মো: বাছের আলী
করোনা ভাইরাস মহামারি ২০২০ সালে পৃথিবীজুড়ে সব পরিকল্পনা তছনছ করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকা- থেকে শুরু করে শিক্ষা, ভ্রমণ প্রভৃতি সেক্টরে মারাত্মক ধাক্কা দিয়েছে। তবে অগ্রযাত্রায় ছন্দপতন শেষে নতুন স্বাভাবিকের সাথে তাল মেলাতে এখন সর্বাত্মক চেষ্টায় আছে সবাই। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে করোনার টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। খুব শিগগরই পৃথিবী করোনামুক্ত না হলেও টিকা প্রয়োগ করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করবে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশারা বাণী শুনিয়েছেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নানাবিদ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাগুলোও অনেক দেশ তুলে নিতে শুরু করেছে। তাই দীর্ঘদিনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি নিতে সুযোগ থাকলে আপনিও পরিবার নিয়ে কিংবা ব্যবসায়িক কাজে বেরিয়ে পরতে পারেন।
প্রবাস মেলার ধারাবাহিক ভ্রমণে করণীয় ও বর্জনীয় এর এবারের পর্বে আর্জেন্টিনা নিয়ে নানান তথ্য তুলে ধরা হলো।
ফুটবলের জন্য আর্জেন্টিনা আমাদের কাছে অতি পরিচিত একটি দেশের নাম। সময়ের সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি কিংবা সারা বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয় সদ্যপ্রয়াত ম্যারাডোনার নাম জানে না এমন ফুটবল ভক্ত পাওয়া নিশ্চয়ই দুস্কর হবে! ফুটবলের এই কিংবদন্তিদেরও দেশ আর্জেন্টিনা প্রাকৃতিকভাবে অত্যন্ত সুন্দর একটি দেশ। সৌন্দর্যের পাশাপাশি দেশটির কর্তৃপক্ষ ভ্রমণকারীদের জন্য রেখেছেন নানা সুযোগ-সুবিধা।

দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটি সাধারণভাবে আমাদের কাছে ভ্রমণ অনেক বিলাসবহুল এবং খরচের স্থান মনে হতে পারে। কিন্তু তা আদতে মোটেও ঠিক নয়। সাশ্রয়ী কিছু অফারে দেশটিতে ভ্রমণের জন্য রয়েছে দারুণ সুযোগ। দেশটির হোটেলে খুব অল্প খরচে রুম পাওয়া যায় যা বিশ্বের অনেক দেশেই নেই। তাই পরিবার কিংবা ব্যবসায়িক কাজে আপনার পরবর্তী গন্তব্য হতে পারে আর্জেন্টিনা। তবে তার আগে জেনে নিই দেশটিতে ভ্রমণে কিছু করণীয় এবং বর্জনীয় বিষয়।
সংস্কৃতি: আর্জেন্টাইনদের রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। তারা তাদের ঐতিহ্যকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কোন অনুষ্ঠানে তারা মেট নামে পরিচিত ছোট কাপে এ্যালুমিনিয়াম স্ট্র দিয়ে এক ধরনের চা পরিবেশন করে থাকে, যা প্রত্যেকে ভাগ করে পান করে। একজন ভ্রমণকারী হিসেবে একই কাপ থেকে আলাদা ১০ জনকে পান করতে দেখলে আপনার অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আর্জেন্টাইনরা জনসম্মুখে প্রকাশ্যে চুম্বনে অভ্যস্ত, যা দেখে আপনি শকড হতে পারেন। কাউকে অভিবাদন জানাতে শুধুমাত্র একবার চুম্বন দিন, কখনো কখনো পুরুষ কিংবা মহিলা যেই হোক আলিঙ্গন করারও রীতি রয়েছে। এসময় উচ্চস্বরে এবং বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক রেখে কথা বলতে হয়।

রাজনীতি, ধর্ম এবং ফুটবল: আর্জেন্টিনার সমাজে রাজনীতি, সামরিক, গীর্জা এবং ফুটবলের মতো বিষয়গুলো বেশ প্রচলিত। ফুটবলে ম্যারাডোনা এবং মেসি, ধর্মযাজকে জুয়ান এবং হেভটা পেরান এগুলো স্পর্শকাতর বিষয়। একটি সাধারণ কথপোকথন সহজেই বিতর্কে পরিণত হতে পারে। আপনি এসবের মধ্যে পড়ে গেলে কখনো একে ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না।
সকাল, দুপুর এবং রাতের খাবার: দেশটির অধিকাংশ অঞ্চলের মানুষ বিশেষ করে উষ্ণতম এলাকায় বিকেলে ন্যাপিং (হালকা ঘুম) করে। সাড়ে ১২টা থেকে ৪-৫টার মধ্যে অনেক খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। স্থানীয়রা সাধারণত রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে থাকেন। এজন্য আর্জেন্টানইরা ৬টার দিকে চা পান করেন। সকাল ১০টার আগে হোটেলগুলোতে খুব একটা খাবার পাবেন না।

অ্যালকোহল: আর্জেন্টিনায় ১৮ বছরের কম বয়সীদের জন্য অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় নিষিদ্ধ। দেশটিতে প্রাপ্তবয়ষ্কদের জন্য অল্প পরিমাণ খাওয়াকে অনৈতিক মনে করা হয় না, এমনকি বিদেশিদের জন্যও এটা প্রযোজ্য।
আর্জেন্টিনায় ব্যবসায়িক শিষ্টাচার: দেশটিতে পুরুষ-মহিলা উভয়কেই হ্যান্ডশেক করে অভিবাদন জানাতে হয়।

হোস্টের সাথে আপনার ব্যক্তিগতভাবে আরও ভালো সম্পর্ক থাকলে কোলাকুলি এবং মুখে চুমো দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে পারেন। তারা আপনার খুব কাছে দাঁড়াবে এবং এমনকি আপনাকে স্পর্শও করতে পারে। আপনি পিছনে যাবেন না। ব্যবসায়িক মিটিংয়ের সময় কাউকে সম্বোধনের সময় ফরমাল নামে এবং উপাধিতেই ডাকবেন। মিটিংয়ে আপনি সঠিক সময়েই উপস্থিত হোন, তবে হোস্ট ৩০ মিনিট দেরি করলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ব্যবসায়িক মিটিংয়ে ফরমাল এবং ভালো পোশাক পরিধান করা ভালো। তবে প্রথম মিটিংয়ে যারা অংশ করবে তাদের জন্য ব্যতিক্রম, না পরলেও চলবে। ব্যবসায়িক পোশাক বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতই। তাই বিনিয়োগকারীর সাথে আপনাকে মিটিংয়ের সময় ভালো পোশাক পরতে হবে।

কারো বাড়িতে ডিনার বা পার্টিতে নিমন্ত্রণ পেলে কমপক্ষে ৩০ মিনিট দেরি করে উপস্থিতি হোন এবং কিছু উপহার নিয়ে যান। উপহার হিসেবে মদ, চকোলেট, ওয়াইন, ফুল গ্রহণযোগ্য হতে পারে। আর আপনি যদি হোস্ট থেকে কিছু উপহার পান সাথে সাথে খুলুন এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
দেশটির লোকজন জনসম্মুখে কিংবা কোন যাত্রা অবস্থায় গণপরিবহনে কিছু খায় না।
আর্জেন্টাইনারা রাজনৈতিক বিষয়ে আলাপ করলেও আপনি এ বিষয়টি এড়িয়ে চলুন। কখনোই ব্রাজিল অথবা আমেরিকার সাথে আর্জেন্টিনার তুলনা করবেন না। ব্রিটেনকেও এই আলোচনায় অহেতুক টেনে আনবেন না।
বকশিশ: অর্থ সম্পর্কে সর্বোত্তম পরামর্শ হলো দেশটিতে ভ্রমণের সময় মার্কিন ডলার নিয়ে যাওয়া। নগদে সব কিছুর জন্য অর্থ প্রদান করুন। আর্জেন্টাইনরা মার্কিন ডলার পেতে যথেষ্ট মরিয়া। বকশিশ দেয়া আর্জেন্টিনায় একটি ঐতিহ্য। আবাসিক হোটেলগুলোর কর্মচারীদের প্রতিদিন দুই পেসো করে বকশিশ দেয়ার প্রচলন রয়েছে। দিনের শেষের অপেক্ষা না করে আগেই বকশিশ দিয়ে দিলে ভালো পরিষেবা পেতে পারেন। তিন ঘণ্টার ট্যুরের জন্য গাইডকে ১০০ পেসো দিতে হবে। আরও বেশি সময়ের জন্য হলে বকশিশও বাড়িয়ে দেয়া ভালো। রেস্তোরাঁয় ১০ শতাংশ বকশিশ দিতে পারেন। ট্যাক্সিতে বকশিশ দেয়া আবশ্যক নয়, তবে দিলে প্রশংসা পাওয়া যায়

