মাহমুদ মহীলদীন ও দিলিপ রাথা, ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র
বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য উপাত্ত দেখায় যে বিশ্বব্যাপী মাইগ্রেশন প্রবণতা বাড়ছে। এই প্রবণতা ভবিষ্যতেও ক্রমাগত চলতে থাকবে। বিভিন্ন দেশে অসম্পূর্ণভাবে প্রণীত মাইগ্রেশন নীতি অনেক মিথের (পৌরানিক কাহিনীর) জন্ম দিয়েছে। কিন্তু সে নীতিগুলো এ প্রক্রিয়াকে কার্যকরভাবে পরিচালিত করতে পারেনি। মাইগ্রেশনের ফলে দেশে দেশে উন্নয়ন তরান্বিত হয়েছে অথচ প্রায় সব দেশই কমবেশি এ প্রক্রিয়াকে বন্ধ করার নীতি গ্রহণ করেছে।
২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটির মাধ্যমে নিরাপদ, নিয়মিত ও নিয়মানুগ অভিবাসনের পক্ষে গ্লোবাল কম্প্যাক্ট (Global Compact) নীতি গ্রহণ করা হয়। এর পক্ষে ভোট পড়েছে ১৫২টি, বিপক্ষে ৫টি এবং ১২টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। নিরাপদ, মানবিক এবং নিয়মানুগ অভিবাসন ব্যবস্থাপনার একটি পদক্ষেপ হিসাবে এই কম্প্যাক্ট নীতিকে অভিনন্দন জানিয়েছে সমর্থক দেশগুলো। সংখ্যায় কম হলেও সেদিন এর বিরোধীরা নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করেন।
কম্প্যাক্ট নীতি আইনত বাধ্যতামূলক কোন চুক্তি নয়। এটি অভিবাসীদের নতুন কোন অধিকারেরও নিশ্চয়তা দেয় না। বস্তুত সদস্য দেশগুলোর মধ্যে দুই বছর অংশগ্রহণমূলক আলোচনা-পর্যালোচনা এবং ৬ দফা চুক্তি প্রণয়নের লক্ষ্য নিয়ে এই নীতির ২৩টি উদ্দেশ্য সম্বলিত একটি খসড়া তৈরী করা হয়। বিশেষত: আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কাঠামো তৈরীর উপর দৃষ্টি দেয়া হয়েছে যাতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ বিষয়ে একে অপরকে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করতে না পারে।
এ কম্প্যাক্ট নীতি সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির কারণে মাইগ্রেশন চ্যালেঞ্জকে আরো নিবিড় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার প্রয়োজন দেখা দেবে। এর ফলে অভিবাসীদের হোস্ট কান্ট্রি এবং হোম কান্ট্রি উভয়ই একটি ভালো ব্যবস্থাপনা তৈরীতে বিরাট সুযোগ পাবে।
সর্বাগ্রে বলা যায়, স্বদেশে অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধার অভাব মানুষকে অন্যদেশে অভিবাসী হতে প্ররোচিত করে। সমীক্ষায় দেখা গেছে উচ্চ আয়ের দেশের মাথাপিছু গড় আয় নিম্ন আয়ের দেশের মাথাপিছু গড় আয়ের ৭০ গুণ বেশি। তাই উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে মানুষ তার ভাগ্য ফেরাতে তাদেরকে উন্নত দেশে ঠেলে নিয়ে যায়- এতে অবাক হবার কিছু থাকে না।
জনসংখ্যাত্ত্বিক পরিবর্তনের ধারাও মাইগ্রেশন প্রবণতাকে আরো বাড়িয়ে তোলে। উচ্চ আয়ের দেশগুলো যেমন বয়স্ক লোক বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে অপরদিকে নিম্ন আয়ের দেশে কর্মক্ষম এবং তরুণ জনগোষ্ঠীরা বেড়ে চলেছে। প্রযুক্তিগত বাধাও শ্রম বাজারে বেশ চাপ সৃষ্টি করেছে। এর সাথে নতুন যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে ভবিষ্যৎবাণী হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আগামী এক দশকে প্রায় ১৪০ মিলিয়ন মানুষ তাদের স্বদেশ থেকে অন্যদেশে অভিবাসীত হবে। কিন্তু প্রচলিত মতের বিপরীতে বলা যায়, বিশ্বব্যাপী অভিবাসীদের প্রায় অর্ধেকই উন্নত দেশে যায় না বরং তারা অন্য উন্নয়নশীল কোন দেশে বা প্রতিবেশী কোন দেশে স্থানান্তরিত হয়।
