সাংবাদিক শাহীন খলিল কাওসার। ইতালির রোমে প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। দেশে থাকতে সাংবাদিকতা করেছেন, বিদেশেও এই পেশার মায়া ছাড়তে পারেননি। সাংসারিক কাজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কাজের পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশাকে আকড়ে ধরে রেখেছেন। বর্তমানে গাজী টিভির ইতালি প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। দেশের টানে বছরে কয়েকবারই আসেন মাতৃভূমিতে। সম্প্রতি এক বিকেলে এসেছিলেন প্রবাস মেলা কার্যালয়ে। তার সাথে আলাপচারিতায় বিস্তারিত জানাচ্ছেন মো: মোস্তফা কামাল মিন্টু।
গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার কৃতি সন্তান শাহীন খলিল কাওসার ছিলেন ডানপিটে স্বভাবের। প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিতেন। ফলে বিশেষ নজরদাড়িতে রাখার জন্য তার বাবার করা নির্দেশ ছিল হ্যাড স্যারের কাছে। এভাবেই স্কুলের গন্ডিতে পড়ালেখা শুরু তার। পরে তার পিতার চাকরির স্থানান্তরের সুবাধে ঢাকায় চলে আসেন। এখানে সেগুন বাগিচা হাইস্কুল থেকে এসএসসি, টিএনটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এইসএসসি ও সম্মান ডিগ্রি নেন।
রোম প্রবাসী শাহীন খলিল কাওসার জানান, ছোটবেলাতেই আমার ছবি তোলার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল। বলা যায় একধরণের কৌতূহল থেকেই আমি ছবি তুলতাম। একটা সময় এটাকেই আমি পেশা এবং নেশা হিসেবে নেওয়ার চিন্তা করলাম। তাই পড়ালেখা অবস্থাতেই ঢাকা ও কোলকাতা থেকে ফটোজার্নালিস্ট এর উপর ২ টি কোর্স সম্পন্ন করে ফেললাম।
শাহীন খলিল কাওসার পেশা হিসেবে ১৯৯১-৯২ সালের দিকে ‘দৈনিক জনতা’ পত্রিকায় সিনিয়র স্টাফ ফটোগ্রাফার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি বলেন, ছোট থাকতেই আমি ছবি তুলতে বেশ পছন্দ করতাম, একটা সময় চিন্তা করলাম এটাকেও তো আমি পেশা হিসেবে নিতে পারি, যে চিন্তা সেই কাজ। পড়ালেখা শেষ করে ফটোজার্নালিস্ট হিসেবে ক্যারিয়ারে আমার পথচলা শুরু হল।
তিনি জানান, ১৯৯৬ সালে ইতালিতে বিশ্বকাপ হকির বাছাই পর্বে বাংলাদেশের ম্যাচ উপলক্ষে ‘দৈনিক জনতার’ হয়ে আমার এ্যাসাইনমেন্ট পরে। সেখানে খেলার কভার শেষ করার পর আগে থেকেই রোমে থাকা আমার বন্ধুদের পরামর্শে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ইতালিতে থাকা শুরুর দিনগুলো কেমন ছিলো এক প্রশ্নের জবাবে শাহীন খলিল কাওসার জানান, প্রথম দিকে আমাকে অনেকের মত কিছুটা স্ট্রাগল করতে হয়েছে। তখন বিভিন্ন ধরনের পার্টটাইম জব করেছি। ৯৭ সালে রোমের জনপ্রিয় মাসিক বাংলা পত্রিকা ‘রোমের সময়’ এর ফটোসাংবাদিক হিসেবে জয়েন করি। পত্রিকাটি এখনও রোমে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির নানাবিধ খবর নিয়ে বের হচ্ছে। সময়ের পরিক্রমায় ২০০৪ সালে নিজের উদ্যোগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করি। তিনি বলেন, প্রথমে রোমে ইউরো বাংলা মিনি মার্কেট নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করি, এর কয়েকবছর পর এক্কো মিনি মার্কেট নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান চালু করি।
