এবিএম সালেহ উদ্দীন, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে: এপ্রিল মাস আমেরিকার কবিতার মাস। কয়েক বছর আগে এপ্রিলকে আমেরিকার জাতীয় কবিতার মাস হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। তার পর থেকেই আমেরিকার সর্বত্র যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে এপ্রিলকে কবিতার মাস হিসেবে পালন করা হয়। কবিতাকে সর্ববিস্তারী করে তোলার জন্য পুরো একটি মাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে মুখর হয়ে থাকে কবি ও কবিতার কর্মশালা।
কবিতা কী? আমরা কবিতা কেন পড়ি এবং কেন লিখি? প্রশ্নটি ছোট হলেও তার অর্থ অনেক ব্যাপক। যিনি সৃষ্টি করেন তাকে যেমন স্রষ্টা বলা হয়; কবিতা যিনি লেখেন তাকে কবি বলা হয়। কবির দায়িত্ব সৃষ্টি করা। সৃজনে মননে সাহিত্যের সুশীল ছায়ায় সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে মানুষের জন্য কবিতাকে ছড়িয়ে দেওয়া। এই পৃথিবীর সৃষ্টিকুল এবং মানুষের জন্য ছন্দময় পঙ্্ক্তিমালায় সাজিয়ে কবিতার ফরম্যাট তৈরি হয়। সেই শক্তির বলয়ে অন্তরস্পর্শী লেখার মধ্য দিয়ে কবি যা লেখেন, সেটিই কবিতা। এই গুরুদায়িত্বটি কবির ওপরই বেশি বর্তায়। রাষ্ট্রপুঞ্জ যেমন জনকল্যাণের বাইরে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তেমনি কবির সৃষ্টিশীল রচনা কবিতা হয়ে পাঠকের জন্য অনুকরণীয় নীতিমালার সৃষ্টি করে তোলে।
উদাহরণস্বরূপ কবি ও সাহিত্যিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথা অনুপাতে বলতে হয়, ‘একজন কবি যখন নিজের মুক্তির কথা লিখছেন, তা পড়ে অন্যরাও মুক্তি অনুভব করছে। কবি তো সরস্বতীর সঙ্গে দায়িত্বতার চুক্তি করে লিখতে বসছেন না। তবে কবির দায়বদ্ধতা থাকে কবিতার প্রতি, নিজের প্রতি।’
কবিকে সর্বদা আত্মমগ্ন থাকতে হয়। আমি মনে করি, কবিকে অবশ্যই সৃষ্টিশীলতার গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি রেখে স্বনির্মিতির ওপর অটল ও অবিচল থাকতে হবে। কবি মূলত বিত্তহীন। তার মূল সম্পদ হচ্ছে তার সৃষ্টিকর্ম ও নিজস্ব কাব্যবোধ। কবিতার গুণে ও মহত্তের দ্বারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে একজন কবির কাছে মানুষ ও প্রকৃতি হচ্ছে আসল চিন্তার উৎস। কবিতা চিরকালই একজন কবির মনন ও চেতনায় সৃজনশীলতার প্রকৃষ্ট সম্পদ। মানুষের পক্ষে নিঃস্বার্থ, নিরপেক্ষতার নিঃশর্ত ঘোষণা দিয়েই কবিরা কাব্যরচনা করেন। একজন প্রকৃত কবির কাজ মূলত তা-ই। কেননা কবিতা সর্বদাই জীবন্ময় ও মানুষের জীবনের শক্তিময়তার জোগানদাতা। কবিকে তার কবিতার মাধ্যমে সেটি আয়ত্ত করে নিতে হয়।
