাই সময় পেলেই এখনো ছুটে যায় তাদের সমাধির সামনে।