মার্ক লিওনার্ড, বার্লিন, জার্মানি:
যদিও ইউরোপ প্রতিরক্ষা ব্যয়ের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর উদাসীনতা দেখিয়েছে, তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এটি চাকচিক্য এবং প্ররোচনার শক্তির মাধ্যমে অন্যান্য দেশগুলিকে জয় করার জন্য আগ্রহী থেকেছে। ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যায় বিশ্বজুড়ে বসবাসরত ইউরোপের কোটি কোটি মানুষের কাছে যুদ্ধ একটি অপ্রীতিকর বিষয়। ইউরোপীয়রা তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে সর্বজনীন বলে মনে করে। তারা প্রায়শই ধরে নেয় যে, তাদের জন্য যা সঠিক তা অন্যদের জন্যও সঠিক।
ইউক্রেন সংকট দেখায় যে, ক্ষমতার প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সমস্যা রয়েছে। যদিও ইউ’র হার্ড-পাওয়ার ঘাটতি সম্প্রতি মনোযোগের কেন্দ্রে চলে এসেছে, সাথে সাথে এর দার্শনিক এবং রাজনৈতিক ত্রুটিগুলি আরও বড় উদ্বেগের বিষয় বলে প্রতিয়মান হয়েছে। সর্বোপরি, জার্মানির জেইটেনওয়েন্ডে (পররাষ্ট্র-নীতি ‘টার্নিং পয়েন্ট’), ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে বিতর্ক এবং ইউরোপীয় পুনর্বাসন ব্যয়ের অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় আরও আগে থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরে অন্য কোন দেশের চেয়ে ইউরোপের সামরিক শক্তি বেশি থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তারপরেও, ইউ’র জন্য এটি একটি সফট-পাওয়ার সমস্যা হিসেবে বিবেচ্য হবে।
ইউরোপ দুটি পরিচয়-নির্মাণ প্রকল্পের আবাসস্থল, যে দুটি বিশ্বের বাকি অংশ থেকে গভীরভাবে বিচ্ছিন্ন। ফরাসী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় রাউন্ডে প্রত্যেকের প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছিল, যেখানে ক্ষমতাসীন এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, চরমডানপন্থী জাতীয়তাবাদী নেতা মেরিন লে পেনকে পরাজিত করে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
ম্যাক্রোঁ ফ্রান্স এবং ইউরোপ কী ধরণের সভ্যতা নির্মাণ করতে চায় সে সম্পর্কে একটি উৎকৃষ্ট অভিমত হিসেবে তার প্রচারণার কাঠামো তৈরি করেছিলেন। তিনি তার দেশকে আলোকিত নাগরিকগুণের চূড়ান্ত মূর্ত প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করেছেন। তার জন্য (এবং আমার মতো ইউরোপীয়দের জন্য), ইউরোপীয় প্রকল্পটি এই মহাদেশের জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং গণহত্যার রক্তাক্ত ইতিহাসকে অতিক্রম করার একটি বিস্তৃত প্রচেষ্টা হিসেবে মূল্যায়ন করা উচিত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে নাগরিক নীতির উপর ভিত্তি করে একটি নতুন ইউরোপীয় পরিচয় তৈরি করা: যেমন আন্তর্জাতিক আইন (ক্ষমতাই একমাত্র সঠিক নীতি- এর বিরুদ্ধে), উদার গণতন্ত্র (জনতুষ্টিবাদী সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিরুদ্ধে), গোপনীয়তা (নজরদারী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে) এবং মানবাধিকার (নজরদারি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে)।
এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অর্থ হল একটি নতুন ধরণের দেশপ্রেমকে জাগ্রত করা। যতদূর এটি সফল হয়েছে, তাতে একটি প্রতিবিপ্লবকে উস্কে দিয়েছে। বিশেষত যারা বিশ্বাস করে যে, বিশ্বায়ন এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর একীভূতকরণ তাদের সম্পদ, সংস্কৃতি এবং মর্যাদাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। লে পেন নিজেকে ইউরোপীয় পরিচয়ের এই নতুন-পুরাতন সংস্করণের জননেতা হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি ম্যাক্রোঁকে মৃত্যুর বিশ্ববাদী এজেন্ট হিসাবে বর্ণনা করেছেন যিনি কিনা ফ্রান্স এবং ইউরোপকে সাংস্কৃতিক আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেবেন। তিনি অবহেলিত কৃষক এবং শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করেন যাদের স্বার্থ অর্থনৈতিকভাবে অভিজাত এবং উদ্বাস্তুদের সুবিধার জন্য উপেক্ষা করা হয়েছে।
ফরাসি নির্বাচন ব্যবস্থার কাঠামোগত গতিশীলতা ইউরোপীয় পরিচয়ের এই দুটি সংস্করণের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককে তীব্র করেছে। এর ফলে মধ্যপন্থী বামপন্থা (Centre Left) এবং মধ্যপন্থী ডানপন্থার (Centre Right) মধ্যে ঐতিহ্যগত প্রতিযোগিতা খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদ এবং নাগরিক আন্তর্জাতিকতাবাদী দেশপ্রেমের মধ্যে একটি বিভাজনের পথ তৈরি করে। তবে এক্ষেত্রে ফ্রান্স শুধু একা নয়। যে কেউ ইউরোপ জুড়ে একই রকম বিভাজন খুঁজে পাবে। ‘নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেওয়ার’ আন্দোলনগুলি নতুন ইউরোপীয় পরিচয়কে ভিত্তি করে প্রাণ পাওয়া উন্মুক্ততা এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরুদ্ধে ভোটারদের একত্রিত করেছে।
