সিকদার গিয়াসউদ্দিন: সমগ্র বিশ্ব এখন আমেরিকার আসন্ন নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। বিল অব রাইটস সহ এক্সিকিউটিভ, লেজিসলেটিভ এবং জুডিশিয়াল সকল বিষয়ে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় ও গণতান্ত্রিক আচরণের বিকাশের ক্ষেত্রে আমেরিকা অনেকটা রোল মডেল।
২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই নানাক্ষেত্রে ট্রাম্পের বিভিন্ন কার্যক্রম আমেরিকান ডেমোক্রেসী নিয়ে বিভিন্ন দেশে নানা ধরণের গুঞ্জন চলে আসছে। ধর্ম, বর্ণের বা সম্প্রদায়ের নামে নানাধরণের ডানপন্থীদের উত্থান লক্ষণীয়। বিশেষ করে ইউরোপ, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য সহ বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের আলখেল্লা জড়িয়ে একনায়কসূলভ আচরণও বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। রাজা, শেখ শাসিত দেশ কিংবা চীন, রাশিয়া বা নর্থ কোরিয়ার কথা বাদই দিলাম।
২০২০ সালের ৩ নভেম্বর। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জরিপে বাইডেন-হ্যারিস জুটির জয়লাভের সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বময় পত্র-পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়াতে নানা প্রতিবেদন লক্ষণীয়। যাতে বেশীর ভাগই ট্রাম্প প্রশাসনের ভরাডুবির বিষয়টি উঠে আসছে। ট্রাম্প প্রশাসনের শুরু থেকেই ব্রাজিলের বলসোনারো, ইন্ডিয়ার মোদী, ইসরাইলের নেতানিয়াহু, ইতালীর সালভিনি, আর্জেন্টিনা’র আলবার্তো ফার্ণান্ডেজ সহ বিভিন্ন দেশের পপুলিস্ট সরকার ও কিছু কিছু রাষ্ট্রনায়কদের একনায়কসূলভ আচরণে তা পরিলক্ষিত। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে যাদের জনস্বার্থবিরোধী, মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি কর্মের বিশদ খতিয়ান রয়েছে- তাদের এখন মাথাব্যাথা শুরু হয়ে যাওয়ার কথাও শুনা যায়।
রাষ্টবিজ্ঞান ও রাজনীতি বিষয়ে অভিজ্ঞদের কিংবা গণতন্ত্র বলতে বিশ্বব্যাপী যে ধারণাটি প্রচলিত তা হচ্ছে-‘যখনই কোন সরকার জনগণের জীবন, স্বাধীনতা ও সূখান্বেষা ধ্বংস করতে লিপ্ত হবে- তখনই সে সরকার বদলানোর বা উৎখাত করার অধিকার জনগণের হাতে থাকবে। অধিকার থাকবে নিজেদের নিরাপত্তা, শান্তি, সমৃদ্ধি ও সুখময় জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নীতিমালার ভিত্তিতে এবং রূপরেখা অনুযায়ী ক্ষমতার বিন্যাস ঘটিয়ে নতুন সরকার গঠনের।’ আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণায় বর্ণিত এই গণতান্ত্রিক নীতিটি জনগণের স্বার্বভৌমত্বের ফলিত প্রকাশ হিসাবে সর্বত্র আলোচিত।
রাষ্ট্রক্ষমতায় ডোনাল্ড ট্রাম্প আসার পর বিশ্বময় গণতান্ত্রিক আচরনের ক্ষেত্রে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণায় বর্ণিত গণতান্ত্রিক নীতি নিয়ে আলোচনা সমালোচনার অন্ত নেই।সেই সূযোগে রাষ্ট্রক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে-যে সকল দেশে গনতন্ত্র এখনো আলোর মূখ দেখেও না দেখার মতো,সে সকল দেশে সকল ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা ও শাসকদের একনায়কসূলভ মনোভাব, শাসকদলের নেতা ও কর্মিদের অশিষ্ট আচরণ মারাত্মক রকমের আকার ধারণ করেছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে অন্তহীন আলোচনা সমালোচনাতো আছেই। কারণ ট্রাম্পিজমকে কেন্দ্র করে গণতন্ত্রের রোলমডেলই এখন আক্রান্ত বলে অনেকের বিশ্বাস।
