রেদওয়ানুল করিম রনজু, চট্টগ্রাম থেকে: এমন একজন মানুষকে নিয়ে কিছু কথা লিখবো যিনি আমার জন্মদাতা মুহঃ রেজা-উল-করিম, পিতা: মরহুম ডা. মোতাহার হোসেন, মাতা: মরহুমা রুবি হোসেন। যার কাজই হলো মানবসেবা, সমাজসেবা, সাহিত্য আর সংস্কৃতিচর্চা, আর নিজেকে অত্যন্ত সাবধানে আড়ালে রাখা/প্রচার বিমূখ থাকা। অত্যন্ত ছোট বয়সে মাত্র ০৮ (আট) বছর হারান তাঁর বাবাকে, তার ঠিক তিন থেকে চার মাস পরই দাদাকেও। দাদা ছিলেন তৎকালীন নড়াইল এস্টেটের জমিদারদের জোতদার, বাবা ছিলেন তৎকালীন এলএমএফ পাশ ডাক্তার এবং রাজনীতিবীদও। আমার দাদীর মুখে শুনেছি তিনি (আমার দাদু) নাকি বঙ্গবন্ধুর সহচরও ছিলেন। ঢাকাতে মৃত্যুর পর ক্যাপ্টেন মনসুর, নজরুল ইসলাম সহ আরও প্রখ্যাত রাজনৈতিক সহকর্মীরা তাঁকে দাফন করেন আজিমপুর কবরস্থানে। বারডেমের স্থপতি ডা: ইব্রাহীমও দাদুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বাবার দাদা তাঁর নাতির জন্য প্রায় তিনশত বিঘা জমি রেখে গিয়েছিলেন বলে শুনেছি। আমার দাদু ডা: মোতাহার হোসেন মৃত্যুর আগেই তার ১৪/১৫ বছরের একমাত্র কন্যাকে আর এক ধন্যাঢ্য পরিবারে বিয়ে দিয়ে যান। যিনি (বাবার একমাত্র বোন) অতি সম্প্রতি ১৬ অক্টোবর-২০১৮ তার একমাত্র ভাই, স্বামী, সন্তানদের এবং আমাদের সকলকে ছেড়ে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে গেলেন) ফলে বাবা এবং দাদাকে হারানোর পর সংসারে শুধু মা আর দাদী। আমার দাদী ছিলেন একজন মহিয়সী নারী যিনি খুব অল্প বয়সে বিধবা হয়েও শশুর আর স্বামীর ভিটে-মাটি, জমি-জমা আঁকড়ে ধরে পড়ে থেকেছেন ছেলেকে মানুষ করবেন বলে। আমার বাবা ছোটবেলা থেকেই নাকি ভীষণ একরোখা আর জেদী ছিলেন। তাঁকে আস্কারা দেবার জন্য বেঁচে ছিলেন তাঁর দাদীমা আর একমাত্র বোন । যাইহোক আমার মহীয়সী দাদীর ঐকান্তিক ইচ্ছা আর মানষিক জোরের কাছে সব পরাশক্তি হার মানতে বাধ্য হয়েছিলো। আমার বাবা স্বর্গীয় যতীন্দ্রনাথ মজুমদার প্রধান শিক্ষক মহোদয়ের ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত খোকসা জানিপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার জন্য যশোরে চলে যান তাঁর মায়ের ইচ্ছাতে। যশোর এমএম কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন এবং পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স পাস করেন। মামা বাড়ি থেকে পড়াশুনা করার সময়ই তাঁর মনে ধরে যান আমার মা জননী (অর্থাৎ তাঁর মামাতো বোন), পরে ভাই বোনের (নানা ও দাদীর) সম্মতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন দুজনে।

আমার মায়ের মুখে এবং খোকসার অনেক পুরোনো সাহিত্যসেবীদের কাছ থেকেই জেনেছি ছাত্র অবস্থা থেকেই বাবার সাহিত্য সংস্কৃতি মানবসেবা আর প্রতিবাদী মানষিকতার কথা। আগের যুগে বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন থেকে ম্যাগাজিন বলতে দেওয়াল পত্রিকাকেই প্রাধান্য দেওয়া হতো। সামর্থবানেরা পারলে কিছু সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতেন। শুনেছি সেই ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি মায়ের (আমার দাদী ) প্রতি জোর জবরদস্তী করে একখানা দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ করতে কয়েকবার টাকা নিতেন, কারণ কোন কারণে প্রায় সম্পুর্ণ হয়ে যাওয়া পত্রিকাটা আংশিক বিকৃত হয়েছে তো মরেছে, ওটাকে পূরা ছিঁড়ে আবার আর্ট পেপার কেনো আর নতুন করে আবার বানাও, নিজে সম্পাদনা করে সাহিত্য পত্রিকা, কলেজ ম্যাগাজিনও বের করতেন। সেই সাথে ছিলো সংগীতচর্চা। গরীব-দুঃখী অসহায় মানুষদের প্রতি সারা জীবনই বাবাকে দেখেছি সহানুভূতিশীল। যশোর এমএম কলেজে পড়ার সময় উনি রিকশায় কলেজে যাচ্ছেন কোতোয়ালী থানার সে সময়ের ওসি সাহেবের হোন্ডার সাথে বাবা বসে থাকা রিক্সার ধাক্কা লেগেছে তো ওসি সাহেব হোন্ডা থেকে নেমেই রিক্সা ওয়ালা বেচারাকে বেধড়ক মারেস। প্রতিবাদী আমার বাবা প্রশ্ন করতেই উনার উপরেও গরম শেষমেশ ওসি সাহেবও নাকি দেখলেন প্রতিবাদ কাকে বলে আর কত প্রকার। ওসিকে মেরে কোতোয়ালী থানার প্রাচীরের ভেতর পাশে ফেলে দিয়ে থানার ভেতরে গিয়ে থানার অন্য বাবুদের খবর দিলেন আপনাদের বড় সাহেব প্রাচীরের পাশে পড়ে আছেন নিয়ে আসেন। ঘটনা পরম্পপরায় বলি বাবার খুঁটির জোর ছিলেন তাঁর মামা (পরে শ্বশুর ) আবার ছিলেন যশোর জজ কোর্টের একজন পদস্থ কর্মকর্তা । সেসময় থেকেই সাহিত্য চর্চ্চা আমার বাবার ধ্যান জ্ঞান কিন্তু বরাবরই তিনি প্রচারবিমূখ। পড়াশুনা শেষ করে বাবা পুলিশের অফিসার পদে চাকুরী পান কিন্ত দাদার রেখে যাওয়া শ’শ বিঘা সম্পত্তি আর পরের দাসত্ব না করার মানষিকতা থেকে নিজেকে যক্ষ্মা রুগী বানিয়ে ছেড়ে আসেন সে চাকরি। পরে খুলনা জুট মিলেও নাকি মিল সুপারভাইজারের চাকরি পান, কিন্তু সাহেবদের ঐ বাটী হাতে খাবার আর মিলের চাকার মধ্যে কে ঘুর ঘুর করবে? তাই নিজেই একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন আর মিলের এক ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোকের কপাল ফাটিয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে মায়ের কোলে ফিরে এলেন গ্রামে।

এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মানবসেবার আর এক অনন্য পেশায় নিয়োজিত করবেন নিজেকে যে কথা সেই কাজ, আর সেই কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন আজ পর্যন্ত। সেই থেকে আজ অবধি ৪৫/৪৬ বছর হবে তাঁর পিতার ডা. পেশাকে বেছে নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন আজ অবদি। ডা. পেশার পাশাপাশি কত শত হাজার ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ যে তিনি লিখে রেখেছেন হয়তো নিজেও জানেন না এই প্রচারবিমূখ মানুষটি।