ফটোসাংবাদিক শাহীন খলিল কাওসার ২০০১ সালে ইতালির পারমেনেন্ট কাগজপত্র পাওয়ার পর পরিবারকেও সেখানে নিয়ে যান। তিনি বলেন, আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আমি এবং আমার স্ত্রী আখি সীমা কাওসার মিলেই তদারকি করি।
তার স্ত্রী আখি সীমা কাওসারও একজন সংবাদকর্মী। দেশে প্রায় এক দশকেরও বেশি ‘দৈনিক জনতায়’ কাজ করার পর ইতালিতে এখন লন্ডন টাইমস নিউজের ডাইরেক্টর ও চীফ করেসপনডেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। এছাড়াও তিনি বিশ্বব্যাপি প্রবাসী বাংলাদেশিদের অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফর্মে প্রতিষ্ঠিত কানেক্ট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।
সাংবাদিক শাহীন খলিল কাওসার জানান, বর্তমানে তিনি গাজী টিভির ইতালি প্রতিনিধি ও লন্ডন টাইমস নিউজ এর ডাইরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। গাজীপুর জেলা সমাজ কল্যাণ সমিতি ইতালি’র আহ্বায়ক হিসেবে বেশ কিছুদিন কাজ করেছেন, বর্তমানে সংগঠনটির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ভ্রমণপ্রিয় হিসেবেও ইতালির রোম প্রবাসী শাহীন খলিল কাওসার এর বেশ পরিচিতি রয়েছে। যখনই সময় পান তিনি পরিবারের অন্যান্য সদস্য, বন্ধুদের নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরতে বের হয়ে যান। তিনি বলেন, পৃথিবীর প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য্যগুলো অবলোকন করতে আমার বেশ ভালো লাগে, আনন্দ পাই, এজন্য যখনই সময় পাই পরিবার, বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। ভ্রমণের মধ্যে বাংলাদেশই পছন্দের তালিকায় আগে থাকে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, আমরা (পরিবারের অন্যান্য সদস্য সহ) বছরে কয়েকবার দেশে আসি। এসেই বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় ঘুরতে যাই, এবারও তিনি সিলেট ও কিশোরগঞ্জের হাওড় এলাকায় ভ্রমণে গিয়েছেন বলে জানান।
পারিবারিক জীবনে সাংবাদিক দম্পতি শাহীন খলিল কাওসার ও আখি সীমা কাওসারের সংসারে রয়েছে ২ মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে শাদমা কাওসার পূর্ণতা মেডিসিন নিয়ে সাপেয়েনসা বিশ্ববিদ্যালয়ে (Sapieûa Università di Roma) মেডিকেলে পড়ছে। এছাড়া ছোট মেয়ে শাহরিন কাওসার মিম এবং একমাত্র ছেলে শাদমান কাওসার আরিয়ান রোমের স্থানীয় স্কুলে পড়াশুনা করছে।
ছেলে-মেয়েরা পাশ্চাত্য পরিবেশে পড়াশোনা ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠলেও বাংলাদেশি সংস্কৃতিও তাদের মধ্যে রয়েছে বলে জানান শাহীন খলিল কাওসার। তিনি বলেন, পারিবারিক পরিবেশে আমরা সবাই বাংলা ভাষাতেই কথা বলি। বাচ্চাদেরকে বাংলা ভাষায় কথা বলতে উৎসাহ দেই। রোমে অনুষ্ঠিত আমাদের দেশের সকল দেশীয় প্রোগ্রামে তাদের নিয়ে যাই যাতে তারা এদেশের কৃষ্টি-কালচার সম্পর্কে ধারণা পায়। বাচ্চাদের স্কুল-কলেজে ছুটি পড়লেই এদেশে নিয়ে এসে তাদেরকে এখানকার সংস্কৃতি ধারণ করার সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা করি।