একটি ভালো কবিতা একজন দৃঢ়চেতা বিশ্বাসী মানুষের মতো। বিশ্বাসী মানুষের সান্নিধ্য লাভ করতে যেমন সবাই চায়, তেমনি একটি ভালো কবিতাও পাঠক আশা করে, যা মানুষের স্বপ্ন-সম্ভাবনা ও আশার দুয়ার খুলে দেয়। মোটকথা, একটি কবিতা পাঠ করার মধ্য দিয়ে আমরা সত্যিকারভাবে বিশ্বাসের আলো পেতে পারি। সেই কবিতা সবাই প্রত্যাশা করে। একটি ভালো কবিতা বিশ্বাসের দীপ্তিকে অবারিত করে। মানব চৈতন্যে আনন্দ ও পরিতৃপ্তির খোরাক জোগায়। একটি ভালো কবিতার যে আনন্দ আছে, তৃপ্তি আছে; একজন সত্যিকার কাব্যপ্রেমী মানুষই তার অনুভব ও উপলব্ধির মধ্য দিয়ে ঋদ্ধ হন এবং সিক্ত হয়ে ওঠেন।
কবিকে আমি আলোকিত মানুষ মনে করি। যিনি আগামীকে দেখেন এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য লিখে যান। একজন প্রকৃত কবিকে যখন সত্যিকার মানুষ হিসেবে পেয়ে যাই, তখন আনন্দের সীমা থাকে না। কবি সর্বদাই চক্ষুষ্মান ও সত্যান্বেষী। তাকে সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকতে হয়। সত্যের নিরন্তর অন্বেষণ হচ্ছে কবির প্রধান দায়িত্ব ও কাজ। সত্যানুসন্ধানের মধ্য দিয়ে কবি সর্বদা মানুষ ও প্রকৃতির ভবিষ্যৎ পথনির্দেশনার কাজটি করতে পারেন। কবির মধ্যে মানবিক ও প্রাকৃতিক উভয় দিকের সাম্যদর্শন আছে, যা দ্বারা তিনি অনাগত ও ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। কবির মাঝে প্রেম, বিরহ-বেদনা, দ্রোহ, বিদ্রƒপ ও প্রতিবাদের প্রখর চেতনাবোধ থাকে। ওই চেতনার মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবী, মানুষ ও প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেন। মানুষকে ভালোবাসেন এবং কবিতার বাণী দিয়ে ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ করেন।
কবিতার মাসের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আমাদের আমেরিকার কবিতা ও কবিদের দিকেই তাকানো উচিত। আমেরিকায় হাজার বছর ধরেই চলে আসছে কবিতার চাষ। শিক্ষা, সামাজিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য আমেরিকার সর্বত্র শিল্প-সাহিত্যের কদর আছে। কবিতার গতিময়তা এবং সর্বব্যাপী কবিতাকে সর্বত্র গ্রহণযোগ্য করে তোলার নিরন্তর প্রয়াসে এপ্রিল মাসকে কবিতার মাস বলা হয়। কবিতার জাগরণে আমেরিকায় এপ্রিল মাসে নানাবিধ কার্যক্রম বিদ্যমান।
কবিকে ইতিহাসের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়। পূর্বগামী কবির কাছ থেকে স্পৃহাবোধ সংগ্রহ করে তিনি নিজের কবিতাটিকে ভবিষ্যৎ নিয়তির ওপর ছেড়ে দিতে উদ্যত হন। কবিতার মধ্য দিয়ে প্রেম, বিরহ, দ্রোহ এবং ভালোবাসার পথ সৃষ্টি করেন। কবিতার স্থিতি ও পরিমিতির মধ্য দিয়ে কবিকে যেমন প্রেম ও রোমান্টিকতা আস্বাদন করতে হয়, তেমনি মানুষের স্বার্থেই কবিকে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে হয়। কবিতার স্পষ্ট উচ্চারণের মধ্য দিয়ে বৈষম্যের পরিবর্তে তাকে সাম্যের পথ নির্ণয় করে দিতে হয়।
