সত্যরঞ্জন সরকার, কুয়েত সিটি, কুয়েত
জনগণের সেবা প্রদানকারী ও প্রত্যাশা পূরণে যাদের নিয়োগ প্রদান করা হয় তথা যারা সরকারি কর্মচারী তারা কি তাদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করছেন বা করেন? এ প্রশ্ন আজ আপামর জনসাধারণের। উত্তরে বলা হবে হ্যাঁ নিশ্চয়ই। তা-না হলে রাষ্ট্র তথা দেশ চলছে কিভাবে? ঠিকইতো দেশ চলছে কিন্তু যে গতিতে যেভাবে দেশ চলার কথা তথা ‘জনসেবা’ প্রদানের কথা সেখানে মনে হয় আবর্জনা জমেছে। শুধু আবর্জনা নয় দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। সরকারি চাকরি যে পদের বা যে মন্ত্রণালয়েরই হোক না কেন, সোনার হরিণ ধরা আর কেল্লা ফতে হওয়া মানসিকতার ধারক বাহক আজকের যুব সমাজ। যেভাবেই হোক সরকারি চাকরিতে নিয়োগ মানে অর্থনৈতিকভাবে সুরক্ষিত হলো তার পরিবার এবং ভবিষ্যৎ।
সরকারের নির্ধারিত বেতন ছাড়াও আজকের যুগে যে পরিমাণ বেতন তার থেকেও অতিরিক্ত আয়ের নেশায় মত্ত সরকারি চাকরিজীবীরা। তাইতো বেতনের চেয়েও বেশী টাকায় ঘরভাড়া, স্ট্যাটাস বজায় রাখার জন্য পরিবার পরিজনকে নিয়ে ভোগ বিলাসের মধ্যে জীবন যাপন আজ ধ্রুব সত্য। রাজধানী কেন্দ্রিক জীবনে এসব সেবা প্রদানকারী মানুষেরা গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষদের থেকে নিজেদের আলাদা ভাবতে শিখেছে শহুরে ব্যয়বহুলতার কারণে। নির্মোহভাবে বললে, শহুরে ভদ্রজন বনে যাওয়াতে তথা উচুঁ তলার মানুষ হবার সুবাদে নাক শিটকানোর অভ্যাসেও অভ্যস্ত হচ্ছেন কেউ কেউ। কিন্তু গাঁ-গেরামের মানুষেরাই যে তাদের অক্সিজেন একথা ভুললে চলবে কেন? আজও তাদের উৎপাদিত ফসলে উদরপূর্তি ঘটে, তাদের ঘামঝরানো ট্যাক্সের টাকায় দেশ চলে।
দেশের উন্নয়নে গ্রামীণ মানুষের উৎপাদনে সংশ্লিষ্টতা ও সক্রিয়তাকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। গ্রাম বাঁচলেই দেশ বাঁচবে এ মহাজনী বাক্য আজও চিরসত্য।
প্রশ্ন হচ্ছে গ্রামে বাস করা এই মানুষগুলো তাদের জন্য নির্ধারিত সব মৌলিক অধিকারের নিমিত্তে যে সেবা প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আছে এবং যারা সেখানে কাজ করেন তাদের কাছ থেকে কি তারা ঠিকমত সেবা পাচ্ছেন, অথবা নির্দ্বিধায় সেবা প্রদানকারীরা কি উৎকোচ গ্রহণ ছাড়া সেবা প্রদানে উদ্ভূদ্ধ হচ্ছেন? আজও চিকিৎসা খাতে মাথাপিছু যতটুকু বরাদ্দ তার মাধ্যমে গ্রামের মানুষেরা কি সঠিক সেবা পাচ্ছেন? সেবা গ্রহণে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের পকেটের টাকা না খসলে সেবা মিলছে না, এটা অপ্রিয় হলেও বাস্তব সত্য।
জমি জায়াগার বিরোধের জেরবার গ্রামের মানুষগুলো আইন প্রত্যাশী হয়ে বিচারের দোরগোড়ায় মাথা কুটে মরলেও এবং অর্থ বিত্তের অপচয় হলেও ন্যায় বিচার আজ দুরাশা মাত্র। উটকো ঝামেলা জুটেছে, রাজনীতি গ্রামে ছড়িয়ে পড়াতে। ওরা-আমরার বিভাজনে আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন বাহিনীর লোকদের আজ পোয়াবারো। যে কোন ভাবে ফাঁসিয়ে অর্থ আদায় আজ হর হামেশাই ঘটছে। সংঘবদ্ধভাবে এর প্রতিবাদ না হওয়াতে প্র্রতিবাদহীন সমাজ ব্যবস্থায় ঘুষ, দুর্নীতির মাত্রা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে। বাড়ির যুবক ছেলেমেয়েদের নিয়ে অভিভাবকরা আজ সত্যিই বড় বিপদে আছে। কি জানি কখন কোন মামলায় কাকে ফাঁসিয়ে দেবে বলে ভয়ে অভিভাবকরা সবসময় তটস্থ থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। মনে মনে তারা বর্তমান সরকারের ভালো কাজের প্রশংসার জায়গায় এইসব অনাসৃষ্টিতে দু’বেলা সরকারকে গালাগালি দিচ্ছেন। মাদক দ্রব্যের বিস্তার রোধে যাদের দায়িত্ব তারাই মাদকের বিস্তার ঘটাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনও শোনা যাচ্ছে এবং টেলিভিশনে দেখছি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন যুব সমাজকে কব্জা করে অর্থ আদায়ের জন্য ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল এসব উঠতি যুবকদের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘুষের বাণিজ্য করছেন। এসবের জন্য দলগতভাবে সিন্ডিকেটের দাপট পাড়া, মহল্লা, হাটে বাজারে বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং এসবের কারণে সরকারের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হচ্ছে।
দলের লোকেরা চাঁদাবাজির জন্য এমন সুশৃংখলাবদ্ধ যে তাদের হাত থেকে সহজ সরল কিংবা ভিন্নমতের মানুষেরা আজ বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত। রাজনৈতিক চাপে তারা দিশেহারা, এ সমস্ত অপকর্মের হোতাদের যদি এখনই লাগাম টানা না ধরা হয়, তাহলে আগামীতে এই সরকারকে চরম মাশুল দিতে হবে, একথা হাটে মাঠে ঘাটে বাজারে বহুল চর্চিত। কাঁচের রঙ্গীন চশমা দিয়ে হিমশীতল ঘরে বসে গ্রাম-বাংলার যে খবর, নীতিনির্ধারকদের কিংবা মোসাহেবী নেতা উপনেতাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে যাচ্ছে, তা কিন্তু মোটেই বাস্তবতার সংগে খাপ খাচ্ছে না। আপাতঃদৃষ্টিতে সব ঠিকঠাক চললেও ভিতরে ভিতরে অজস্র শূণ্যতার ও ক্ষোভের দানা বাঁধছে। দলাদলিকে যদি গালাগালি করে রাজনীতিকে গতিশীল করা না হয় তাহলে বিভাজনের এই রাজনীতি সকলের জন্যই বিশেষ করে ক্ষমতাশীল দলের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। সব কিছু ম্লান হয়ে যাবে যদি মানুষের ভিতরে আস্থার সংকট দেখা দেয়। বিপদে আপদে পাশে না দাঁড়িয়ে যদি বিপদগ্রস্তের সুযোগ নিয়ে দু’পয়সা আয়ের ধান্ধা করে ধান্ধাবাজি করে তাহলে সরল সহজ মানুষগুলো কিন্তু রাজনীতিবিদদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে- যা রাজনীতির জন্য আত্মঘাতী হয়ে দেখা দেবে।
নীচুতলার নেতারা কি করছে, তাদের আয় উপার্জনের উৎস কী? এসব দেখভালের জন্য সৎ ও যোগ্য নীতিবান নেতাদের উৎসাহ দিয়ে দেখভালের দায়িত্ব দিতে হবে। গ্রুপিং- যা প্রত্যেক দলের জন্য সংক্রামক ব্যাধি, তা নিরসনকল্পে অবশ্যই গণতান্ত্রিক পরিবেশে সর্বজন সম্মতিতে নীচুতলাতে নেতা নির্বাচিত করতে হবে- নচেৎ নিজেরাই নিজেদের আত্মকলহের কারণে দলের শৃঙ্খলা নষ্ট করে জাতীয় রাজনীতিতে তার প্রভাব ফেলতে চেষ্টা করবে। এখনই সময় এসবের দেখভালের জন্য মনিটরিং ব্যবস্থা করা।
