এডভোকেট জিয়াউর রহিম শাহিন, বিশ্বনাথ, সিলেট: বেশ ক’বছর পূর্বে কনকনে শীতের এক সকালে সিলেটের বরেণ্য লেখক কবি সাহিত্যিকদের এক মিলনমেলায় আমাদের প্রথম সাক্ষাত। প্রথম দেখাতেই এক্কেবারে আপন হয়ে গেলাম দু’জন দু’জনার। সাথে ছিলেন আরও কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তি। সেখানেই শুরু হয়ে গেলো আমাদের অন্যরকম আড্ডার। নয়নাভিরাম পরিবেশে সাহিত্য আড্ডাটি পরিণত হয়েছিল পারস্পরিক সেতুবন্ধনের আড্ডায়। সেই যে ঘনিষ্ট হলাম এ ঘনিষ্টতা দিন দিন যেন নীবিড় থেকে আরও নীবিড়তর হতে লাগলো। হাসিমুখে দাওয়াত দিলেন, তাঁরই প্রতিষ্ঠিত সংগঠন সিলেট লেখক ফোরাম’র সাথে যুক্ত হয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে যেন আরও বেশি অবদান রাখি।
শুরু হলো আমাদের একসাথে পথচলা। একসাথে পথ চলতে গিয়ে সিলেট লেখক ফোরামের আয়োজনে আমরা বিভিন্ন সময়ে সিলেটের বরেণ্য গুণীজনদের বাড়ীতে গিয়ে তাদের সম্মানে সাহিত্য আড্ডার আয়োজন ও এসব বরেণ্যজনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মরনোত্তর পুরস্কারে ভূষিত করার দাবী জানিয়ে আসছি জোরালোভাবে। ন্যায্য এসব দাবী বাস্তবায়নে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে আন্দোলনও চলছে। শুধু তাই নয় যুক্তরাজ্য, সৌদি, দুবাই, কাতারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লেখক ফোরামের উদ্যোগে সাহিত্য আড্ডার আয়োজন করে আমরা বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জয়গান গেয়ে বহির্বিশ্বেও আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছি।
২০১৬ তে ফোরামের ১২ বছর পূর্তিতে সিলেট বিভাগের চার জেলাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আয়োজন করা হয় ১২ দিনের অনুষ্ঠানমালার। স্ব-স্ব ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য দেয়া হয় ১২ জন গুণী ব্যক্তিত্বকে গুণীজন সম্মাননা। সিলেটে আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে সমাপণী উৎসবসহ সুন্দর ও সফলভাবে সম্পন্ন হয় ১২ দিনের অনুষ্ঠানমালা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন নাগরী গবেষক ও ভাষাবিদ যুক্তরাজ্যের জেমস লয়েড উইলিয়ামস। প্রধান আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন প্রথম নাগরী কমপিউটার ফন্ট ‘সুরমা’ এবং ‘নিউ সুরমা’র উদ্ভাবক যুক্তরাজ্যের ড. স্যু লয়েড উইলিয়ামস।
সিলেট লেখক ফোরামের কার্যক্রম দেশে বিদেশে গতিশীল রাখতে মূল চালিকাশক্তিই হচ্ছেন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কবি নাজমুল ইসলাম মকবুল। হাজারো সঙ্গীতের এ জনকের ১। আমরা ঘরর তাইন, ২। মতলবর চাচা, ৩। লন্ডনী ভাইছাব, ৪। প্রেমেরই কাঙ্গাল, ৫। মুখোশ, ৬। প্রতিচ্ছবি, ৭। মজলুমের আর্তনাদ, ৮। চাবুক, ৯। তেলের তেলেসমাতি নামক নয় নয়টি একক অ্যালবামের পর এবার ভাষার মাসে আসছে সঙ্গীতের দশম অ্যালবাম ‘বাংলাদেশের মাটি’।
এমনি সময়ে তাঁর বিখ্যাত পাঁচমিশালী গানের বই ‘‘আমরা ঘরর তাইন’’ এবং দ্বিতীয় সঙ্গীতগ্রন্থ বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে অমূল্য সংযোজন “তেতুল’’ এর ভূমিকার চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরার প্রয়োজন অনুভব করছি। ‘‘বিশ্বের তাবৎ মানুষের মধ্যে সত্যিকারের প্রেম প্রীতি ভালোবাসার স্বপ্নে বিভোর সদালাপি মিশুক ও আড্ডাপ্রিয় শেকড় সন্ধানী লেখক ছড়াকার গীতিকার পূঁথিকার সাংবাদিক এবং কলামিষ্ট কবি নাজমুল ইসলাম মকবুল।