আবার অভিবাসী কর্মীদের প্রত্যাবর্তনও বেড়ে চলেছে। এর কারণ হলো কর্মীরা নতুন শ্রম বাজারে প্রবেশ করতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের চাকরির মেয়াদ চুক্তি শেষ হবার কারণেও তারা বিদেশ থেকে ফেরত আসছে। এ বিষয়টি অনেক সময় উপেক্ষিত থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গত দুবছরে উপসাগরীয় দেশগুলোতে নতুনভাবে নিবন্ধিত কর্মীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। দেশ ভেদে এর শতকরা হার ১০ থেকে ৪১ শতাংশ। ২০১১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইউরোপের দেশগুলো থেকে প্রত্যাবর্তনকারীর সংখ্যা চারগুণ বেড়ে প্রায় ৫.৫ মিলিয়নে পৌঁছেছে। এদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে যাওয়া রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী যাদের আবেদন বাতিল করা হয়েছে বা যাদেরকে সঠিক কাগজপত্রের অভাবের কারণে নথিভুক্ত করা হয়নি। ঠিক একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনকারীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ যার সংখ্যা ৩ মিলিয়নের বেশি। সৌদিআরব এবং সাউথ আফ্রিকা থেকেও প্রত্যাবর্তনকারী বেড়ে চলেছে। অথচ বিদেশে থেকে এসব কর্মী তাদের হোস্ট কান্ট্রির উন্নয়নের জন্য বিপুল পরিমাণ অবদান রেখে চলেছে। পরিসংখ্যান বলে, সারা বিশ্বে অভিবাসীর সংখ্যা ২৬৬ মিলিয়ন যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩.৪ শতাংশ। তারা বিশ্বের মোট জিডিপির ৯ শতাংশের যোগানদাতা।
অভিবাসীদের সমস্যা সমাধানে সর্বাগ্রে প্রয়োজন তাদের অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান উচ্চ বাধাসমূহ দূর করা। উদাহরণস্বরূপ বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য দরিদ্র দেশগুলোর অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত একজন কর্মীকে উচ্চ ফি প্রদান করতে হয় যা তার পুরো এক বছরের আয়কেও অতিক্রম করে যায়। এর সিংহভাগ চলে যায় অসাধু শ্রম দালালদের পকেটে। আর এজন্য জাতিসংঘ স্থায়ী উন্নয়ন লক্ষ্য-এসডিজি (Sustainable Development Goals-SDGs) নীতিতে বিদেশগামী কর্মীদের নিয়োগ খরচ কমিয়ে আনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে।
অভিবাসন স্বদেশে অনেক বেশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটায়। যদিও অভিবাসীরা হোস্ট কান্ট্রিগুলোতে তাদের অর্জিত মজুরির বেশিরভাগ ব্যয় করে ঐ দেশের উৎপাদন চাহিদা বাড়িয়ে দেয়; তবুও তারা নিজ দেশে পরিবারের সহায়তার জন্য রেমিটেন্স পাঠাতে থাকে। এ ধরণের রেমিটেন্সের পরিমাণ অনেক দেশে সরকারি উন্নয়ন সহায়তাকেও ছাড়িয়ে যায়। গত বছর স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে রেমিটেন্স প্রবাহ ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল যার পরিমাণ ৫২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ পরিমাণ অর্থ দেশগুলোর সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণের চাইতেও বেশি।
