জর্জ জি. কাস্টায়েডা, মেক্সিকো সিটি, মেক্সিকো
২০২০ সালে অনুষ্ঠিতব্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী দৌড়ে আবির্ভূত কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী তাদের প্রচারণায় যুক্তরাষ্ট্রকে আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র বানানোর পক্ষে কার্যকর কিছু উপাদানের কথা উপস্থাপন করেছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য সেবা, শিশু সেবা ও শিক্ষা সেবার মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০২০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা জিতুক বা হারুক তাতে কিছু আসে যায় না। তবে তাদের এ ধরনের প্রচারণার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ১৯৩০ সালের পর প্রথমবারের মতো সামাজিক গণতন্ত্রের (ঝড়পরধষ উবসড়পৎধপু) বিষয়টি পুনরায় আবির্ভূত হয়েছে।
একজন বিদেশী হিসেবে বর্তমানে আমি আমেরিকানদের সম্পর্কে একটি বই লেখার চেষ্টা করছি। এ ব্যাপারে আমি ২০২০ সালে অনুষ্ঠিতব্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উত্তুঙ্গ নির্বাচনী প্রচার প্রচারণার কিছু লক্ষণ দ্বারা বেশ উৎসাহিত হয়েছি। বিশেষত, ডেমোক্র্যাটিক মনোনয়ন সম্পূর্ণরূপে চলমান হওয়ার সাথে সাথে অনেক প্রার্থী কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হওয়া বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ সমূহ মোকাবেলায় কিছু সাহসী নীতিমালাকে সামনে নিয়ে এসেছেন।
তাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রস্তাবগুলির মধ্যে হেলথ কেয়ার, চাইল্ড কেয়ার এবং শিক্ষার মতো বিষয়গুলো রয়েছে, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে একটি আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার উপাদান হিসেবে কাজ করবে বলে ধারণা করা হয়। সামনের দিনগুলোতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারাভিযানের মাত্রা দেখে বুঝা যাবে এই প্রস্তাবনাগুলো টিকবে কি টিকবে না। তবে ডেমোক্র্যাটদের এমন প্রচারণার ফলে আমেরিকান রাজনীতিতে ১৯৩০ সালের পর প্রথমবারের মতো সামাজিক গণতন্ত্রের বিষয়টি পুনরায় আবির্ভূত হয়েছে।
এটি একটি সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ। আমেরিকার ইতিহাসে বেশিরভাগ সময় ধরে এটি ছিল মূলত একটি মধ্যবিত্তের দেশ, বিশেষ করে ফ্র্যাঞ্চ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবেত্তা ডিপ্লোম্যাট ‘অ্যালেক্সিস ডি টকভিল’র বর্ণনায় ১৮৩০ সাল পর্যন্ত আমেরিকা একটি মধ্যবিত্ত দেশ বই কিছুই ছিল না। এর স্বপক্ষে তিনি ‘আমেরিকান ডেমোক্রেসি’ নামে একটি বইও লিখেছিলেন। টকভিল’র কথা ধার করে আরো সঠিকভাবে বলা যায়, আমেরিকা সবসময় আফ্রিকান-আমেরিকান ক্রীতদাস এবং নেটিভ আমেরিকানদের পাশাপাশি সাদা নারীদেরসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অধিকার বরাবরই অস্বীকার করেছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন সংখালঘুদের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন সমতা বজায় রাখা হতো।
পরবর্তী প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে আমেরিকান মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি আরও বাড়তে থাকে। যা দেশটির কল্যাণ রাষ্ট্রের উত্থান রোধে পরোক্ষভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখে। অন্য ধনী দেশগুলিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির বিকাশ ঘটে ১৯ শতকের শেষ দিকে। এটা সত্য যে, ১৯৩০ সালের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম একটি ফেডারেল ওল্ড এজ পেনশন স্কীম (সামাজিক নিরাপত্তা) চালু করে। আবার ১৯৬০ সালে দেশটি সরকারী-অর্থে মেডিকেয়ার এবং মেডিকেল স্বাস্থ্য-বীমা প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু যতক্ষণ মধ্যবিত্ত আমেরিকানরা পূর্ণ কর্মসংস্থান এবং অপেক্ষাকৃত উচ্চ মজুরি উপভোগ করত, ততক্ষণ পর্যন্ত সরকারী-অর্থায়নে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা এবং যথাযথ বেকারত্বের বীমা হিসাবে প্রবর্তিত সাহসী ধারণাগুলি মূলধারার রাজনৈতিক বিষয়সূচি থেকে বাদ দেয়া হতো।
বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর তিন দশক ধরে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি আমেরিকার জন্য সত্য ছিল। কিন্তু তার পর থেকে থেকে অনেক কারণে আমেরিকার অর্থনৈতিক ভাগ্য ডুবতে শুরু করে। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের গৃহিত অর্থনৈতিক নীতিমালা, বিশ্বায়ন এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতায় আমেরিকান কর্তৃত্ব হারানোসহ বিভিন্ন কারণে আমেরিকায় বৈষম্য বাড়তে থাকে, প্রকৃত মজুরি (মুদ্রাস্ফীতি-নিয়ন্ত্রিত) এবং আয় স্থবির হয়ে পড়ে। ফলে শুরু হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংকোচন।
আমেরিকায় এই নেতিবাচক প্রবণতা আজও অব্যাহত রয়েছে। যা আংশিকভাবে হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিজয়কে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। তাছাড়া, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা বাড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ধীরে ধীরে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হবার ক্ষেত্র তৈরি করছে তা আজ সুস্পষ্ট। বর্তমানে মূলধারার আমেরিকান রাজনীতিবিদরা খোলাখুলিভাবে এটিকে সমর্থনও করছেন। ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সম্ভাব্য মনোনয়ন পাবার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীগণ আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের বেশিরভাগ নীতি অনুসরণ করে নানাভাবে তাদের প্রচার চালাচ্ছেন। আসলে তাই, ট্রাম্প এবং রিপাবলিকান পার্টি ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে এই বলে আক্রমণ করছে যে তারা (ডেমোক্র্যাটরা) আমেরিকাতে সমাজতন্ত্র আনতে চায়। ডেমোক্র্যাটদের প্রতি তারা এমনও অভিযোগ তুলছেন, ডেমোক্র্যাটরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভেনেজুয়েলা বানিয়ে ছাড়বে।
কারণ অনেক ডেমোক্র্যাট প্রার্থী সরকারি তহবিলে পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে একটি বড় সম্প্রসারণের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু তাদের প্রস্তাবগুলি একটি একক-প্রদানকারী সিস্টেম (ঝরহমষব চধুবৎ) ‘সকলের জন্য মেডিকেয়ার’- একটি জাতীয় স্বাস্থ্য পরিসেবা, বা অন্য কিছু যার অর্থ একই জিনিস নয়। বার্নি স্যান্ডারস, এলিজাবেথ ওয়ারেন, কামালা হ্যারিস, এবং বেটো ওরউক সহ বেশ কয়েকজন ডেমোক্র্যাট প্রতিযোগী- এই ধরণের স্কিম গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের ব্যাখ্যায় সম্পূণরূপে একমত হতে পারেন নি। আবার তারা এ থেকে সরেও যান নি। কিন্তু আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আমেরিকার স্বাস্থ্যসেবা দুর্যোগকে অন্তত অর্ধেক উপায়ে হলেও সমাধান করার চেষ্টা করেছিলেন- যা সেই সময়ে রাজনৈতিকভাবে সম্ভাব্য সর্বাধিক উপায়ে সমাধানযোগ্য ছিল। কিন্তু সে সময় ডেমোক্র্যাটিক মনোনয়ন প্রত্যাশী যারা ওবামা কেয়ার এর পক্ষে স্পষ্টভাবে যুক্তি দেখিয়েছেন তাদেরকে উচ্চাকাংখী বলে সমালোচনা করা হয়েছিল।
ওয়ারেন, ইতিমধ্যে ৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ সম্পত্তি কর হিসেবে সংস্থান করে সার্বজনীন চাইল্ড কেয়ার প্রবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এই ধরনের ট্যাক্স সংগ্রহের কথা বিপ্লবী শব্দ বলে মনে হতে পারে, বাস্তবে ব্যাপারটা ভিন্ন। লেবার পার্টির প্রাক্তন মার্কিন সচিব রবার্ট রেইচ প্রায়শই বলেছিলেন, আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে যাদের ওপর অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল সম্পত্তি কর ধার্য করেছে তা তাদেরকেই সর্বাগ্রে ক্ষতিগ্রস্ত করবে যাদের একমাত্র সম্পদ হল তাদের বাড়ি।
