তিনি একজন বিনয়ী, দরদী প্রবাসী নারী। জীবন-জীবিকার টানে পাড়ি জমিয়েছেন ইউরোপের দেশ ইতালিতে। সেখানেও তিনি মনে গেঁথে রেখেছেন তার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে। দেশে থাকতে তিনি ছিলেন একজন চৌকস সংবাদকর্মী। বিদেশের মাটিতে সংগ্রামমূখর জীবন-যাপনের পাশাপাশি এখনও আঁকড়ে রয়েছেন সাংবাদিকতায়। পাশাপাশি নানা সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। প্রবাসীদের যেকোন সমস্যায় তিনি বিচলিত হন। বাড়িয়ে দেন তার দরদী সহযোগিতার হাত। পুরো নাম আখি সীমা কাওসার হলেও পুরো ইউরোপজুড়ে পরিচিত সকলের আখি আপা নামে। সদা হাস্যোজ্জ্বল করিৎকর্মা কৃতি এই প্রবাসীর প্রবাস জীবনের নানা বিষয় প্রবাস মেলা’র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
জন্ম ও পড়াশোনা:
আখি সীমা কাওসারের জন্ম বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত নোয়াখালী জেলায় বেগমগঞ্জে। তার বাবা আব্দুল মালেক। মা নূর জাহান মালেক। তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে আখি সীমা সবার বড়। স্থানীয় লক্ষ্মীনারায়ণপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। এখানে এসএসসি শেষ করার পর বাবার চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামে ওমরগণি এমইএস কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করেন। পরে তার বাবা আবার ঢাকায় স্থানান্তর হলে সিদ্বেশরী কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি পাশ করেন।

প্রবাসে পাড়ি: বিয়ের সূত্রে ২০০২ প্রবাসে পাড়ি জমান আখি সীমা কাওসার। এর আগে ১৯৯৩ সালে শাহিন খলিল কাউসারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। শাহিন খলিল তখন দৈনিক জনতার স্টাফ ফটোগ্রাফার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে অফিসের এসাইনমেন্টে তিনি ইতালিতে যান এবং পরবর্তীতে সেখানে সেটেল্ড হয়ে পরিবারকে নিয়ে যান। এভাবেই তাদের প্রবাস জীবন শুরু হয়।
প্রবাস জীবনের সংগ্রাম: অনেকের মতো আখি সীমাও অনেক স্বপ্ন নিয়ে প্রবাসে গেলেও শুরুর সময়টা ছিল খুবই সংগ্রামী। তিনি বলেন, ‘অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে গিয়েছি, কিন্তু বাস্তবতা ছিল অনেক ভিন্ন। শুরুতে চরম স্ট্রাগল করতে হয়েছে আমাদের’। কয়েক বছর পর স্বামীর সাথে পরামর্শ করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন আখি সীমা। তিনি বলেন, প্রথমে নিজেরা কিছু করার চেষ্টা করছিলাম। পরে ব্যাংকার ব্যবসা (আমি নিজেও তখন বুঝতাম না এটা কি ব্যবসা) শুরু করি। এক টানা ছয় বছর এই ব্যবসা ভালোভাবেই চালিয়েছি। পরে ২০১১ সালে মিনি সুপার মাকের্ট খুলি। আমরা নিজেরাই এগুলো দেখাশোনা করতে থাকি।

ব্যবসার বর্তমান অবস্থা: স্বামীর পাশাপাশি নিজেও ব্যবসার দেখাশোনা করেন আখি। তিনজন বাংলাদেশি স্টাফ আছেন তাদের দোকানগুলোতে। এ প্রসঙ্গে আখি বলেন, আমাদের দোকানে তিনজন স্টাফ আছে, যাদেরকে আমরা নিজেদের পরিবারের সদস্যের মতোই দেখি।

সংবাদকর্মী: আখি সীমা কাওসার দেশে থাকার সময়ই সাংবাদিকতা করতেন। ৯০ এর দশকে দৈনিক জনতায় তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। শুরুতে তিনি বার্তা বিভাগে ছিলেন। পরে সিনিয়র সংস্থাপন ইনচার্জ ও সম্পাদকের পারসোনাল সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছেন। প্রবাসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পেশা হিসেবেই সাংবাদিকতা ছিল তার। ইতালিতে যাওয়ার পর শুরুতে পারিবারিক কাজ, ছেলে-মেয়েদের দেখাশোনা সব মিলিয়ে কয়েক বছর নিজের প্রিয় কাজ থেকে দূরে ছিলেন। পরে তিনি রোমভিত্তিক বেতার বাংলার প্রেজেন্টার হিসেবে আবার সাংবাদিকতা শুরু করেন। সেখানে তার একটি ফল্স ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে করা প্রতিবেদন তুমূল আলোচনার জন্ম দেয়। পরে ২০১৫ সালের দিকে কয়েকজন পরিচিতদের নিয়ে লন্ডন টাইমস নিউজ (London times news) নামে অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালু করেন। এর মূল উদ্যেক্তা ছিলেন চারজন। তারা হলেন শাহ সেলিম আহমেদ (নির্বাহী সম্পাদক), কাজী আসাদুজ্জামান (পরিচালক), আখি সীমা কাওসার (নির্বাহী পরিচালক) এবং শাহিন খলিল কাওসার (পরিচালক)। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনই এই অনলাইনের মূল উদ্দেশ্য বলে তিনি জানান। আখি ২০১৭ সাল থেকে প্রবাসীদের প্রিয় পাক্ষিক প্রবাস মেলার ইতালির রোম প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন। পাশাপাশি চ্যানেল ইউরোপেও কাজ করছেন।