রাজনীতির এই পচনশীল প্রক্রিয়ায় যাদের কারণে আজ গ্রামের সরল সহজ মানুষগুলো দ্বিধাবিভক্ত, দ্বিখন্ডিত তাদের একত্রিত করা, স্বপক্ষে আনার জন্য ফন্দিফিকির না করে আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। অবিচার, অন্যায় এসবের থেকে প্রতিকার প্রত্যেকেই পাবে এবং সবসময় নেতারা তাদের পাশে থাকবে এটুকুই তারা আশা করে। গ্রাম্য রাজনীতির মারপ্যাঁচে বিচার, সালিশের নামে প্রহসন করে সরল সহজ মানুষগুলোকে যেন বিপদে না ফেলতে পারে। দুর্বলকে রক্ষা করা যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব তেমনি সবলের দুরাচারে দুর্বিনীত প্রভাবে গ্রাম্য রাজনীতির বিষবাষ্পে গ্রামীণ জীবন যেন বিষাক্ত না হয়ে ওঠে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাজনীতির মাঠে ময়দানে যারা খেলছেন ‘টু-পাইসের’ ধান্দায়, থানা পুলিশ এবং ‘অমুক নেতার’ প্রভাব খাটিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষেরা যেন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, সেদিকে নজর দেওয়া আজ জরুরী দরকার।
নিজের জমি, জায়গা, গবাদি পশু, গাছ-গাছালি এগুলো নিজেদের দখলে রাখার জন্য এবং পরিবারের মান-মর্যাদা নিয়ে সাথে থাকার যে ধারাবাহিকতা গ্রামীণ জীবনের সত্যিকার চিত্র, তা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। টাউট বাটপাড়েরা রাজনীতির নামে বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় সুশাসনের নামে অপশাসন করে গ্রামীণ মানুষকে যেন অতীষ্ট করে না তোলে সেদিকে ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ের নেতা নেত্রীরা যেন খেয়াল রাখেন। উটকো ঝামেলার প্রকোপে সাধারণ মানুষ আজ অতীষ্ট- এদিকে নজর না দিলে আগামীতে ভিতরে জমে থাকা এসব ক্রোধ সম্পন্ন স্বপক্ষের মানুষগুলোও কিন্তু বিপক্ষে যেতে বাধ্য হবে। বর্তমান সরকারের এত উন্নয়ন এসব যেন কোন ক্রমেই দলীয় অসৎ তৃণমূল পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের কারণে সাধারণ মানুষের মনে তাদের কার্যকলাপে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি না করে। আমরা পেয়েছি অনেক, এগিয়েছিও অনেকদূর, এ থেকে যেন আমরা আর পিছনে না ফিরি।
পুকুরে ঢিল ছুড়লে জলের ঢেউ কুলে এসে আছড়ে পড়ে এবং সেটা দৃশ্যমান। সাগরে ঢেউ প্রতিনিয়ত আছড়ে পড়ছে ঢিল ছোড়ার দরকার হয়না, সেখানে ঢেউয়ের গতির পরিমাপ অদৃশ্য থেকে যায়। ছোট ছোট গ্রামগুলোর রাজনীতির তাপ, উত্তাপ, ভালো, মন্দ দীর্ঘসময় জনমনে চর্চিত হয় এবং সেগুলোই তাদের নির্বাচনের সময় রাজনীতির মাপকাঠি হয়। অতএব ন্যায়বিচার, সম্মান মর্যাদাবোধ, সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ, আইনের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আইনের অপপ্রয়োগ- এসব থেকেই গ্রামের মানুষেরা মুক্তি ও স্বস্তি চায়। আশা করি সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এ বিষয়ে দৃষ্টি দেবেন।
(লেখক, কুয়েত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালায়ের উচ্চপদস্থ পদে কর্মকর্তা)