আবার ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা পাবলিক কলেজগুলোতে বিনামূল্যে সর্বজনীন শিক্ষার প্রস্তাব দেন। তারা প্রাক-রিগান আমলের মতো সীমিত হারে আয়কর বৃদ্ধি এবং পুনর্বীকরণযোগ্য শক্তির উৎসগুলিতে কার্বন ট্যাক্স প্রবর্তনের প্রস্তাব করেছেন। এই সমস্ত ধারণাগুলি উত্তেজনাপূর্ণ, উদ্ভাবনী বা বিভ্রান্তিকর বলে মনে হতে পারে এবং মাত্র চার বছর আগেও তা চরম-বাম অংশের প্রচারণায় সীমাবদ্ধ ছিল। এই সমস্ত নীতির বাস্তবায়ন আমেরিকাকে রাতারাতি একটি কল্যাণ রষ্ট্রে পরিণত করবে না, কিন্তু একে বড়জোর স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর চেয়ে একটু বেশি উদার বলে মূল্যায়ন করা যেতে পারে।
উপরন্তু, কিছু ডেমোক্র্যাট প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র চালু করার সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য এর বিদ্যমান কার্যকরী রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংস্কার করতে চায়। বিশেষ করে, সম্প্রতি এলিজাবেথ ওয়ারেন ইলেক্টোরাল কলেজ বিলুপ্ত করার প্রস্তাব দেন, এর পরিবর্তে তিনি এমন একটি ব্যবস্থার কথা বলেন যাতে একটি সরাসরি জাতীয় ভোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন। উল্লেখ্য ২০০০ এবং ২০১৬ সালে, ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সর্বাধিক ভোটে জিতেছেন ঠিকই কিন্তু প্রেসিডেন্ট হতে পারেন নি।
তাই বলা যায় ওয়ারেনের প্রস্তাব আসন্ন মেয়াদেও পাস হবে না। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে মূলধারার একজন প্রার্থীর এমন প্রচার প্রস্তাবনা আমেরিকানদের রাজনৈতিক পদ্ধতি কিভাবে কাজ করে (বা না করে) সে সম্পর্কে আমেরিকান জনগণকে আরও গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করতে উৎসাহিত করবে।
অন্যদিকে ২০২০ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বানানোর প্রস্তাবগুলি ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বাধা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে, যা ট্রাম্পকে পুনরায় নির্বাচিত হতে সাহায্য করবে। তাছাড়া ডেমোক্র্যাটিক মনোনয়নকারীরা তাদের রেডিকেল অবস্থান বা পার্টির স্বতন্ত্র মূল প্ল্যাটফর্ম থেকে দূরে সরে যেতে পারে, ফলে ট্রাম্পকে পরাজিত করার জন্য তারা যথেষ্ট পরিমাণে কেন্দ্রীয় ভোটারদের আকৃষ্ট করাতে পারবে না। আর জয়ী হতে হলে তাদেরকে আরো একটি মধ্যমপন্থী প্রোগ্রাম বেছে নিতে হতে পারে। এমনকি যদি এমন একজন ডেমোক্র্যাট যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন যিনি যুক্তরাষ্ট্রকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বানানোর প্রস্তাবগুলির অনেকগুলি যদিও এখন সমর্থন করছেন, তবে এমন সম্ভাবনাও থেকে যায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি সেগুলো বাস্তবায়নে অক্ষমতা বা অনিচ্ছা প্রকাশ করতে পারেন।
যাইহোক, নেতৃস্থানীয় ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বানানোর যে নীতিগুলি সমর্থন করছেন তার বাস্তবায়ন অতি সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে আমেরিকাতে প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়েছে। এই ধারণাগুলি দেশের সংকীর্ণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে আকর্ষণ তৈরি করে ঠিকই, কিন্তু তারা মার্কিন রাজনৈতিক বিতর্কের পরিস্থিতির আলোকে তাদের মতামত পরিবর্তন করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। একমাত্র এই কারণেই বলা যায়, ডেমোক্র্যাটদের ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণা ইতোমধ্যে ২০১৬ সালের প্রচারণার মতো মামুলি এবং অন্তসারশূন্য বলে প্রতিয়মান হচ্ছে এবং তা রিপাবলিকানদের প্রতি আক্রমণ থেকে এক আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। সেকারণে বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, আমেরিকা কি কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য এখনই প্রস্তুত?
জর্জ জি. কাস্টায়েডা
২০০০-২০০৩ সময়কালে মেক্সিকো এর পররাষ্ট্র বিষয়ক সেক্রেটারি, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও ল্যাটিন আমেরিকার এবং ক্যারিবীয় স্টাডিজের বিশিষ্ট অধ্যাপক।
(প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন
শহীদ রাজু, নির্বাহী সম্পাদক, প্রবাস মেলা)।