পরিবার, ব্যবসা ও নানান সামাজিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি প্রবাসে মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন আখি সীমা। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দৈনিক জনতার প্রয়াত সম্পাদক সানাউল্লাহ নূরী ভাইয়ের উৎসাহে এখনও সাংবাদিকতা পেশায় রয়েছি। মনের প্রশান্তির জন্য সাংবাদিকতা করছি’।
মানবিক কাজ: একজন সক্রিয় মানবাধিকার কর্মী হিসেবেও নিজেকে নানাবিধ কাজে যুক্ত রেখেছেন আখি সীমা কাওসার। তিনি জানান, আমার অত্যন্ত একজন পছন্দের মানুষ মাদার তেরেসা। ওনার কাছ থেকেই কিছু করার অনুপ্রেরণা পান তিনি। আখি বলেন, ‘মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে ভালো লাগে, নিজের কাছে আনন্দ লাগে, আত্মতৃপ্তি পাই’। ইতালির রোমভিত্তিক প্রবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর একমাত্র সংগঠন ‘মহিলা সমাজকল্যাণ সমিতি’র মাধ্যমেও তিনি কাজ করছেন। সংগঠনের সভানেত্রী লায়লা শাহ্। এর সদস্য সংখ্যা ৪৫ জন।

কানেক্ট বাংলাদেশ: বাংলাদেশের উন্নয়ন ও বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অধিকার নিয়ে এই সংগঠনটি কাজ করে যাচ্ছে। আখি সীমা কাওসার এই সংগঠনের একজন সক্রিয় কর্মী। করোনার কারণে সংগঠনের কার্যক্রম কিছুটা স্থবির থাকলেও অনলাইনে নিয়মিত মিটিং হচ্ছে বলে তিনি জানান।
প্রবাসে বাধা: প্রবাসে অনেক নারী বিভিন্ন কাজ করছেন। অনেকে স্বামীর পাশাপাশি নিজেরা বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। বিদেশে নারীদের বিচ্ছেদের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আখি বলেন, যারা সরকারি বেনিফিট পায় তাদের ক্ষেত্রে সংসার ভাঙার হার বেশি। কারণ সিঙ্গেল সদস্যরা অনেক সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন।
ইতালির বর্তমান অবস্থা: করোনার কারণে ব্যবসা কিছুটা মন্দা। তবে সরকার বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে সমস্যা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছে। তবে বৈধ প্রবাসীরা এই সুবিধা পায়। ইতালিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের মান্যবর রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে এই সংবাদ কর্মী জানান।
অবৈধ পথে বিদেশে: অবৈধপথে বিদেশ যাওয়াকে আখি সীমা কোনোভাবেই উচিত নয় বলে মনে করেন। তিনি বলেন, অবৈধভাবে বিদেশে যেতে পারলেও সেখানে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে কাগজপত্র পাওয়া যায় না, অনেক ঝুঁকি থাকে, এমনকি মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।
বিমান বন্দরে হয়রানি: প্রবাসীদের বিমান বন্দরে হয়রানির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আখি বলেন, ‘এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়, এগুলো বন্ধে শক্ত হাতে পদক্ষেপ নিতে হবে’।
দক্ষ শ্রমিক: বহির্বিশ্বে বাংলাদেশে ভালো ভাবমূর্তি রয়েছে। আমি মনে করি সরকারিভাবে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে দক্ষ করে বাংলাদেশিদের বিদেশে পাঠানো গেলে একদিকে যেমন রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়বে, পাশাপাশি বিদেশে দেশের ভাবমূর্তিও বৃদ্ধি পাবে।

পরিবার: স্বামী শাহিন খলিল কাওসার একজন পেশাদার সাংবাদিক। তিনি বাংলাদেশের বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল গাজী টিভির ইতালি প্রতিনিধি। এছাড়া তিনি বাংলা প্রেসক্লাব ইতালির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের সংসারে রয়েছে দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে শাধমা কাওসার পূর্ণতা ক্যামিস্ট্রিতে গ্যাজুয়েশন করে মেডিসিনে পঞ্চম বর্ষে পড়ছে। পাশাপাশি এ বছরে ক্যামিস্ট্রি থেকে মাস্টার ডিগ্রি ইন অর্গানিক এন্ড নিউক্লিয়ার ক্যামিস্ট্রির জন্য সিলেক্ট হয়েছে। ছোট মেয়ে শাহরিন কাওসার মীম লন্ডনের কিংস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে এ্যারোনোটিক্যাল ইঞ্জিনিজিনিয়ারিংয়ে পড়ছে। একমাত্র ছেলে শাধমান কাওসার আরিয়ান ইন্টারমেডিয়েট ১ম বর্ষে পড়ছে। তার ইচ্ছা ভবিষ্যতে সে ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু আমি চাই সে আর্মি অফিসার হোক।
জীবন নিয়ে আফসোস: কোনো আফসোস নেই, তবে অনেক স্ট্রাগল করেছি।
স্বপ্ন: অনেক দূরে যেতে হবে। এর পেছনে কাজ করতে হবে, সৎ উদ্দেশ্য থাকতে হবে।
গুণ: মানুষের আত্মমর্যাদা। কষ্ট দিলে খারাপ লাগে। মায়ের বিষয়ে খুবই ইমোশনাল।
কারও প্রতি আক্ষেপ: মানুষ যেন মানুষ হয়।
প্রবাস মেলা: প্রবাস মেলা প্রবাসীদের পত্রিকা। আমি প্রবাস মেলা দিয়ে বিদেশে পরিচিত হচ্ছি। পত্রিকাটির সাফল্য কামনা করছি।
(আলাপচারিতায় লেখা তৈরি ও সম্পাদনা করেছেন– মো: মোস্তফা কামাল মিন্টু)