সিকদার গিয়াসউদ্দিন: কক্সবাজার সরকারি হাসপাতালে বিজয়ের মাসের প্রাক্কালে কক্সবাজার জেলার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও ক্ষণজন্মা কৃতি সন্তান অধ্যক্ষ মোশতাক আহমদ। অসংখ্য স্বজন, শুভানুধ্যায়ী, গুনগ্রাহী, স্থানীয় সাধারণ জনগণ ও ছাত্র-ছাত্রীদের শোকসাগরে ভাসিয়ে অবশেষে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)।
কক্সবাজারের রামু সরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছাড়াও অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক উন্নয়ন ও পৃষ্টপোষকতা বা উপদেষ্টা হিসাবে, আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। শত সূযোগ ও প্রলোভনকে উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে কক্সবাজারের বাইরে পা মাড়াননি। তিনি বিভিন্ন নামে বিভিন্ন অভিধায় খ্যাত ছিলেন। অন্যতম একজন ভাষা সৈনিক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, বরেণ্য বুদ্ধিজীবি, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ৭১’য়ে অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলা’র আসামী, বুদ্ধিবৃত্তির উন্নয়ন সহায়ক বহু গ্রন্থের প্রণেতা ইত্যাদি।

মোশতাক আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের অন্যতম ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করতেন। ছাত্র ইউনিয়নের গবেষণা সেলে কাজ করার জনশ্রুতি আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে তখন ছাত্র ইউনিয়নের রমরমা অবস্থা ছিলো। নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনুছ এবং মোশতাক আহমদ একসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সেই সময়কার নামকরা ছাত্র-ছাত্রীগণ পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে প্রতিষ্ঠিত ডাকসাইটে লোকজন প্রায় সময় খোঁজ-খবর ও নিয়মিত যোগাযোগ রাখার কথা স্থানীয়দের মুখে মুখে বলতে দেখা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। পরে সিভিল সার্ভিসের লোভনীয় চাকরি ত্যাগ করে মোজাফফর ন্যাপে যোগ দেন। কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভূ্ত্থানের পর পর কক্সবাজারে নিজের জন্মভূমিতে পা রাখেন। আর ঢাকামূখী হননি। মোজাফফর ন্যাপের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলেও পরবর্তী সময়ে ভাসানী ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ ও মতিয়া গ্রুপের বাঘা বাঘা লোকজনদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। এমনকি আওয়ামীলীগ ও জাসদের লোকজনদেরও শ্রদ্ধা ও সমীহ লক্ষণীয়।
জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন দলের নেতা, বড় আমলা, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষাবিদ কক্সবাজারে এলেই উনার উপস্থিতি কামনা করতেন। খোঁজ-খবর নিতেন। অনেকেই উনার সাথে সাক্ষাত না করে যেতেন না। বিদেশি সংস্থা বা এনজিও সহ কক্সবাজারে আয়োজিত যেকোন সেমিনারে উনার উপস্থিতি ছিলো স্মরণ করার মতো। সেমিনারে উনার উপস্থিতি পুরো পরিবেশকেই পাল্টে দিতো। দূর্জনদেরও উনার সুনামে উচ্চসিত হতে দেখা গেছে। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে অগণতান্ত্রিক সরকারে টেকনোক্র্যাট হিসাবে অংশগ্রহণের প্রস্তাবে অস্বীকৃতির বা প্রত্যাখ্যান সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক জনশ্রুতি আছে।

কক্সবাজারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। আজীবন গণতন্ত্রের সামগ্রিক উন্নয়নে গণসচেতনতা তৈরীতে কাজ করেছেন। পারিবারিক বনেদীপনার বাইরে মূলত: অধ্যক্ষ মোশতাক আহমদ এককভাবে নিজেই নিজেকে অভাবনীয় উচ্চতায় বিকশিত করেছেন। একজন উচ্চমার্গীয় মানুষ হিসাবে স্থানীয় ও জাতীয় জীবনের মনোজগতে স্থান করে নিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ছিলেন।
মূলত: কক্সবাজার জেলা এখনো সামন্ততান্ত্রিক। বনেদী নামে খ্যাত বেশ কয়েকটি পরিবার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বলে জনশ্রুতি দীর্ঘদিনের। এমনকি সিকদার পরিবারের সন্তান হয়েও বেশ কয়েকজন চৌধুরী নামধারণ করেও রাজনীতিতে পারিবারিক বিকাশের ও বনেদীপনার উদাহরণও দেখা যায়।
গণতান্ত্রিক আচরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিভাগের নামকরা রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পদে তিনি হারবেন জেনেও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ হিসাবে ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী’র সাথে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন। নির্বাচনে তিনি পরাজিত হলেও এ ধরণের নির্বাচন অতীতে দেখা যায়নি বলে গোটা কক্সবাজারে তা ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলো। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মোজাফফর ন্যাপের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। পরাজিত হবেন জেনেও নির্বাচনে অংশগ্রহণের কারণ ছিলো কক্সবাজারের কয়েকটি বনেদী পরিবার খ্যাত লোকজনদের বাইরে সাধারণ পরিবারের সন্তানদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে নেতৃত্বের বিকাশ সাধন করা। সাধারণ পরিবারের উচ্চশিক্ষিত সন্তানদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণসচেতনতা তৈরী করা। তিনি কক্সবাজারে পারিবারিক রাজনীতির অবসান ও সামন্ততান্ত্রিক ধ্যানধারণা বর্জনের পথিকৃত। কক্সবাজারের ইতিহাসে সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে যারা বিকশিত করেছেন- তাদের মধ্যে টেকনাফের উকিল নূর আহমদ ও রামুর অধ্যক্ষ মোশতাক আহমদ অন্যতম। উকিল নূর আহমদ ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের পক্ষে পাকিস্তানের জাতীয় নেতা ও বিখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান মৌলভী ফরিদ আহমদকে হারিয়ে দিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। অবশ্য স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরে উকিল নূর আহমদ কক্সবাজারে জাসদের নেতৃত্ব দান করেন। জনাব মোশতাক আহমদ সাহের ইষ্ট পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে পরাজয় বরণ করলেও সামন্তবাদী বনেদী পরিবার খ্যাতদের বাইরে গণতান্ত্রিক আচরণের বিকাশে নির্বাচনে সাধারণদের অংশগ্রহণ ও গণসচেতনতা তৈরীতে উকিল নূর আহমদ এবং অধ্যাপক (পরে অধ্যক্ষ) মোশতাক আহমদ এক্ষেত্রে কক্সবাজারের ঘূনে ধরা সমাজের পথ প্রদর্শক।

