মাহবুবুর রহমান, ডেনমার্ক থেকে:
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল ইউএনএফপিএ- এর মতে করোনা প্যানডামিকের কারণে পৃথিবী এইভাবে ছয় মাস লকডাউনে থাকলে ৭০ লাখ অনাকাঙ্ক্ষিত নতুন জনসংখ্যা পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যার সাথে যোগ হবে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে দীর্ঘ লকডাউন স্বামী-স্ত্রী এবং গার্লফ্রেন্ড- বয়ফ্রেন্ডকে একে অপরের সাথে থাকার ও মিলনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
অন্যদিকে টমাস রবার্ট ম্যালথাসের তত্ত্ব মতে, প্রকৃতি এতো নিষ্ঠুর যে কাউকে নিশ্চিত ক্ষমতা দেয় না। খাদ্যশস্যের উৎপাদন যখন গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পায়, তখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যমিতিক হারে। তিনি মনে করেন জমিতে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদনবিধি কার্যকর হওয়ায় খাদ্য উৎপাদন দ্রুত বাড়ানো সম্ভব না। ফলে এমন এক সময় আসে যখন জনসংখ্যার পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণকে ছডিয়ে যায়। বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষ তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে বিভিন্ন প্রকার জৈব সার, কীটনাশক, এমন কি ফসলের বীজ হাইব্রিড করে একই জমিতে একবারের পরিবর্তে বহুবার ফসল উৎপাদন করছে। ফলে পৃথিবীর ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স নষ্ট হয়েছে। নষ্ট হয়েছে জমির উর্বরতা। কমে গিয়েছে খাদ্যের পুষ্টি। ৫০ বছর আগে একটি টমেটোতে যে পুষ্টি ছিল তা এখন ১০টি টমেটো পাওয়া যায়। এমনকি উৎপাদন বাড়াতে মানুষ ব্যবহার করছে জিএমও টেকনোলোজি । এদিকে বাইলোজিক্যাল হাইব্রিড এবং জ্বীন টান্সফার করে নামকরণ করা হয়েছে শেলী ও বেলীদের।
ম্যালথাসের মতে জনসংখ্যা নিয়ন্তণ না করা গেলে প্রাকৃতিক নিরোধ কার্যকরী হয়। যেমন: মহামারি, দুর্ভিক্ষ ইত্যদি। একসময় জনসংখ্যার বাড়তি অংশটি ধ্বংস হয়ে যায় প্রকৃতি প্রাকৃতিক নিয়মে এবং জনসংখ্যা ও খাদ্যের জোগানের মধ্যে ভারসাম্য স্হাপিত হয়।
এমন বাস্তবতায় এখন প্রশ্ন ওঠেছে, তাহলে করোনা মহামারি কি ম্যালথাস তত্ত্বের বাস্তব প্রতিফলন? নাকি করোনা মানুষের পরীক্ষা নিচ্ছে? আমার জানা মতে মানুষ দুইটি জিনিস ভয় পায়। একটি হলো- গরীব হয়ে যাওয়াটাকে, অন্যটি মরে যাওয়াকে। মানুষ তাই সব সময় নিশ্চয়তা খুঁজে বেঁচে থাকার এবং সাথে থাকে হারানোর ভয়। বিপরীত দিকে ধনিক শ্রেণী সব সময় তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। তাইতো তাঁরা মানুষের অধিকার দিতে ভয় পায়। কিন্তু করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে এখন এই ধনী গোষ্ঠিকে আরাও ভীত মনে হচ্ছে। কারণ তাঁরা বুঝতে পারছে পৃথিবীর মানুষের মধ্যে বিভেদের দেওয়াল সরিয়ে দিয়ে অস্তিত্বের সংগ্রামে বিজয়ী হবার জন্য সবাই এক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আর এই বাস্তবতাটাই ধনিক শ্রণী মোটেই গ্রহন করতে পারছে না। এই শ্রেণীর বোধশক্তি অন্যরকম। তাঁরা বুঝে না মানুষ যতবড় বিত্তশালী হোক না কেন তাতে সমাজের কোন লাভ হয় না।
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে পারমানবিক শক্তিধর দেশগুলি আজ নিশ্চুপ ও হতাশ। এখন তাঁরা নিজেদের রক্ষা করার জন্য সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে তাগিদ দিচ্ছে।সারা বিশ্ব আজ প্রথমবারের মতো এক সঙ্গে থমকে গিয়েছে, পাল্টে যাচ্ছে ধর্মবিশ্বাস এবং ভবিষ্যতের গতিপ্রকৃতি। মনে হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদ বিলুপ্ত হয়ে সত্যিকার উন্মুক্ত শাসনতন্ত্রের নতুন এক পৃথিবী সৃষ্টি হতে যাচ্ছে সামনের দিনে। আমরা কি ক্রমশ এই অবধারিত সত্যের দিকেই ধাবিত হচ্ছি যেখানে থাকবে না কোন মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ, সাদা-কালো বর্ণের বিভেদ, থাকবে না উন্নত-মধ্য আয়ের-অনুন্নত দেশগুলির মধ্যে অর্থভত্তিক পাসপোর্টের বর্ণের তফাৎ। নাকি করোনা সময় পেরিয়ে আমরা আবার মেতে উঠবো প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের খেলায়?
তবে করোনা একদিন চলে যাবে। প্রকৃতি ও মানুষ ফিরে পাবে তাদের বেঁচে থাকার নিজস্ব গতি। কিন্তু করোনা থেকে আমাদের যা কিছু ভাল শিক্ষা পারস্পরিক সহমর্মিতা, একে অপরের প্রতি ভালবাসা ও অন্তরিকতা যেন রয়ে যায় আমাদের মননে।