এমতাবস্থায় বাইডেন-হ্যারিস জুটি নির্বাচনে জিতে এলে বিশ্বের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা ও কর্মীরা উদ্ভূদ্ধ হবে। অনুপ্রাণিত হবে বলে মনে করে। ইতিমধ্যেই রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতন ও চীনে সমাজতন্ত্রের নামে ক্যাপিটালিস্ট অর্থনীতি চালু হলে সাধারণ মানুষের মনে সমাজতন্ত্রের আবেদন এখন তেমন আর নেই বললেই চলে। এমতাবস্থায় গণতন্ত্রের ও মানবতার মুক্তির জন্য বিশ্বের মানবিক ও মৌলিক অধিকার আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের দৃষ্টি এখন আমেরিকার নির্বাচনের দিকে নিবদ্ধ বললেই চলে। আমেরিকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী শাসক সম্প্রদায় সহ সাধারণ জনগণের মাঝে এমন কৌতুহল আগে আর কখনো দেখা যায়নি বলে বিশেষজ্ঞগণের লেখায় প্রতিভাত। ট্রাম্পের সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টনয়ের লেখা বইতে একনায়কসূলভ মনোভাবাপন্ন রাষ্ট্রনায়কদের প্রতি ট্রাম্পের সহমর্মিতার বিবরণ পাওয়া যায়। ওয়াটারগেট খ্যাত বিশিষ্ট সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডের লেখা বইতেও নানা তথ্য দেখা যায়।
বাংলাদেশও সম্ভবত: ব্যতিক্রম নয়। আমেরিকাসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় ইউনিয়নভূক্ত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে আগত প্রবাসী অভিবাসীদের সংখ্যা এখন কম নয়। সকলের কথাবার্তায়, আড্ডায় এখন অনেকটা তা কমবেশী আলোচিত সমালোচিত। একদিকে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুসের সাথে বিল ও হিলারী ক্লিনটনসহ ডেমোক্রেটদের সাথে আত্মিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে বর্তমান শাসকদলের ইঁদুর বিড়াল খেলা অতীতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিলো। আবার নতুন করে তা ফিরে আসার বিষয়টি অনেককে এখন বলতে দেখা যায়।
অন্যদিকে কোভিড-১৯’য়ের ধাক্কায় সারাবিশ্ব টালমাটাল। এমতাবস্থায় বেশকিছু প্রবাসীগণ সব হারিয়ে দেশে এলে নিরাপত্তার অজুহাতে গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি নূরের নেতৃত্বে গ্রেফতারকৃত প্রবাসীগণের মুক্তির আন্দোলনের বিষয়টিও দেশে-বিদেশে শাসকদলের ভাবমূর্তি এখন আলোচিত সমালোচিত। তাই বাইডেন-হ্যারিস জুটি জয়লাভ করলে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ক্ষেত্রে নতুন করে বাংলাদেশের শাসকদল ও বিরোধীদলগুলো তাদের রাজনৈতিক ষ্ট্র্যাটেজী নিয়ে এগিয়ে যাবে বলে বিজ্ঞজনদের বলতে দেখা যাচ্ছে। আমরা যেন ভূলে না যাই-অর্থ ও ক্ষমতা কারো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। শেষ বিচারে গণতন্ত্রের মুক্তি অবধারিত। তাই সরকারী ও বিরোধীদলগুলোকে জনগণের সূখান্বেষাকে সামনে রেখে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতেই সবকিছু নির্ধারণ করতে হবে।
লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কমিটি ফর ডেমোক্রেসী ইন বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র; সাবেক সদস্য সচিব, যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধ চেতনা পরিষদ; সাবেক প্রতিষ্ঠাতা আহ্ববায়ক, কর্ণেল তাহের স্মৃতি সংসদ; বর্তমানে কানেক্ট বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের অন্যতম নির্বাহী; পৃষ্টপোষক, বিশ্ব সংগীত কেন্দ্র। লাসভেগাস, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।