প্রজাপতি যখন মধুপানের জন্য ফুলে বসে, তখন অজান্তেই তার পায়ে লেগে যায় মায়াবী পরাগ। ফুল থেকে ফুলে বসার মধ্য দিয়ে প্রজাপতির মায়াবী পরাগের যেমন মিলন ঘটে, তেমনি একজন কবির চোখ দিয়ে আরেকজন কবির সৃষ্টিকর্ম ও সত্তার সাথে মিশে যেতে হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি সেভাবেই দেখতে শিখেছি। অন্য কেউ এতে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। তবে আমার দেখার মাঝে আড়ষ্ঠতা কিংবা গোঁজামিলের সুযোগ নেই।
কবি ও কবিতাকে বিচার করতে হলে অপরের সৃজনের প্রতি সম্মানবোধ থাকতে হবে। যিনি এটি করতে পারেন, মূলত তিনিই উত্তম মানুষ।
অন্যজনের সঙ্গে মতের বেমিল থাকতে পারে। কিন্তু তার উত্তম সৃষ্টিকর্মের অবমূল্যায়ন করার অধিকার কারো নেই। সাহিত্যের অভিধারায় একজন কবি অন্য কবিকে সে রকম পরাগমিলনের মতোই দেখা উচিত। কেননা, কবিকে তার কবিতার অসম্ভব বীজগুলো সবার জন্য উজাড় করে দিতে হয়। এভাবেই কবিতা মানুষের মধ্যে প্রেম, মমত্ববোধ এবং অপার ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে।
কবিতার মাঝে বিশ্বাসের দীপ্তি আছে। মেধা ও মননশীলতার সঞ্চরণ আছে। সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে একজন প্রকৃত কবির মধ্যে সুনির্মল কাব্যভুবন তৈরি করার আছে অদম্য স্পৃহা ও শক্তি সঞ্চয়ের প্রবল আগ্রহ।
কেননা উপলব্ধি ও অনুভবের ছোঁয়ায় কবি কাব্য সৃষ্টির প্রবল স্পৃহা ও প্রেরণা পান। এ জন্য কবিতায় আত্মমগ্নতা একটা জরুরি বিষয়। সাহিত্যের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কবি তৃপ্ত ও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেন।
আমাদের ক্ষীণায়মান জীবনে সর্বদা যে নৈরাশ্যের ছাপ থাকে; সেই নৈরাশ্য থেকে রক্ষাকল্পে উন্নত ব্যবহারের মানুষের ছায়াঘন স্পর্শই পৃথিবী, প্রকৃতি ও মানুষের অনেক দিন বাঁচার সুযোগ করে দেয়। ঘনিষ্ঠতা এবং আত্মার মিলনের মধ্য দিয়ে মূলত মানুষ স্মরণীয় হয়ে থাকে। যতই অন্ধকারে থাকি না কেন, সাহিত্যের মাঝে সত্যিকার আলোর আবাসটুকুই আমাদের ছায়া মায়া দেয়। বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়।
এই পৃথিবী তো একটি পান্থশালা। এখানে পথের টানে জীবনের পানেই মূলত আমরা ছুটে চলি। কখনো পিছিয়ে গেলেও আলোর পথের সন্ধানেই যেন জীবন অতিবাহিত হয়। তাই তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কলি মনে পড়ে :
–‘পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে।
পিছিয়ে পড়েছি আমি, যাব যে কী করে।
এসেছে নিবিড় নিশি, পথরেখা গেছে মিশি-
সাড়া দাও, সাড়া দাও আঁধারের ঘোরে।’
আরেকটি কবিতায় তিনি পথের কূলকিনারা নিয়ে বলেন:
‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!