বৈশ্বিকভাবে সবচেয়ে বড় রেমিটেন্স আহরণকারী দেশ হলো ভারত (৪০ বিলিয়ন ডলার) তার পরে রয়েছে চীন, ফিলিপাইন, মেক্সিকো এবং মিশর। জিডিপির অংশ হিসাবে বৃহত্তম দেশ হলো টোঙা, কিরগিজিস্তান, তাজিকিস্তান এবং নেপাল। ২০১৮ সালে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ার অন্যতম কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রে শ্রম বাজারের উন্নতি এবং রাশিয়া ও উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে অর্থ প্রবাহে ছাড়ের দ্রুতগতি। কিন্তু টেকসই উন্নয়নের জন্য রেমিটেন্স প্রেরণের সম্ভাবনা পূরণ হচ্ছে না। এ প্রধান কারণ রেমিটেন্স প্রেরণের উচ্চ খরচ।
নিজ দেশে টাকা পাঠাতে একজন অভিবাসীকে পাঠানো টাকার উপর গড়ে ৭ শতাংশ হারে মানি ট্রান্সফার ফি হিসাবে খরচ করতে হয়। এ কারণে বাজারে রেমিটেন্স সার্ভিস সেক্টরে অসুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। মানি লন্ডারিং এর মতো আর্থিক অপরাধের বিরুদ্ধে চালিত কঠোর আইন প্রয়োগও এর জন্য কিছুটা দায়ী। পাশাপাশি অদক্ষ প্রযুক্তির উপর নির্ভরতাতো রয়েছেই। মানি ট্রান্সফারে ব্যয় এসডিজি লক্ষমাত্রা নির্ধারিত ৩ শতাংশের নীচে নামিয়ে আনা গেলে তা রেমিটেন্সের মোট পরিমাণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।
এসডিজি সূচকের লিংকগুলোর কারণে আমরা মাইগ্রেশন সম্পর্কে প্রায় উপেক্ষিত উপায়সমূহে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি, যাতে মাইগ্রেশন উন্নয়নকে তরান্বিত করতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা মাইগ্রেশনের মিথ সমূহকে উড়িয়ে দিয়েছে। গবেষণা দেখায় যে, অভিবাসীরা তাদের হোস্ট দেশগুলোর উপর খুব বেশী আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দেয় না এবং স্থানীয় স্বল্প দক্ষ শ্রমিকদের মজুরিও কমিয়ে দেয় না।
মাইগ্রেশন প্রবাহ দিন দিন বাড়ছে এবং এ প্রবণতা ভবিষ্যতেও চলমান থাকবে। বিচ্ছিন্নভাবে প্রণীত মাইগ্রেশন নীতি অনেক মিথের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু তা এ প্রক্রিয়াকে কার্যকরভাবে পরিচালিত করতে পারেনি। মাইগ্রেশনের ফলে দেশে দেশে উন্নয়ন হয়েছে অনেক, অথচ প্রায় সবদেশেই কমবেশী এ প্রক্রিয়া বন্ধ করার নীতি গ্রহণ করেছে।
তাই আমরা মনেকরি একমাত্র একটি সমন্বিত উদ্যোগই পারে মাইগ্রেশনের সমস্যাগুলো সমাধান করতে যা জাতিসংঘ গ্লোবাল কম্প্যাক্ট নীতিতে নির্দেশিত হয়েছে।
[মাহমুদ মহীলদীন- বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পক্ষে জাতিসংঘের সম্পর্ক ও অংশীদারিত্ব বিষয়ে ২০৩০ উন্নয়ন এজেন্ডার সিনিয়র ভাই প্রেসিডেন্ট এবং মিশরের সাবেক বিনিয়োগ মন্ত্রী। দিলিপ রাথা: বিশ্বব্যাংকের মাইগ্রেশন ও রেমিটেন্স ইউনিট এবং মাইগ্রেশন ও উন্নয়ন সংক্রান্ত বৈশ্বিক জ্ঞান অংশীদারিত্বের প্রধান]
(প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন- শহীদ রাজু, নির্বাহী সম্পাদক, প্রবাস মেলা)