তানিজা খানম জেরিন: ফেব্রুয়ারি বা ফাল্গুন মাস এলেই প্রকৃতির মোহনীয় রূপ রঙ্গিন হয়ে উঠে বিভিন্ন ফুলের সমারোহে আমরাও প্রাণ ফিরে পাই। আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য বীর শহীদ ভাইদের আত্মত্যাগের জন্য হই আপ্লুত ও উজ্জীবিত। বছর ঘুরে প্রতিবছরই ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের স্মৃতির মনিকোটায় অশ্রুসজল স্মৃতির মালা বহন করে আনে। একুশের প্রথম প্রহর থেকেই আমরা কৃতজ্ঞ আমাদের বীর শহীদ ভাইদের প্রতিদানের জন্য। এ ঋণ বাঙ্গালীজাতি অনন্তকাল স্মরণীয় করে রাখবে। বাংলা আমার মায়ের ভাষা এবং বাংলা আমার প্রাণের ভাষা। বাংলা ভাষা আমাদের বাঙালী জাতির আত্মোপলব্ধি ও আত্মোন্মচনের ভাষা, এই মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বিশ্বে এক অনন্য নজীর ও গৌরবের ইতিহাস। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই মাতৃভাষা। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী যখন আমাদের উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তখন বাঙালীজাতি গর্জে উঠে পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবীতে; অনেক আন্দোলন ও বিক্ষোভ শুরু হয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশের সর্বত্র। টানা চার বছরই মাতৃভাষার জন্য দেশব্যাপী বিভিন্ন যায়গায় ছোট ছোট আন্দোলনের দানা বেঁধে উঠে। ১৯৫২ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ ও সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে নেমে পড়ে। ভাষার লড়াইয়ে শহীদ হয় আবুল বরকত, আব্দুল জাব্বার, আবদুস সালাম সহ আরো অনেকে।
বাঙ্গালী জাতির সত্য ও ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেরণার উৎসই হলো আমাদের মাতৃভাষা আন্দোলন। চার দশক পর্যন্ত শুধু বাংলা ভাষার লোকজনই দিবসটি পালন করতো পরবর্তীতে কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালামের যৌথ প্রচেষ্টায় জাতিসংঘের মাধ্যমে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং সারা বিশ্বেও মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এই দিবসটি পালিত হয়। অভিবাসী জীবনে আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পাড় জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে মুক্তধারায় ব্যবস্থাপনায় অস্থঅয়ী শহীদবেদীতে ১৯৯৭ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রথম উদযাপন করি পর পর কয়েক বছর মুক্তধারা আয়োজিত শহীদ বেদীতে আমরা শ্রদ্ধা জানাই। যদিও দুই/এক বছর প্রচন্ড শীত, তুষারপাত ও তুষার ঝড়ের জন্য আমরা যেতে পারিনি। গত দশকে বাংলাদেশ সোসাইটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এসোসিয়েশনের আয়োজনে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ ও একুশে ফেব্রুয়ারি জাঁকজমকভাবে পালিত শুরু হয়।
বর্তমানে নিউইয়র্ক সিটির প্রতিটি বরোতেই অগণিত অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হয় এবং চারশতাধিক সামাজিক, রাজনৈতিক, পেশাজীবি সংগঠন ভাষা দিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে।
উল্লেখ্য, গত কয়েক বছর যাবত কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে ব্রঙ্কস ও কুইন্সে প্রভাতফেরী অনুষ্ঠান শুরু হয় এবং নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃক কুইন্সে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রভাতফেরী শুরু হয়েছে কিন্তু রাত্রেও আমরা প্রথম প্রহরে অস্থায়ী শহীদ মিনারে যখন শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে যাই ফুলের তোড়া নিয়ে তখন খুবই দু:খ হয় খালি পায়ে মঞ্চে উঠতে পারিনা তদুপরি প্রভাত ফেরীতেও প্রচন্ড শীতের দেশে তুষার এবং ঠান্ডা থাকাতে জুতা পায়ে দিয়ে প্রভাত ফেরী করতে হয়; তখন ছোট বেলার স্কুল ও কলেজের গাঁদা ও গোলাপ ফুল চুরি করে ফুলের মালা ও তোড়া বানানো এবং খালি পায়ে শিশির ভেজা সকালে সেজে গুঁজে শহীদ মিনারে যাওয়া এবং কুচকাওয়াজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিভিন্ন প্রদর্শনীর স্মৃতির কথা মনে পড়লে মনে হয় সেই মধুময় স্মৃতিই ফেব্রুয়ারি মাস এলেই মনের পর্দায় কড়া নাড়ে। উল্লেখ্য একুশে ফেব্রুয়ারির আগের সপ্তাহেই দুটো দিবস পালিত হয় এক হলো বসন্ত উৎসব বা পহেলা ফাল্গুন আরেকটা হলো ভালোবাসা দিবস। বসন্ত উৎসবে কৃষ্ণচূড়া গাঁদা ও গোলাপ ফুলের আমেজে প্রকৃতিও নেচে উঠে এবং মানুষের মনেও আনন্দের ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়। বসন্ত উৎসবে নিজেকে রাঙিয়ে তুলি সেই স্মৃতিতে সেই মধুময় স্মৃতি ভোলার নয়। আর ভালোবাসা দিবস হলো পবিত্রতা ও শ্রদ্ধা; শ্রদ্ধাই হলো ভালোবাসা যা বসন্তের আমেজে অন্তর আত্মা ফুলের মত পবিত্র করে শ্রদ্ধা ও পবিত্রতায় ভরে উঠে ভালোবাসা দিবসে। বিশ্ব সৃষ্টির মূল রহস্যই এই ভালোবাসার জন্য।
বিশ্বব্যাপী করোনা সঙ্কটে এবার দুইহাজার একুশের শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস খুবই সীমিত পরিসরে উদযাপিত হবে। অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ ও শহীদ দিবস পালনের কোন কর্মসূচী মঞ্চে বা ভার্চুয়ালী হওয়ার কোন খবর নিউইয়র্কের সংবাদপত্রে এখনো চোখে পড়েনি। বিশ্বের সর্বত্র মাতৃভাষার চর্চা ও সুরক্ষার জন্য আরো সময়োপযোগী সদূর প্রসারী টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও কর্মসূচী বাস্তবায়ন সময়ের দাবী। বর্তমান বিশ্বে অনেক দেশেই বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা বিলীন হওয়ার পথে। তাই ভাষা দিবস শুধু পালনের মধ্য সীমাবদ্ধ না রেখে প্রতিটি ভাষার সমস্যা চিহ্নিত করে আশু সমাধান করতে হবে। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই মাতৃভাষার প্রয়োগ সর্বস্তরে চালু করতে হবে; আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই হোক সবার অঙ্গীকার।
লেখক: কলামিস্ট, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।