কক্সবাজারের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হিসাবে জাতীয় পর্যায়ে অধ্যক্ষ মোশতাক আহমদ, ড. শাজাহান মনির ও নতুন প্রজন্মের ড. শিরীণ আকতার ও ড. সলিমুল্লাহ খান উল্লেখযোগ্য। প্রথম দুজন নিভৃতচারী হলেও টক’শোয়ের কল্যাণে সলিমুল্লাহ খান ও উপাচার্য হিসাবে শিরীণ আকতার জাতীয়ভাবে সমধিক পরিচিত। সুপ্রিম কোর্টের মানব কল্যাণকামী আইনজীবি হিসাবে নতুন প্রজন্মের জ্যোতির্ময় বড়ুয়া’র নামও ইতিমধ্যেই জাতীয় পরিচিতি পেয়েছে। কবি নূরুল হুদা জাতিসত্ত্বার কবি হিসাবে দরিয়ানগরের সন্তান হিসাবে দেশব্যাপী সমধিক পরিচিত। আমলাদের মধ্যে জাতীয় পরিচিতিপ্রাপ্ত বর্তমানে বিশ্বব্যাংকে কর্মরত সাবেক সিনিয়র ও সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব শফিউল আলম এবং সিনিয়র সচিব হেলালউদ্দিন আহমেদ অন্যতম।
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরপর কক্সবাজারে সংগ্রাম কমিটি তৈরীতে আবছার কামাল চৌধুরী, ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, মোশতাক আহমদ, মোজাম্মেল হক সহ অনেকে এবং ছাত্রনেতাদের মধ্যে কক্সবাজার ছাত্রলীগের সভাপতি উখিয়ার দিদারুল আলম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক কক্সবাজারের ছুরত আলম, কক্সবাজার কলেজের ভিপি তৈয়বউল্লাহ সিকদার সহ অনেকের অবদান অনস্বীকার্য্য। তাছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে রামু থানার ঐতিহাসিক অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলার অন্যতম আসামীদের একজন ছিলেন। কক্সবাজারের স্বাধীনতা আন্দোলন ও তা মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরের অন্যতম সংগঠক হিসাবে অধ্যক্ষ মোশতাক আহমদ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে একই সঙ্গে মেধা ও বহুমূখী গুণাগুণ সম্পন্ন আদর্শ ক্ষণজন্মা মানুষ আজকাল অপ্রতুল বললেই চলে। কক্সবাজারের ইতিহাসে আগামী প্রজন্মের সন্তানদের কাছে তিনি অবশ্যই একজন কিংবদন্তী হিসাবে বিবেচিত হবেন। এতদসংগে ১৯৭১ সালের রামু থানার অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলাকে নিয়ে লেখা ‘এ পিস অব হিষ্টোরী’ নামের ফেসবুক লিংক থেকে মামলার নথি ও ইতিহাস পড়ে দেখতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
অধ্যক্ষ মোশতাক আহমদের মৃত্যু দেশ ও জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। কক্সবাজার ও বাংলাদেশ একজন প্রকৃত গুণীজনকে হারালো। এই গুণীজনের মৃত্যুতে গভীর শোক, শ্রদ্ধা ও সমবেদনা জ্ঞাপন আর পবিত্র রুহের মাগফেরাত কামনা করি। মহান আল্লাহপাক উনাকে বেহেস্ত নসীব করুন।
কিংবদন্তীতুল্য এ ধরণের ক্ষণজন্মা মানুষ সাধারণের হৃদয়ে স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকবেন। আগামীর সন্তানদের হাত দিয়ে সমুদ্রমন্থন করে এদের ইতিহাস রচিত হবে।
লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কমিটি ফর ডেমোক্রেসী ইন বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র; সাবেক সদস্য সচিব, যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধ চেতনা পরিষদ; সাবেক প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক, কর্ণেল তাহের স্মৃতি সংসদ; বর্তমানে কানেক্ট বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের অন্যতম নির্বাহী; পৃষ্ঠপোষক, বিশ্ব সঙ্গীত কেন্দ্র; লাগভেগাস, নেভাদা, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।