অধ্যাপক ড. ধনঞ্জয় সাহা একজন সফল বিজ্ঞানীর পাশাপাশি স্বার্থক ছড়াকার, কবি ও গল্পকার। তীব্র ইচ্ছা তাকে কখনোই অপ্রাপ্তির হতাশা দেয়নি বরং জন্ম দিয়েছে জয়ের আশা। তিনি ইতিবাচক দৃষ্টিতেই তাকিয়েছেন জীবন ও পৃথিবীর দিকে। বলছিলাম যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছড়াকার ও অধ্যাপক ড. ধনঞ্জয় সাহার কথা। সম্প্রতি তিনি একদিন আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে প্রবাস মেলা অফিস ভিজিট করেছেন। প্রবাস মেলার কলাকুশলীদের সঙ্গে আড্ডা–আলোচনায় উঠে আসে প্রবাসে তার বিজ্ঞানী হয়ে ওঠা এবং সাহিত্য চর্চার গল্প। সে সবের চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
চাঁদপুরের মতলবে মেঘনার সাদা বালুচরের পাশে বেড়ে ওঠেন ড. ধনঞ্জয় সাহা। তার বাবা গোপী বল্লভ সাহা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বৃটিশ-ইন্ডিয়া আর্মির একজন সক্রিয় সৈনিক ছিলেন। মাতা বীনা পানী সাহা। মোহনপুরে মেঘনা নদীর পাড়ে সকাল-সন্ধ্যায় হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে এঁকেছেন জীবনের স্বপ্ন- মানুষ সেবার কথা, ছড়ার কথা, দেশের কথা। শুরুতে মতলবের মোহনপুরে প্রাথমিক এবং হাইস্কুলের শিক্ষাজীবন কেটেছে তার। এরপর ভোলা থেকে ১৯৭৪ সালে এইচএসসি পাশ করেন ধনঞ্জয়। পরে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেটেরিনারি মেডিসিনে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন। সেখানে মাস্টার্সে পড়া অবস্থায় ধনঞ্জয় সাহা ১৯৮০ এর দশকের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।

প্রবাস জীবন
প্রবাস জীবনের শুরুতেই ধনঞ্জয় সাহা যুক্তরাষ্ট্রে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। পারিবারিকভাবে তিনি অনেক বিত্তশালী হলেও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বিদেশে পরিশ্রম করে পড়ালেখার খরচ জোগাবেন। সেখানে পড়ালেখার জন্য বাবার কাছ থেকে কোনো টাকা নেবেন না। ফলে তিনি প্রবাস জীবনের শুরুতে লেখাপড়ার সময় দৈনিক ১৮ ঘণ্টা থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করেছেন একজন গবেষক-বিজ্ঞানী হিসাবে, আর তখনই ঘটে এক অভাবনীয় ঘটনা। আবিষ্কার করেন Rose Bengal Staining Method যেটা সারা বিশ্বে Saha Method নামে পরিচিত। তার বয়স ছিলো মাত্র ২৬ বছর।

শুরুতে ধনঞ্জয় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় অ্যানিমেল সাইন্স অ্যান্ড নিউট্রিশনে ভর্তি হন। কাজ এবং লেখাপড়া করেন একই সাথে। সেখান থেকে ১৯৮৭ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সারে থেকে ১৯৯৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রিও অর্জন করেন তিনি।
বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার গল্প
অধ্যাপক ড. ধনঞ্জয় সাহা একজন পেশাগত বিজ্ঞানী। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ককে আলবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিন-এ রিসার্চ প্রফেসর হিসেবে কাজ করছেন। তিনি গ্রান্ট সাপোর্ট অফিসের ডাইরেক্টরও। তার উল্লেখ্যযোগ্য রিসার্চপেপার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। রিসার্চের কাজ করেছেন আফ্রিকাতেও।

