তানিজা খানম জেরিন, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে: প্রতিবছরই জাতিসংঘের আহ্বানে ৮ই মার্চ বিশ্বের প্রতিটি দেশেই জাঁকজমকভাবে অনেক উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। উল্লেখ্য জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিকভাবে নারী দিবসকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং ১৯৯৬ সাল থেকে প্রতিবছরই জাতিসংঘের আওতাধীন একটি প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে পালন করে থাকেন। বিশ্ব নারী দিবস ২০২১ সালের জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘নেতৃত্ব নারী: কোভিড-১৯ বিশ্বে সমান ভবিষ্যৎ অর্জন’ । স্মর্তব্য ১৮৫৭ সালে শ্রমিকদের যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল মজুরি বৈষম্য, কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আমেরিকার রাস্তায় নেমেছিল সূতা কারখানার নারী শ্রমিকসহ সর্ব স্তরের শ্রমিকরা। পরবর্তীতে ঐতিহাসিক মে দিবসের দাবী বাস্তবায়নের পর নারীদের প্রতি বিভিন্ন বৈষম্য ও অধিকার বঞ্চিত অব্যাহত থাকার পর ১৯০৯ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোসাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন শুরু হয়। ক্ষমতায়ন, সমতা, সম-অধিকারের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে এগারো দশক ধরেই চলমান এই আন্দোলন বর্তমানে অব্যাহত আছে।
নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবতার উন্নয়ন বর্তমান দশকে কোভিড-১৯ আক্রান্ত দেশসমূহের মধ্যে পঁচিশটিরও বেশি দেশে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন নারী নেত্রী এবং সবাই সাফল্যের সঙ্গে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন এবং বর্তমানেও ভ্যাকসিন প্রয়োগেও সাফল্য অর্জনের পথে। করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর থেকেই বর্তমান ভ্যাকসিন কার্যক্রম পর্যন্ত সমভাবে নারীদের চিকিৎসা সেবা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সমাজ সেবা ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও ভ্যাকসিন প্রয়োগে সফলতা অর্জন করে যাচ্ছে। জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে প্রায় অর্ধেকাংশ নারীই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমানে নারী পুরুষ সমান তালে ভ্যাকসিন গ্রহণ করছেন। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে নিউজিল্যান্ডর প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরর্ডান জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন এছাড়াও নারী শাসিত কয়েকটি দেশ করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে নারী নেত্রীরা জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছেন। উল্লেখ্য ভ্যাকসিন আবিষ্কারেও নারীরা এগিয়ে রয়েছেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর অফ ভ্যাকসিনলোজি জেনার ইনস্টিটিউট এন্ড নাফিল্ড ডিপার্টমেন্ট অব ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের সারাহ গিলবার্টপ্রথম ভ্যাকসিন আবিস্কারের ঘোষণা দেন এবং কৃতকার্য হন। ফাইজারের ভ্যাকসিন আবিষ্কারে রয়েছে মহিয়সী নারী ওজলেম তুরেসির অর্ধেক অবদান এবং কৃষ্ণাঙ্গ আরেক কৃর্তিমান নারী মেডোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারে ডা. কিজিমিকিয়া কোরবেটের অবদান রয়েছে এবং এছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশেই কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন আবিষ্কারে নাম না জানা ভাইরাস বিশেষজ্ঞ এক তৃতীয়াংশ নারীর অবদান রয়েছে। সমান অধিকার ও সমান সুযোগ সুবিধা থাকলে আজ নারীরাও ভ্যাকসিন আবিষ্কারে অর্ধেক সাফল্য পেতো। উল্লেখ্য কোভিড-১৯ চিকিৎসা সেবা ও ভ্যাকসিন প্রয়োগে আমেরিকায় ৪২% এবং সারা বিশ্বে ৩১% নারী জড়িত। যুগে যুগে বিভিন্ন ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পরও এক গবেষণায় দেখা যায় বর্তমানে সারা বিশ্বে পেটেন্ট আবেদন মাত্র ১৩% আসে নারীদের কাছ থেকে কিন্তু পূর্বে তা ছিল সাতজনের একজন নারী আবিষ্কারক, আবিষ্কারের এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে আগামী পাঁচ দশক বা আগামী দুইহাজার সত্তর সালেও এ ক্ষেত্রে সমতার লিঙ্গ সমান হবে না।