এত কামনা, এত সাধনা কোথায় মেশে।
ঢেউ ওঠে-পড়ে কাঁদার সম্মুখে ঘন আঁধার
পার আছে কোন্ দেশে।’
তেমনি মানবতার কবি, দ্রোহ, বিরহ ও রোমান্টিকতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়ও আমরা মানবজীবনের সকল চৈতন্য ও ঐশ্বর্যের সন্ধান পাই। প্রেম-বিরহ, দ্রোহ, মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য প্রতিবাদের দীক্ষা এবং বিধিবিধান পাই।
তিনি নারী-পুরুষের মিলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে আত্ম অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করার দাবি করেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
‘নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, ক্ষুধায় সুধায় মিলে
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে।’
আরেক জায়গায় নারী-পুরুষের (স্বামী-স্ত্রী) রহস্য-রোমাঞ্চের কথা তিনি অকপটে উচ্চারণ করেন :
‘পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,
কামিনী এনেছে যামিনী শান্তি, সমীরণ বারিদাহ।
দিবসে শক্তি সাহস, নিশীথে হয়েছে বধূ,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে, নারী যোগায়েছে মধু।’
কবিতার কোনো স্থান-কাল-পাত্র নেই। পৃথিবীর যেকোনো বিষয়াবৃত্তিতেই কবিতার স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যপ্রতিভার প্রতি রবার্ট ফ্রস্টের সম্মানবোধ ছিল। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে রবার্ট ফ্রস্ট আমেরিকান টেলিভিশনে এক ভাষণে রবীন্দ্রনাথের প্রতি সম্মান জানিয়েছিলেন। কথাটি এ জন্য উচ্চরণ করলাম, কবিতাকে কোনো সীমায়িত গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা যায় না। কবিতা সর্ববিস্তারী।
আমেরিকায় কবিতার মাস প্রসঙ্গে আসা যাক। আমেরিকা দেশটি যেমন অনেক বড় এবং তেমনি ঐতিহ্যের উন্নত স্বকীয়তায় এই বিশাল দেশটি বিখ্যাত হয়ে আছে বিশ্বময়। এখানকার শিল্প-সাহিত্য যেমন উন্নত, তেমনি কবিতাও ব্যাপক ও সর্ববিস্তারী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র উন্নততর শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যোগসূত্রতা ঘটিয়ে কবিতাকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়ে সর্বব্যাপী কবিতার প্রতি গুরুত্ব দিয়েই এপ্রিল মাসকে কবিতার মাস হিসেবে পালন করা হয়। কবিতার মাস উপলক্ষে আমেরিকার দুজন বিখ্যাত কবির কবিতার উদ্ধৃতি ও প্রসঙ্গ তুলে এই লেখা শেষ করতে চাই।
রবার্ট ফ্রস্ট আমেরিকার বিখ্যাত কবিদের অন্যতম। কবিতার মাস হিসেবে এখানে রবার্ট ফ্রস্টের একটি কবিতার কিয়দংশ-
যেমন ‘দ্য রোড নট টেকেন’ (যে পথে যাইনি আমি) নামে একটি বিখ্যাত কবিতা এ রকম :
‘দুটো পথ : একটি হরিদ্রাভ মসৃণ
আরেকটি গিয়েছে বনখণ্ডের মধ্য দিয়ে। আমি
একই সঙ্গে দুটো পথে চলতে পারি না। তাই
যতদূর চোখ যায়-
দাঁড়িয়ে দেখলাম
একটি পথ ঘন আগাছায় ভরা জনপদ চিহ্নহীন!