যুদ্ধকালীন সময়ে আমি তখন ৫/৬ বছরের, দেখেছি আমাদের বাড়িতে সব সময় বড় মাপের দু’খানা নৌকা বাঁধা থাকতো আর অনেক মুক্তিযোদ্ধারা পাক বাহিনীর/রাজাকারদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে হাতে, পায়ে, পেটে গুলি খেয়ে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন আর বাবা তাদের চিকিৎসা করেছেন। সাথে উনাদের গজ ব্যান্ডজ, রক্ত মাখা জামা কাপড় ধোয়া, শুকানোর কাজ করেছেন আমার প্রয়াত দাদী আর আমার মা। বাধ্যতামূলক দেশ পরিত্যাগকারীদেরকে সাহায্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক হিসাবে পাকবাহিনী আমার বাবাকে দেখামাত্র গুলি করে মারারও হুকুম দিয়েছিলো। মাঝে মাঝেই দেখতাম আমরাসহ গ্রামের লোকজন আর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ঐ নৌকা দুখানা দিনের পর দিন নদী খাল বিলে ভেসে বেড়িয়েছে, বাবা মাকে জিজ্ঞাসা করলে বলতেন রাজাকারেরা বলেছে আজ আমাদের গ্রাম পোড়াবে আর মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে যাবে তাই আমরা নৌকায়।

আধো আধো মনে পড়ে আমি খুবই ছোট বলে মুক্তিযোদ্ধা কাকুরা আমার লেপ কাঁথার ভেতরে উনাদের অস্ত্র নিরাপদে লুকিয়ে রাখতেন। এই প্রচারবিমূখ আমার বাবাকে গত বছর দু’য়েক আগে হাসি ঠাট্টার ছলে প্রশ্ন করলাম বাবা আপনি কেন মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র নিলেন না? উত্তরে ধমক দিয়ে বললেন এই ব্যাটা আমি কি ট্রেনিং নিয়েছি যে অন্যের হক নস্ট করবো? আমি নির্বাক হয়ে গেলাম আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতার এই নির্মোহ নিরাসক্তি দেখে।
আমার জ্ঞান হবার পর যত লেখালেখি আমি আমার বাবাকে করতে দেখেছি আমার বিশ্বাস তা ছাপা হলে বা প্রকাশনার ব্যাবস্থা হলে বড় না হোক ছোটখাটো একটা গ্রন্থশালা বানানো যেতই। ১৯৮০ দশকে (৮২/৮৩) খোকসা থানা উপজেলায় রুপান্তরিত হবার পর প্রথম নিয়োগপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব আব্দুর রাজ্জাক এবং উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাবু রবীন রায় চৌধুরী’র সার্বিক সহযোগিতায় খোকসার সাহিত্য সংস্কৃতি খেলাধূলার যে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছিলো তারও বড় একটা অংশ হয়ে আছেন আমার বাবা। খোকসাতে পাবলিক লাইব্রেরী, শিল্পকলা একাডেমী হলো। আমার বাবাকে দেওয়া হলো পাবলিক লাইব্রেরীর দায়িত্ব আমি দেখেছি, যারা খোকসার সাহিত্য সংস্কৃতির ধারক ও বাহক তারা দেখেছেন এই পাবলিক লাইব্রেরীকে দাঁড় করানোর জন্য রাত দিন কি অমানুষিক পরিশ্রম করে গেছেন এই মানুষটি। আমার মনে পড়ে দিনের পর দিন আমরা খেয়ে না খেয়ে থেকেছি আর বাবা লাইব্রেরীর বই আলমারি অন্যান্য আসবাবপত্রের জন্য ঢাকাতে বিভিন্ন দপ্তরে বিভিন্ন জনের কাছে ছুটেছেন। অনুদান এনেছেন বাংলা একাডেমি, ব্রিটিশ কাউন্সিল, আমেরিকান কালচারাল সেন্টার, সংস্কৃতি মন্ত্রালয় থেকে। একবার দেখলাম খোকসার অন্যতম কৃতি সন্তান জনাব সৈয়দ ইকবাল রুমি সাহেবের কাছ থেকে আলমারি সহ বই নিয়ে হাজির। এই খোকসাতেই আমার বাবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পদধূলি পড়েছে জনাব সৈয়দ আশরাফ সিদ্দিকির মত দেশবরেণ্য সাহিত্যিকের।
খোকসার সাহিত্য সংস্কৃতির এমন কোন অঙ্গণ ছিলো না যেখানে বাবাকে যেতে দেখিনি নাটক, যাত্রাপালা, সাহিত্য-পত্রিকা, কবিতাপত্র, মানপত্র লিখন, পাঠ করা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সব জাগাতেই, উপস্থাপক হিসেবে আমার বাবাকে আজও খোকসার সর্বজন শ্রদ্ধার সাথে মনে রেখেছেন।
