শেখ মহিতুর রহমান বাবলু, লন্ডন, যুক্তরাজ্য
বর্তমান যুগে গোটা বিশ্ব যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে সভ্যতায় এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বেশ সম্মানজনক স্থানে উপনিত হয়েছে তখন বাংলাদেশে সেই ত্রিশ দশকের ভেদাভেদ, সাম্প্রদায়িক চর্চা হবে তা আমার ধারণার মধ্যে ছিল না। কিন্তু দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর দেখে মনে হয় এক শ্রেণীর সেক্যুলার, মুখে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বললেও বাস্তবে তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ বিদ্যমান।
আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের দু’জন প্রবাদ প্রতিম পুরুষ। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য তো বটেই এ উপমহাদেশের জন্যেও এই মানুষ দুটি নানা সময়ে নানাভাবে নিজেদের প্রমাণ করেছেন আশীর্বাদ হিসাবে। সম্মানের দিক থেকে তাই উভয়ই সুষম বন্টনের দাবীদার। কিন্তু দেশের একশ্রেণীর গণমাধ্যমে সুশীল সমাজ ও সেক্যুলার ভক্তদের আচরণে নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পার্থক্য সূচিত করার প্রবণতা লক্ষণীয়। নজরুলকে তারা দাঁড় করান সম্প্রদায়িকতার কাঠগড়ায়। আর এই সুযোগে রবীন্দ্রনাথকে বাংলা সাহিত্যের চূড়াবিহীন সফল মানুষ হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।
আমার মতো একজন ক্ষুদ্র মানুষের দৃষ্টিতে যে কোন বিবেচনায় নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথ উভয়ই আমাদের কাছে সমান সম্মান পাবার দাবি রাখে। যুক্তির খাতিরে বলতে হয় বিশ্বকে সাম্প্রদায়িক বর্ণভেদ থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে কবি কাজী নজরুল ইসলামের অসাম্প্রদায়িক উদার চরিত্র বিপুলভাবে লক্ষণীয়। হিন্দু পরিবারের কিশোরী মেয়ে প্রমীলাকে বিয়ে করেও তিনি তাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য একটি দিনও কিছুই বলেননি। তার জীবনী থেকে জানা যায় তিনি মুসলিম হয়েও শাশুড়ি গিরিবালা দেবীর হিন্দু ধর্মাচারণে সহযোগিতা করেছেন। নজরুলের প্রতিটি বাড়ীতেই ছিল একটি করে পূজাঘর। কবি শত ব্যস্ততার মাঝেও নিজ হাতে গিরিবালার জন্য পূজার অর্ঘ্য যেমন ফুল, বেলপাতা, তুলসি, ধুপ, চন্দন, দুবরা, চাল, ধান ও ফলমূল সহ অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করে আনতেন।
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীনের আগে উপমহাদেশে কোন সাহিত্যিক বা সাংস্কৃতিক কর্মী মুসলমান হলেও মুসলিম নামে নিজেকে মেলে ধরা ছিল ভয়ংকর এক ব্যাপার। এ অঙ্গণে কাজ করতে হলে মুসলমানদেরকে হিন্দু নাম ধারণ করতে হতো। সমাজে নষ্ট রাজনীতির কারণে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিরাজ করত বৈরীভাব। বাবুদের বাড়ীর সামনে দিয়ে মুসলমানদের জুতা পায়ে হাটা ছিল আকাশকুসুম কল্পনা। ছাতি মাথায় দিয়ে জমিদার বাড়ীর সামনে দিয়ে হাটা ছিল একেবারেই নিষিদ্ধ। মুসলমান ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিল সীমিত। এমন একটি ভয়াবহ প্রতিকূল পরিবেশে দুই ধর্মের দর্শনই নজরুলের লেখায় সম্মানজনকভাবে উপস্থাপিত হতো। সেখানে না থাকত রাবীন্দ্রিক শিল্পরীতি না নজরুলীর শিল্পরীতি। সবার উপরে মানবতাবাদী স্বরূপকে রূপায়িত করতে তিনি ভুল করেন নি। সেদিন নজরুল উপমহাদেশে সাংস্কৃতির প্রাঙ্গণে যে নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন তা বিস্ময়কর অভিনবত্বে দীপ্তমান। নজরুলের এই উদারতা ও মহৎ সৃষ্টিশীলতা বহিঃর্বিশ্বে সাহিত্য গবেষক ও মানবাধিকারকর্মীদের কাছে আজও কালের সাক্ষী হিসাবে বিবেচিত।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত “বিদ্যাপতি” পালা বাজারে আসে ১৯৩৬ সালে। বিদ্যাপতির কাহিনী গড়ে উঠেছিল কবি বিদ্যাপতির সাথে মিথিলার রানী লছমির প্রচলিত প্রেম কাহিনীকে কেন্দ্র করে। লোক কাহিনী অনুসারে বিদ্যাপতি এবং লছমি পরষ্পরকে ভালবাসতেন। এ লোক কাহিনীর সাথে নজরুল যুক্ত করেন অনুরাধার কাহিনী। নজরুল সৃষ্ট অনুরাধা ভালোবাসতেন কবি বিদ্যাপতিকে। রানী লছমিকে পাওয়ার জন্য বিদ্যাপতির আকাংখা ছিল অত্যন্ত প্রবল। রাজার মৃত্যুর পর রানী লছমি নিজেই এগিয়ে আসেন বিদ্যাপতিকে আত্মনিবেদনের জন্য। ততদিনে বিদ্যাপতির মনের মধ্যে এসে গেছে আমূল পরিবর্তন। দেহাতীত প্রেমের স্বপ্ন বিদ্যাপতির নিকট প্রত্যাখাত হলে রানী লছমি আত্মহত্যার জন্য নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। লছমিকে অনুসরণ করেন বিদ্যাপতি ও অনুরাধা।
বিদ্যাপতির কয়েকটি সংলাপ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা যাক।