অন্য পথটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন
-আরও রয়েছে
মানুষের পায়ে হাঁটার স্বাক্ষর।
উভয় পথেই সকালের মিষ্টি রোদ পড়েছে-
কিন্তু যে পথে কেউ কখনো পা রাখেনি
আমি সে-পথটিই বেছে নিলাম।’
এই হচ্ছে রবার্ট ফ্রস্টের জীবন ও কর্মের কিছুটা দৃষ্টান্ত। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও যিনি জীবনকে বিচিত্রভাবে উপভোগ করেছেন। সমাজ-রাষ্ট্রে তার ভূমিকা রেখেছেন। রবার্ট ফ্রস্টের জীবন ও কর্মের কঠিনতম দিকগুলো তাকে আরও বেশি স্পষ্ট করে তোলে। মাটি, মানুষ ও দেশাত্মবোধের প্রবল স্পৃহা নিয়ে তিনি আজীবন কাব্যসাধনা করেছেন। কবিতার মধ্য দিয়েই তিনি বিশ্বে খ্যাতিমান হয়েছেন।
একজন কবিকে বিখ্যাত হতে হলে অনেক কবিতার দরকার হয় না। অসংখ্য কাব্যসম্ভারের মধ্যে দু-চারটি উল্লেখযোগ্য কবিতাই তাকে খ্যাতিমান করে তুলতে পারে। লুইস এলিজাবেথ গ্লিক ২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পাওয়া একজন প্রখ্যাত আমেরিকান কবি। ১৯৪৩ সালের ২২ এপ্রিল তিনি নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। স্বাভাবিক জীবনের চৈতন্যের ওপর সহজ ও সাবলীল পরিমিতিবোধের মধ্য দিয়েই তিনি একজন সত্যিকার কবি হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। জীবনকে সর্বসাধারণের আকরে সাজিয়ে তিনি তার অপার কাব্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। যেখানে প্রেম আছে, রোমান্টিকতা ও দেশাত্মবোধের শিক্ষা আছে। আরও আছে দ্রোহ ও প্রতিবাদের ভাষা।
‘Happiness’ (সুখ) শিরোনামে একটি রোমান্টিক কবিতায় তিনি বলেন :
‘দুজন মানুষ (স্ত্রী-পুরুষ) শুয়ে আছে রাত্রিনিশিতে
সাদা বিছানায় মাখামাখি দুজন-দুজনায়
ভোরের স্নিগ্ধতায় সহসাই ভাঙবে তাদের ঘুম
সজ্জা-শিয়রের ফুলদানিতে
শোভামান একগুচ্ছ লিলি-
ওদের সর্বাঙ্গে পড়েছে
সূর্যের মোহময় আলো…
পুরুষটি পাশ ফেরে;
মৃদুস্বরে প্রিয় সঙ্গিনীকে করে আলিঙ্গন
সহসাই দুলে উঠল সুখের পর্দা, স্নিগ্ধ বাতায়নে
বাহিরে পাখির কলতান।
এবার নারীটিও পাশ ফেরে, সর্বাঙ্গের উষ্ণতাপে
প্রিয় সঙ্গীর নিঃশ্বাসে দুজনায়
একাকার হয়ে যায়…’
এই কবিতার মধ্য দিয়ে লুইস গ্লিক মানুষের জীবন্ময়তার রহস্যাবৃত রোমান্টিকতাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। আধুনিক কবিতার ধাঁচে গ্লিক রোমান্টিকতার লিরিক্যাল পঙ্্ক্তিতে তার কবিতাকে উন্নত ক্ল্যাসিকধর্মী করে তুলতেও কার্পণ্য করেননি। বিশ্ব সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে লুইস গ্লিক ষোড়ষতম নারী। তিনি তার কবিতাকে শুধু আত্মজৈবনিক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখেননি। সর্বজনীন মানবতাবোধের অন্বেষণে লুইসের কবিতা ঈর্ষণীয় দৃষ্টান্ত রেখেছে। তিনি শুধু কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও গদ্য লিখেও তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন।
এপ্রিল মাস আমেরিকার শুধু কবিতার মাসই নয়, এ মাসটি শরতের স্নিগ্ধছোঁয়ায় গাছে গাছে ফুল ফোটার মাস। গ্রীষ্মের নিদাঘশোভায় কবিতার ছন্দময়তায় নিবিষ্টচিত্তে ধ্যানমগ্ন হওয়ার মাস। এপ্রিল মাস বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ ও বৈশাখের ঝড়বিদগ্ধ উত্তাপের মাস।
সত্যান্বেষণ, সত্যানুসন্ধান ও সত্যবোধই হয় যেন পথচলার পাথেয়। সাহিত্যের নিখুঁত পরিচর্যায় কবিতার সাথে নিবিড় একাত্মতার মধ্যেই গড়ে উঠুক আনন্দভুবন।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির ভয়তাড়িত শঙ্কা কাটিয়ে পৃথিবীর মানুষ আবার জেগে উঠুক। নির্মল আনন্দে সবার জীবন হয়ে উঠুক সুখময়। মানবতার জয় হোক। জয় হোক কবিতার।