সমাজের সর্বস্তরে নারীর সাফল্য ও জয়গান গাওয়ার দিন হলো বিশ্ব নারী দিবস। পিতৃতান্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় লিঙ্গের সাম্যতা সম্পর্কে সমাজকে সচেতন করাই এই বিশ্ব নারী দিবসের সূচনা। বিশ্ব নারী দিবসে প্রতিবছরই একটি করে শ্লোগান নির্ধারিত থাকে গত পঁচিশ বছরেও এই শ্লোগানের প্রতিপাদ্য বিষয় বাস্তবে সঠিক প্রয়োগে অর্ধেকও বাস্তবায়ন হয়নি। স্মর্তব্য ১৯৯৬ সালে প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘অতীত উদযাপন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা’। ১৯৯৭ সালে ‘নারী ও শান্তি’ – ‘নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত পৃথিবী’; ছিল ১৯৯৯ সালের প্রতিপাদ্য বিষয়। ২০০০ সালে ‘শান্তি স্থাপনে একতাবদ্ধ নারী’; ২০০১ সালে ‘নারী ও শান্তি : সংঘাতের সময় নারীর অবস্থান’; – ‘আফগানিস্তানের নারীদের বাস্তব অবস্থা ও ভবিষ্যৎ’; ছিল ২০০২ সালের মূল শ্লোগান। ২০০৩ সালে ‘লিঙ্গ সমতা ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’; ২০০৪ সালে ‘নারী এবং এইচআইভি-এইডস’; – ‘লিঙ্গ সমতার মাধ্যমে নিরাপদ ভবিষ্যৎ’ ছিল ২০০৫ সালে; ; ২০০৬ সালে ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী’; ২০০৭ সালে ‘নারী ও নারীশিশুর ওপর সহিংসতার দায়মুক্তির সমাপ্তি’; – ‘নারী ও কিশোরীদের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ’; প্রতিপাদ্য ছিল ২০০৮ সালে; ২০০৯ সালে ‘নারী ও কিশোরীদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে নারী-পুরুষের একতা’; ২০১০ সালে ‘সমান অধিকার, সমান সুযোগ- সকলের অগ্রগতি’; – ‘শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ’; ‘গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়ন- ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সমাপ্তি’; শ্লোগানটি ছিল ২০১১ ও ২০১২ সালের। ২০১৩ সালে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়’; ২০১৪ সালে ‘নারীর সমান অধিকার সকলের অগ্রগতির নিশ্চয়তা’; – ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবতার উন্নয়ন’; ২০১৫ সালে; ২০১৬ সালে ‘অধিকার মর্যাদায় নারী-পুরুষ সমানে সমান’; ২০১৭ সালে ‘নারী-পুরুষ সমতায় উন্নয়নের যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্বে কর্মে নতুন মাত্রা’; – ‘সময় এখন নারীর : উন্নয়নে তারা, বদলে যাচ্ছে গ্রাম-শহরে কর্ম-জীবনধারা’; ছিল ২০১৮ সালের শ্লোগান; ২০১৯ সালে ‘সবাই মিলে ভাবো, নতুন কিছু করো, নারী-পুরুষ সমতার নতুন বিশ্ব গড়ো’ এবং গত বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হল, ‘প্রজন্ম হোক সমতার : সকল নারীর অধিকার’। গত আড়াই দশকে উপরোক্ত প্রতিপাদ্য বিষয়ের সঠিক বাস্তবায়ন দেশ ভেদে পাঁচ থেকে বাইশ পার্চেন্ট মাত্র অর্জিত হয়েছ। নামকাওয়াস্তে বাস্তবায়নের এই ধারা অব্যাহত থাকলে বর্তমান একুশ শতকে বা আগামী আশি বছরেও নারীর বিশ্ব ব্যাপী সমক্ষমতা অর্জন এবং নারীর পরিপূর্ণ অধিকার বাস্তবায়ন হবে বলে আমার বিশ্বাস হয়না; তবে আমি আশাবাদী নারীরা বিশ্বব্যাপী একদিন সাফল্য অর্জন করবেই।
নারীর ক্ষমতায়নের বর্তমান বিশ্বে নারীর অধিকার আদায়ে শ্লোগানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সকল নারীকেই বাস্তবমুখী সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমান একুশ শতকের ডিজিটাল যুগেও বিশ্বের অনেক দেশেই নারীদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নাই অনেক দেশেই এখনও নারীরা নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেনা অপর দিকে দেশ পরিচালনাসহ চাঁদে ও মঙ্গলে নারীরা যাচ্ছে। অতএব দেশভিত্তিক নারীদের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে সুদূর প্রসারী টেকসই ও কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে এবং বিশ্বের অনেক দেশেই নিয়োগ ও বেতন বৈষম্য রয়েছে এই বৈষম্য কাটিয়ে উঠতে পারলেই আগামী প্রজন্ম হবে স্বার্থক। বর্তমান বিশ্বে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে অনেক চড়াই উৎরাই পার করেও নারীরা দিনে দিনে প্রতিটা ক্ষেত্রেই সাফল্যের সিঁড়িতে পা রাখছে; আশা করা যায় এই বর্তমান ত্রিশের দশকের ভিতরেই নারীর ক্ষমতায়ন ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করবে। বিশ্ব নারী দিবসের আন্দোলনে যে সকল নারী নেত্রী অবদান রেখেছেন এবং আগামীতেও রাখবেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের নারীদের প্রতি আমার আহ্বান নারীদের সমস্যা দ্রুত চিহ্নিত করে তা আশু সমাধানের লক্ষ্যে নারী আন্দোলনে যার যার অবস্হান থেকে অধিকার আদায়ে সোচ্চার হোন। নারী-দের সম-অধিকার আদায়ে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে; শুভ হোক আন্তর্জাতিক নারী দিবস।