কিন্তু ঐযে নিজেকে প্রচারবিমূখ রাখতে হবে তাই কাজ শেষ তো নিরবতা। অতি সম্প্রতি আমার এক পরম শ্রদ্ধেয় বড় ভাই (আহসান নবাব) আমার বাবার সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছিলেন ‘উনি (বাবা) যদি ঢাকাকেন্দ্রিক হতেন দেশের হাতে গোনা ১০ জন সাহিত্যিকের একজন হতে পারতেন’। বাবা বাংলায় অনার্স করলেও ইংরেজীতেও তাঁর প্রখর ধার, ‘আর সে জন্যই বহুবার আমি খোকসার আর এক ক্ষুরধার সাহিত্যসেবী আমার পুজনীয় পিতৃসমতুল্য শিক্ষাগুরু বাবু দ্বিজেন্দ্রনাথ বিশ্বাসকে বলতে শুনেছি আমার বন্ধু ‘রেজা’ হলো আমার সাহিত্য/লিটারেচারের গাইড। (উল্লেখ্য উনারা দুজনেই স্কুল জীবনের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং স্টুডেন্ট ডিকশনারি মুখস্তকারী। সাহিত্যাঙ্গণে আমি আমার বাবার খুব বেশি সান্নিধ্যে দেখেছি বাবু রবীন রায় চৌধুরী, জনাব ডা. সাফায়েত করিম, উপাধ্যক্ষ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস, বাবু দ্বিজেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, ছড়াকার জনাব নাসের মাহমুদ, বাবু মদন মোহন বিশ্বাস, জনাব আহসান নবাব, বাবু বিকাশ চন্দ্র বসু, বাবু সমর ঘোষ প্রমূখ। প্রখ্যাত গীতিকার জনাব রফিকুজ্জামান, খোন্দকার রিয়াজুল হক কে দেখেছি তাঁর ঘনিষ্ঠতম হিসাবে।

নয় সন্তানের জনক আমার বাবা তাঁর দীর্ঘ চলার পথে যোগ্য সহযোগী হিসেবে পেয়েছেন আমাদের মা জননীকে। যিনি এখনো তাঁর (মা) হাজারও রকম শারীরিক অসুস্থ্যতার মাঝেও প্রতিনিয়ত সেবা সহযোগিতা দিয়ে চলেছেন আমার বাবাকে। ৭৫ বছর বয়সেও এখন অবধি বাবা তাঁর মানবসেবার অন্যতম প্রচেষ্টা ডাক্তারী পেশা চালিয়েই যাচ্চেন, থেমে নাই তাঁর চিরাচরিত লেখালেখি এবং সাহিত্যের তথা মানবসেবায় নিয়োজিত জনদের সাথে যোগাযোগ। ইতিমধ্যেই তিনি হারিয়েছেন তাঁর মা জননী, শশুর, শাশুরী কে।হারিয়েছেন তাঁর অত্যন্ত আদরের সন্তান মেঝ ছেলেকে, অতি সম্প্রতি হারালেন তাঁর একমাত্র বোনকেও।
বাবা তোমাকে অনুরোধ খোলস ছেড়ে বের হও, নিজের প্রতিভাকে একটু বিকশিত করো। গতবার আমি বাড়ি গেলে তুমি বলেছিলে কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থার সাথে কথা হচ্ছে। প্লিজ যোগাযোগ করো আর তোমার সৃষ্ট সম্পদের গর্বিত অংশীদার হবার সুযোগ করে দাও আমাদেরকে, তোমার আগামী প্রজন্মকে। তোমার ক্ষুরধার লেখনী বিশ্বের সাহিত্য সভায় স্থান করে নিক। তোমার গর্বে গর্বিত হোক বাংলার সংস্কৃতিসেবীরা।
পরিশেষে সকলের নিকট আকুল আবেদন, আমার এই প্রচারবিমূখ বাবার জন্য অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে দোয়া করবেন, যেন আমাদের চাওয়া পূরণে তিনি সমর্থ হন আর দীর্ঘজীবি হয়ে আমাদের জন্য আমাদের মাঝে বেঁচে থাকেন।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, কুষ্টিয়া জেলা সমিতি, চট্টগ্রাম, আজীবন সদস্য: কুষ্টিয়া জেলা সমিতি, ঢাকা, উপদেষ্টা: খোকসা উপজেলা কল্যাণ সমিতি, ঢাকা ও চট্টগ্রাম।