তার জন্ম ১৯৭৭ এর ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার অলংকারী গ্রামে। বাড়ীর পার্শ্বের পাঠশালা থেকেই প্রথম স্থান অর্জন করে নজর কাড়েন সকলের। এরপর ১৯৯২-এ বিশ্বনাথ আলিয়া মাদরাসা থেকে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধিনে দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বিশ্বনাথ পরীক্ষা কেন্দ্রে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে অক্ষুন্ন রাখেন প্রতিভার স্বাক্ষর। অতঃপর উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীণ দ্বীনি পিদ্যাপীঠ ঐতিহ্যবাহী সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে সেখান থেকে ১৯৯৪-এ আলিম, ৯৬-এ ফাযিল ও ৯৮-এ বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি কামিল (মাস্টার্স সমমান) উত্তীর্ণ হন কৃতিত্বের সাথে।
১৯৮৮’র ১৫ জুলাই ‘রামাদ্বান’ শিরোনামের কাব্য রচনার মধ্যদিয়ে শুরু হয় সাহিত্য জগতে পথচলা। এরপর থেকে আর থেমে থাকেনি কলম। জাতীয় স্থানীয় দেশি বিদেশি জনপ্রিয় গণমাধ্যমে সাড়া জাগানো কলাম, গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া শেকড় সন্ধানী ইতিহাস ঐতিহ্য ও তথ্যভিত্তিক লেখা এবং সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় ভিন্নধারার কলাম লেখে অর্জন করেন ঈর্ষনীয় খ্যাতি। সে সাথে কবিতা, ছড়া, গান, প্রবন্ধ, গল্প, আঞ্চলিক গান, পুঁথি ও মজার মজার প্যারোডিতো আছেই। কবি নাজমুল ইসলাম মকবুল’র নয়টি গানের অ্যালবাম এবং দুটি সঙ্গীতগ্রন্থ বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, জাপানসহ দেশ বিদেশের অগণিত পাঠক ও শ্রুতাদের আকর্ষণ করে চুম্বকের মতো। রেকর্ড সংখ্যক মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন শহরে।
২০১৮’র একুশে বইমেলায় সঙ্গীত পিপাসুদের জন্য কবির হাজারো সঙ্গীতের মধ্য হতে বাছাই করা ভিন্ন আমেজের জনপ্রিয় ১০১টি জবরদস্ত টক, আধা টক এবং টকের সাথে মিস্টির সমাহার মজাদার গান নিয়ে ২য় সঙ্গীত গ্রন্থ ‘তেতুল’ প্রকাশিত হয়। সমজদাররা আখ্যায়িত করেছেন এ সঙ্গীতগ্রন্থটি কবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে। তাঁর এ গ্রন্থটির ভূমিকায় বিশ্বনাথ সরকারী ডিগ্রি কলেজের সদ্য সাবেক প্রিন্সিপাল মোঃ সিরাজুল হক লিখেছেন, ৭১এর বীর মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত সন্তান কবি নাজমুল ইসলাম মকবুল নিজ মেধা যোগ্যতা ও কর্মতৎপরতার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অর্জন করেছেন ঈর্ষনীয় সাফল্য। লেখক কবি সাংবাদিক কলামিষ্ট গীতিকার সুরকার পূঁথিকার ছাড়াও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সিলেটের এ আলোকিত সন্তান একজন সফল সুদক্ষ সংগঠক ও নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবী।
সিলেট বিভাগের মেধাবী তরুন কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সিলেট লেখক ফোরাম’, বীর মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত সন্তানদের নিয়ে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মুক্তিযোদ্ধার প্রজন্ম’ এবং ২০১৭ সালে বিজয়ের মাসে আর্ত মানবতার সেবার ব্রত নিয়ে গঠন করেন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা এম আলী ফাউন্ডেশন’। এছাড়া বিশ্বনাথের ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগের দাবী বাস্তবায়নের জন্য ২০০৯ সালে বিশ্বনাথের আলোকিত সন্তানদের নিয়ে গঠন করেন ‘বিশ্বনাথ উপজেলা গ্যাস বাস্তবায়ন পরিষদ’। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনগুলির মাধ্যমে পালন করে যাচ্ছেন সাহিত্য সংস্কৃতি ও সমাজ উন্নয়নমূলক সৃজনশীল নানা কর্মসূচি। যা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে দেশ বিদেশের গুণীজনদের মধ্যে। আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবের সফল আয়োজন, লেখক কবি সাহিত্যিক ও গুণীজন সম্মাননা, প্রয়াত গুণীদের সম্মানে তাদের স্মৃতিময় ঐতিহাসিক স্থানসমূহে বিশেষ করে শীতালংশাহ, দুরবীনশাহ, হাছন রাজা, আবদুুল করিম, রাধারমণ, নূরুল হক’র বাড়ীতে গিয়ে সফল অনুষ্ঠান আয়োজন। জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা, আলোকিত মা-বাবা সম্মাননা, মেধাবীদের সম্মাননা, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে অবদান, পরিবেশ সুরক্ষায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃক্ষরোপনের আয়োজন, ফলজ ঔষধী ও পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ রোপনের জন্য সামাজিক আন্দোলন, অসহায়দের জন্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও ফ্রি ঔষধপত্র প্রদান। চিকিৎসা সহায়তা, বিবাহ সহায়তা, প্রতিবন্ধিদের মধ্যে হুইল চেয়ার বিতরণ, আবহমান গ্রাম বাংলার বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যকে লালন করতে পিঠা ও ঘুড়ি উৎসবসহ নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন। ক্রীড়াক্ষেত্রে সহযোগিতা ও বিভিন্ন ধরনের ক্রীড়ানুষ্ঠানের আয়োজন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা উপকরণ, ক্রীড়া সামগ্রী, টিফিন বক্স এবং নির্যাতিত নীপিড়িত অসহায়দের মধ্যে শীতবস্ত্রসহ সাহায্য বিতরণ এবং তাদের পাশে দাঁড়ানো, বিশ্বনাথের ঘরে ঘরে গ্যস সরবরাহ, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণ, বাসিয়া নদী রক্ষা ও খননসহ বিশ্বনাথবাসীর সকল ন্যায্য দাবী দাওয়া আদায়ে আন্দোলনসহ বহুমুখী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
কবি নাজমুল টানা ছয় বছর ছিলেন লন্ডনের প্রথম বাংলা টিভি চ্যানেল বাংলা টিভির প্রতিনিধি এরপর প্রায় দুই বছর ছিলেন চ্যানেল আই ইউরোপ এর স্থানীয় প্রতিনিধি। বিগত দুই দশকেরও বেশি সময় যাবত দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। বর্তমানে লন্ডন টাইমস নিউজের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ও সাপ্তাহিক আমাদের সিলেটের এডিটরিয়াল বিভাগের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কাজ করছেন কয়েকটি পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে। বাংলাদেশ বিচিত্রার সিলেট ব্যুারো চীপের দায়িত্বও পালন করে যাচ্ছেন ম্যাগাজিনটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে। এছাড়া নিজ সম্পাদনায় বের করছেন লিটারেল জার্নাল টেমস বাসিয়া। পরিবেশসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিভিন্ন সময়ে তাঁর রিপোর্ট ও কলাম দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় তাঁর রম্য লেখা এবং পূঁথি খুবই সমাদৃত হয়েছে দেশে বিদেশে। তাঁর লেখা পূঁথি নিজ কন্ঠে লন্ডনের জনপ্রিয় বাংলা টিভি চ্যানেল এস এ ২০১৬ সালে ঈদ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে প্রচারিত হলে ব্যাপক সাড়া পান প্রবাসীদের পক্ষ থেকে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং পরিবেশ নিয়েও তার অনেক লেখা নজর কেড়েছে সকলের। এছাড়া ওয়ান পাউন্ড হসপিটাল ইউকের স্থানীয় কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্বও পালন করে যাচ্ছেন তিনি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে কবির নেক হায়াত ও লেখনিশক্তি আরও বৃদ্ধির প্রার্থনা জানাই। কবির সৃজনশীল সকল কার্যক্রম যেন অব্যাহত থাকে এ কামনা নিরন্তর।
লেখক: সাধারন সম্পাদক সিলেট লেখক ফোরাম