তিনি সেপসিস অ্যান্ড সেপটিক শক (Sepsis and septic shock) এর একটি ওষুধের যৌথ আবিষ্কারক। ড. ধনঞ্জয় বলেন, এই রোগে প্রায় ৫০ শতাংশ রোগী মারা যায়। এ ওষুধ এখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে। তার সহকর্মী ড. ফিলিপ ডমিনিক এই ওষুধের সহ আবিষ্কারক। এছাড়া ড. ধনঞ্জয় সাহার সবচেয়ে সাড়া জাগানো অবদান হলো অ্যানিমেল বা পেট থেরাপি। এর থিওরি হলো মানুষ যখন বিষন্নতায় ভোগে তখন পশু-পাখি মানুষের বিষন্নতা রোধ করতে পারে। তাই মানুষের বিষন্নতা দূর করার জন্য পেট থেরাপি বেশ কার্যকর বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন মানুষের যদি পশু-পাখির কম্পেনিয়ন থাকে তাহলে তারা মানসিকভাবে অনেক সুস্থ বোধ করে। এ বিষয়ে ১৯৯৫ সালের দিকে তারা একটি স্টাডি করেছেন। এবং এর উপর ভিত্তি করে নিউইয়র্ক রাজ্যের আইন পরিবর্তন করা হয় যে হাসপাতালে রোগীর ভালোর জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর আনা যাবে। তিনি তার সমাজ সেবা এবং গবেষণার জন্য দু-দু বার পেয়েছেন আমেরিকান কংগ্রেসনাল এওয়ার্ড, ২০১৪ এবং ২০২১ সালে।
সাহিত্য চর্চা
খেলাধুলায় পারদর্শী, বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় বিতার্কিক এবং সাহিত্য কর্মে অনুরাগী ড. ধনঞ্জয় সাহা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াকালীন থেকেই ছড়া লেখা শুরু করেন। তারপর স্কুল-কলেজের দেয়াল পত্রিকায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন। দেশ ছাড়ার পর লেখালেখি থেকে দূরে সরে গেলেও, আশির দশকের শেষ দিকে লেখালেখিতে ফিরে আসেন। ছোটবেলায়ও বিতর্কে ভালো ছিলেন ধনঞ্জয়। বিতর্কে তার পারফরমেন্স দেখে সবাই বলতেন বড় হয়ে ধনঞ্জয় একজন ভালো ব্যরিস্টার হবেন। যদিও তিনি সেই পেশায় হাঁটেননি। শুরুর দিকে ধনঞ্জয় সাহা কবিতা এবং রম্যরচনা লিখতেন। তবে এখন কবিতা, গল্প ও ছড়া লেখেন। এখন পর্যন্ত তার ছয়টি শিশুতোষ বই প্রকাশিত হয়েছে।

সম্প্রতি ঢাকাস্থ বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান হলে ড. ধনঞ্জয় সাহার দুটি ছড়াগ্রন্থ সোনামণিদের ছড়া- ‘ভূত প্রেত আর জ্বিনি’ এবং ‘মাছ’ এর প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়েছে। অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছেন, মি. ধনঞ্জয়ের লেখা ছড়াগুলো খুব সুন্দর। তার ছড়াগুলো বিষয়ভিত্তিক। এর আগে কয়েকজন এমন লিখেছেন কিন্তু ড. সাহা লিখেছেন সিরিজ আকারে। এটা শিশুতোষ সাহিত্যে একটা নতুন সংযোজন। এছাড়া আরও চারটি ছড়ার বই শিগগিরই প্রকাশিত হবে বলে ধনঞ্জয় সাহা জানিয়েছেন। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা ছাড়াও তাঁর কবিতা বেশ কয়েকটি সংকলনে স্থান পেয়েছে। বর্তমানে ছড়াকার হিসেবে তিনি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করেছেন।
সমাজসেবা কর্মকাণ্ড
ড. ধনঞ্জয় সাহা দেশ-বিদেশে শতাধিক বিজ্ঞান বিষয়ক সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে বক্তৃতা করেছেন। তিনি নিউইয়র্কস্থ রূপসী চাঁদপুর সংগঠন এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ধনঞ্জয় সাহা বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল লিটারারি সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা। এ সংগঠনের উদ্দেশ্য হলো বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া। আমেরিকার কৃতদাস মুক্তির ঐতিহাসিক উদযাপন প্রোগ্রাম ‘জুনটিন্থ’-কে তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি চালু করেছেন। এছাড়াও ড. ধনঞ্জয় সাহা নিউইয়র্ক ভিত্তিক বিবেকানন্দ স্টাডি অ্যান্ড ফিলেন্থ্রোপিক সেন্টারের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এই সংগঠনটি শুধু করোনাকালে বাংলাদেশ এবং ভারতে কোয়ার্টার মিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা পাঠিয়েছে। এই সংগঠনটি থেকে স্কলারশিপ দেয়া হয়। এই পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজারের অধিক শিক্ষার্থীকে স্কলারশিপ দেয়া হয়েছে বলে ধনঞ্জয় সাহা জানান। এই সংগঠনটির আর্থিক সহায়তায় অন্তত ৪০ জন ডাক্তার এবং ৮ জন ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন বলেও জানান তিনি।
পরিবার
অধ্যাপক ড. ধনঞ্জয় সাহা বর্তমানে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক এবং নর্থ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যে বসবাস করছেন। স্ত্রীর নাম ডা. অনিমিতা চৌধুরী সাহা। তিনি মেডিসিনের একজন এসোসিয়েট প্রফেসর এবং একটি ক্লিনিকের পরিচালক যেখানে তিনি অসহায়-সম্বলহীন রোগীদের চিকিৎসা করেন। যার জন্য রোগিদের নামমাত্র খরচ দিতে হয়। তাদের ছেলে আনন (অটিস্টিক)। মেয়ে অভন্তি জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন করছেন। তার ইচ্ছা বাচ্চাদের মানসিক উন্নতির জন্য কাজ করার।

আলাপচারিতায় লেখা তৈরি ও সম্পাদনা করেছেন– শহীদ রাজু।