ধর্ম এবং ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের প্রতি তার আবেদন থাকা সত্ত্বেও, লে পেনের জেনোফোবিয়া, ইসলামোফোবিয়া এবং আভাসিত শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের প্রতি তার সমর্থন বিশ্বের ১.৯ বিলিয়ন মুসলিমসহ বিশ্ববাসীর একটি বড় অংশ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করেছে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল যে, ম্যাক্রোঁর মতো আন্তর্জাতিকতাবাদীদের দ্বারা নাগরিক পরিচয় বিকাশের প্রচেষ্টা কখনও কখনও বিশ্বের অনেক অংশে ইউরোপের আবেদনকেও হ্রাস করেছে। তার প্রণীত ইউরোপ লিঙ্গ সমতা, সংখ্যালঘু অধিকার এবং পরিবেশগত কর্মকা-কে সমর্থন করে। অন্যদিকে এটি বাজার ব্যবস্থার বাধ্যতামূলক সার্বভৌম ক্ষমতা এবং অতি-জাতীয় নীতি ও প্রতিষ্ঠানের অধীনস্থ করতে ক্রমবর্ধমানভাবে সাহায্য করে।
এই নতুন অগ্রাধিকারগুলি স্বাভাবিকভাবেই ভণ্ডামির অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছে। ২০১৫ সালের সিরীয় শরণার্থী সংকটের সময় অনেক ইউরোপীয় দেশ সিরীয় শরণার্থীদের জন্য তাদের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। আর এখন ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা স্বর্ণকেশী, নীল চোখের শরণার্থীদের উষ্ণ ও খোলামেলাভাবে স্বাগত জানাচ্ছে। এই বছরের দোহা ফোরামে অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই উল্লেখ করেছে যে, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের নীতির প্রতি পশ্চিমের প্রতিশ্রুতি পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের আকাশে পশ্চিমা ড্রোনের টহল দেওয়ার পরে কিছুটা ফাঁপা হয়ে গেছে। সেই দেশগুলি নয় কি যারা কসোভোতে আন্তর্জাতিক সীমানা পরিবর্তন করেছে, লিবিয়ার মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফিকে উৎখাত করেছে এবং ইরাকে আক্রমণ করেছে? তদুপরি, শতাব্দী ধরে পৃথিবী নামক গ্রহটিকে লুণ্ঠন করার পর, ইউরোপ এখন নিজেকে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন এবং পরিবেশ সুরক্ষার চ্যাম্পিয়ন হিসাবে উপস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইউরোপীয়রা তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে সর্বজনীন বলে মনে করে। তারা প্রায়শই ধরে নেয় যে, তাদের জন্য যা সঠিক তা অন্যদের জন্যও সঠিক। বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে, বেশিরভাগ ইউরোপীয় সমাজ সংখ্যাগরিষ্ঠ গণতন্ত্র, সংখ্যালঘু অধিকার এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি করেছে এবং আমরা এখন তাদের নীতির এই প্যাকেজটিকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করি। কিন্তু আরব বসন্ত যেমন দেখিয়েছে, অন্য দেশের লোকেরা ক্ষমতাসীনদের সম্পূর্ণ প্যাকেজ দাবি না করেই ভোট দেওয়ার অধিকার বেছে নিতে পারে। যারা স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তারা নিজেদের মুক্তির সংগ্রাম করেছিল পশ্চিমাদের নকল করার জন্য নয়।
পৃথিবী সাম্রাজ্যবাদী যুগ থেকে উপনিবেশীক শাসনের বিরুদ্ধ যুগে চলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। পূর্বে, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক মডেল এবং নতুন যোগাযোগ প্রযুক্তির সাফল্য পশ্চিমা ধ্যান-ধারণা এবং মূল্যবোধকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এখন, ভিন্ন ভিন্ন দেশ ও সমাজ ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতি লালন করতে চায়।
এই দৃষ্টান্ত প্রতিস্থাপনে প্রত্যেকের গভীর প্রভাব রয়েছে, যে দেশ বা শক্তিগুলি উন্নতি করতে চায় তাদের সফট পাওয়ারের একটি ‘সার্বভৌমত্ব-বান্ধব’ ধারণা গ্রহণ করতে হবে। এটি ব্যর্থ হলে, আমরা ইউরোপীয়রা সবসময় সাদাদের বিশেষাধিকার নিশ্চিত করতে, আমাদের আদর্শ এবং মানদ- ব্যবহার করার জন্য অভিযুক্ত হব। এতে আমরা উপনিবেশীকরণের নতুন প্রকল্পের সাথে মতবিরোধে জড়িত থাকব, এবং এইভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকাংশ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করবো।
মার্ক লিওনার্ড: ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের পরিচালক।
স্বত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অনুবাদ: শহীদ রাজু।