আর্জেন্টিনা ভ্রমণে যে ৮টি বিষয় অবশ্যই জানতে হবে:
১. পার্কে বসে নতুন বন্ধুদের সাথে সময় কাটান। সেখানে অবশ্যই বলতে হবে (Me das un mate) আপনি আমার সাথী।
২. স্থানীয় লোককাহিনী (folklore) বা পেনা (peña) উৎসবে যোগ দিন।
৩. মেন্ডোজার লাস হেরাসে গাউসদের একটি প্রচলিত খেলা প্যাটো (pato) দেখুন।
৪. ঐতিহ্যবাহী আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোতে পরিদর্শন করুন এবং তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে কিছু সহায়তা করার চেষ্টা করুন।
৫. মিলঙ্গায় টাঙ্গো নাচ (Dance tango) দেখতে যেতে পারেন।
৬. গাউচোদের সাথে ঐতিহ্যবাহী আসাদো (asado) খেতে পারেন।
৭. অবশ্যই ড্রিঙ্ক পান করুন। তবে ফার্নেট কন কোকা চেষ্টা করে দেখুন। আপনি যদি কোন আর্জেন্টিনা বিশেষ করে কর্ডোবাতে আপনি এটা চেষ্টা করে দেখেন, তাহলে আপনি ঘটনাস্থলেই একজন বন্ধু বানিয়ে ফেলতে পারবেন!
৮. কর্ডোবাতে প্রচলিত সবচেয়ে জনপ্রিয় মিউজিক কুয়ার্তেটো (Cuarteto) শুনুন।
আর্জেন্টিনার কয়েকটি দর্শনীয় স্থান:
ইগাজু জলপ্রপাত: বিশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আর্জেন্টিনায় পর্যটকরা যায় শুধুমাত্র এই ইগাজু জলপ্রপাত দেখতে। এটি ২৭৫টি আলাদা জলপ্রপাত ও ঝর্ণার মিলনে তৈরি হয়েছে। পাশেই একটি পার্ক সমন্বিত এই জলপ্রপাতটি প্রাকৃতিকভাবে খুবই সুন্দর। এখানকার পুরো জায়গাটির মাঝে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হল অর্ধ-বৃত্তাকার জলপ্রপাতটি যেটিকে ‘শয়তানের গলা’ বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। এটি ৮০ মিটারের মত উঁচু এবং ২৭০০ মিটার চওড়া।
পেরাইটো মরেনো হিমবাহ: এটি পানি সংক্রান্ত আরেকটি আকর্ষণী পর্যটন এলাকা। এখানে একটি বরফের নদী রয়েছে। এই হিমবাহটি আর্জেন্টিনার দক্ষিণাঞ্চল প্যাটাগোনিয়াতে অবস্থিত।
এল চাল্টেন: এল চাল্টেনের আশেপাশে লস গ্ল্যাসিয়ারিস ন্যাশনাল পার্ক, সিরো ফিৎজ রায় পর্বত এবং সিরো টোরি রয়েছে যেগুলো বিভিন্ন পর্বতারোহী এবং দর্শনার্থীদের কাছে বেশ চাঞ্চল্যকর স্থান হিসেবে পরিচিত।
মেংডোজা প্রদেশ: মেংডোজা প্রদেশের সাথে মদের সম্পর্ক যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই প্রদেশে প্রচুর পরিমাণে অ্যালকোহল তৈরি করা হয়। প্রদেশটির পেছন দিকে আন্দিজ পর্বতমালা এমনভাবে ছড়িয়ে রয়েছে যা দেখে যে কোন পর্যটক বিমোহিত হবে।
বারিলোচি: অ্যালকোহলের জন্য যেমন মেংডোজা প্রদেশ তেমনি বরফের জন্য পরিচিত বারিলোচি। এর পাশেই প্যাটাগোনিয়াও আর্জেন্টিনার একটি বিখ্যাত প্রদেশ যেটি সুইস জার্মান সুতোর জন্য প্রসিদ্ধ।
কিউব্রাডা দে হামাহুয়াকা: কিউব্রাডা একটি গিরিখাত যেটি ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং সমুদ্রতল থেকে ২ হাজার মিটার উপরে অবস্থিত।
পুয়ের্তো মার্ডেইন: আর্জেন্টিনার প্যাটাগোনিয়াতে অবস্থিত পুয়ের্তো মার্ডেইন অন্যতম সুন্দর পর্যটন এলাকা। এখানে ওয়েলশ টাউনের পাশে অবস্থিত গাইমেন যেটিতে ওয়েলশ ঔপনিবেশিকদের স্থাপত্য, ঐতিহ্য এবং ভাষা সংস্কৃতির পরিচয় লক্ষণীয়।
এল বলসন: এল বলসন ১৫ হাজার জনসংখ্যাবিশিষ্ট একটি পরিচিত শহর যেটি বারিলোচি থেকে ২ ঘণ্টা দূরত্বে অবস্থিত। এটি বরফাচ্ছন্ন পর্বতে আবিষ্ট একটি সুন্দর শহর যেখানে মাছ ধরা, ভেলায় করে ঘোরা, স্কাইকিং করা যায়। এখানেও অনেক মাদক উৎপন্ন করা হয়ে থাকে। প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর এই এলাকাটিও আর্জেন্টিনার একটি বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র।