বিদ্যাপতি বলেন: অনুরাধা এমনি করেই তুমি বৃন্দাবনে ললিতারূপে শ্রীকৃষ্ণকে আত্ম নিবেদন করেছিলে। কোন দিন শ্রীকৃষ্ণকে নিজের করে পাওনি। শ্রীকৃষ্ণের যাতে প্রীতি সেই শ্রীমতীর সাথে তার মিলন ঘটেছিল। অন্য একটি সংলাপে বিদ্যাপতি বলেন “আমি যখন অধিষ্টের মত গান করি ও আমার আত্মার গান নয় ও গান পরমাত্মারূপী শ্রীকৃষ্ণের গান। ”
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্যে এ ধরণের অসংখ্য নাটক, গান, কবিতা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করেছেন আমাদের প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে হিন্দুদের নিয়ে লেখা অনেক কিছু আজ হারিয়ে গেছে। পরিণত হয়েছে হিন্দুদের সম্পদ হিসাবে। তাও আবার বেনামে। এসব দেখার এখন কেউ নেই। শুধু আছে নজরু কে খাটো করার জন্য একটি শ্রেণীগোষ্ঠী।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমার জানামতে রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কোনদিন কিছুই লেখেননি। রবীন্দ্র রচনাবলী পড়ে মনে হয় না বাংলায় মুসলমান বলে কোন সম্প্রদায় ছিল। শরৎচন্দ্র তার লেখা বিভিন্ন গল্প উপন্যাস ও নাটকে মুসলমানদেরকে ছোট করে দেখিয়েছিলেন। কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ তাও করেননি। কিন্তু নজরুল হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খৃষ্টানদের ধর্মীয় উৎসব তার রচনায় নানাভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি ধর্মীয় পরিচয়ের আড়ালে সকলকে মানুষ হিসাবে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। বিশ্বকবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা পুতুলের বিয়ে নাটকের সংলাপ: খেদি: আচ্ছা ভাই, মুসলমানদের পুতুলের সাথে তোর পুতুলের বিয়ে হবে কি করে ক?
কলমি: না ভাই ও কথা বলিস নে..ওদের আল্লাহ যা আমাদের ভগবানও তা
মোরা এক বৃন্তে দুটি ফুল হিন্দু মুসলমান।
মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলার উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সঙ্কটময় মুহূর্তে আশাহীন-দিশাহীন জাতিকে মুক্তির নেশায় উজ্জীবিত করতে, পূর্ববাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাশ্চাত্যের শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। ইতিহাসের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে, নানা ভাস্বর অধ্যায়ের রূপকার হয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার ক্ষেত্রে অন্যান্য হিন্দু নেতাদের মতো কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হিন্দু নেতারা ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বিদ্রুপ করেছেন সে সময়। চাষাভুষা মুসলমানদের সন্তানরা শিক্ষিত হবার নামে রাষ্ট্রীয় অর্থ নষ্ট করুক এটা তারা চাননি বলে আওয়াজ তুলেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন The Muslims of Eastern Bengal were in large majority cultivators and they would be benefited in no way by the foundation of a University. ১৯১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করে কলকাতার গড়ের মাঠে একটি সভা হয়। সে সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং কবিগুরু। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওই সভায় বলেছিলেন “পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা তো বাংলাই বলতে পারে না, তারা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে কি করবে”। হিন্দু বৌদ্ধ বা অন্য কোনো জাতী ধর্ম বর্ণ নিয়ে বিশ্ব কবি কাজী নজরুল ইসলাম জীবনে কোনো দিন কোনো কটুক্তি করেননি। জাতীয়তাবাদী চেতনা ও দরিদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর অগ্রগতির বিষয়টি মাথায় রেখে যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল; সেখানে আজ মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ যেন অনেকটা অপরাধ। তথাকথিত প্রগতিশীলরা যেন একশ্রেণীর বাবুদের ও সুচতুর ইংরেজদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত। এটি কাম্য নয়।
দেশের একটি মহল সুপরিকল্পিতভাবে নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে। নজরুলকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। খাটো করা হচ্ছে। সব চাইতে দুঃখজনক হলেও সত্য যে এসব বিভেদ সৃষ্টিকারীর সাথে যোগ হয়েছে রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত গণমাধ্যম। যারা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে সমাজে এ ধরণের বিভেদ সৃষ্টি করে ফায়দা লুটছে। তাদের কালো হাত থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করার কি কোন উপায় নেই? দেশের সচেতন মানুষের কাছে নজরুলের ভাষায় প্রশ্ন করতে চাই
সত্যকে আজ হত্যা করে
অত্যাচারীর খাড়ায়
নেই ফিরে কেউ শক্তিসাধক
বুক ফুলিয়ে দাঁড়ায়?